Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

শেখ হাসিনা: বিশ্বমঞ্চে নিপীড়িত মানুষের চির আকাক্সিক্ষত কণ্ঠস্বর

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া
৬ জানুয়ারি ২০২৪ ১৮:০২

জাতিসংঘে প্রধানমন্ত্রী নিপীড়িত মানুষের কণ্ঠস্বর হিসেবে নিজেকে আবারও তুলে ধরলেন বিশ্ববাসীর কাছে। তার সময়োপযোগী বক্তৃতার মাধ্যমে সম্পন্ন করলেন জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে তার দেওয়া ১৯ তম ভাষণ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এটি অনন্য এক অর্জন, যা বিশ্বের আর কারো নেই। এর আগে সবচেয়ে বেশি ১৬বার ভাষণ দেয়ার রেকর্ডটি ছিল মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদের। নিজের রেকর্ড আবার নিজেই ভাঙলেন। প্রতিটি ভাষণেই যে দৃঢ়চেতা মনোভাব তিনি দেখিয়েছেন তার কারণেই জাতিসংঘে নিজেকে স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব করে তুললেন। বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথম বারের মতো জাতিসংঘের ৫১ তম অধিবেশনে ১৯৯৬ সালের ২৪ অক্টোবর ভাষণ দিয়েছিলেন। প্রথম ভাষণে তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করে বলেছিলেন, ‘আজ থেকে ২২ বছর আগে ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর আমাদের মহান নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে এ মঞ্চে দাঁড়িয়ে সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে এক মহান ভাষণ দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে, জাতির জনকের কন্যা হিসেবে এই অনন্য বিশ্ব ফোরামে বক্তব্য রাখার বিরল সম্মান ও সুযোগ আমাকে আবেগাপ্লুত করে তুলেছে। এর মধ্যে বিশ্বে অনেক নাটকীয় পরিবর্তন ঘটেছে, পুরনো আদর্শ ভিত্তিক বিভক্তি ভেঙে পড়েছে, আঞ্চলিক সহযোগিতার সম্পর্ক গভীরতর হয়েছে এবং এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বিগত দুই দশকে দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের ফলে নতুন শক্তিশালী ভূ-রাজনৈতিক জোটের উদ্ভব হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতিটি ভাষণের মধ্যে দিয়ে আমরা যেন খুজে পাই ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর বিশ্বময়দানে বাংলা ভাষার প্রথম বলিষ্ঠ ও সাহসী উচ্চারণ আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর অসামান্য কূটনৈতিক দক্ষতায় ১৯৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্য পদ লাভ করে। জাতিসংঘের পাঁচটি স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্রের দুইটি শক্তিশালী রাষ্ট্র মুক্তিযুদ্ধের সরাসরি বিরোধী করেছিল। এমন প্রেক্ষাপটে স্বাধীনতার মাত্র আড়াই বছরের মধ্যে জাতিসংঘের সদস্য পদ প্রাপ্তি বাংলাদেশের বিশাল অর্জন ছিল। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর অনন্য সাধারণ নেতৃত্ব গুনের কারণে যা একমাত্র সম্ভব হয়েছিল। জাতিসংঘের সদস্য পদ প্রাপ্তির এক সপ্তাহ পর ২৫ সেপ্টেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্র প্রধান হিসেবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ভাষণ দিয়েছিলেন। ঐতিহাসিক ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘যে মহান আদর্শ জাতিসংঘের সনদে রক্ষিত আছে, আমাদের লাখ লাখ মানুষ সেই আদর্শের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করিয়াছে। শান্তি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে সকল মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের উপযোগী একটি বিশ্ব গড়ে তোলার জন্য বাঙালি জাতি পূর্ণ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’

বিজ্ঞাপন

প্রধানমন্ত্রীর এবারের ভাষণ ছিল নানা কারণে তাৎপর্যপূর্ণ। বরাবরের মতো বাংলায় দেওয়া এই ভাষণে তিনি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন, যুদ্ধ ও নিষেধাজ্ঞা পরিহার, জরুরি অবস্থা মোকাবিলার জন্য আঞ্চলিক খাদ্য ব্যাংক চালু, জলবায়ু পরিবর্তন, মানবাধিকার, নারীর ক্ষমতায়ন, স্বাস্থ্যসেবা, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি), সন্ত্রাসবাদ এবং সরকারের অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং অন্যান্য বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক সমস্যার কথা তুলে ধরেন। তার ভাষণ তিনি একদিকে বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাফল্যগাথা যেমন তুলে ধরেন, ঠিক তেমনি একটি বিশ্ব গড়ে তোলার বিশ্বনেতাদের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার আহবান জানান, শান্তির অমোঘ বাণী তুলে ধরেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্ব নেতৃবৃন্দের প্রতি যুদ্ধ ও সংঘাতের পথ পরিহার করে মানবজাতির কল্যাণ ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য একযোগে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ‘আজ আপনাদের সকলের কাছে,বিশ্ব নেতাদের কাছে আমার আবেদন যুদ্ধ ও সংঘাতের পথ পরিহার করুন এবং আমাদের জনগণ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য স্থায়ী শান্তি, মানবজাতির কল্যাণ এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য সম্মিলিতভাবে কাজ করুন।’ গনতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান স্পষ্ট করে দিয়ে বলেছেন, ‘একটি দায়িত্বশীল রাষ্ট্র হিসেবে জনগণের মানবাধিকার রক্ষায় আমরা সম্পূর্ণরূপে অঙ্গীকারবদ্ধ।আমি দ্ব্যর্থহীন ভাবে ঘোষণা করতে চাই যে,বাংলাদেশ সংবিধানের আলোকে গণতন্ত্র,আইনের শাসন ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে যাবে।’

জাতিসংঘে সাধারণ পরিষদের ভাষণে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে অভূতপূর্ব সাফল্যগাথা তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। তার এই বিশেষ আজ শুধু দেশের জন্য নয় সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য একটি রোল মডেল। কমিউনিটি ভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবার মডেল উপস্থাপন করে বিশ্ববাসীর কাছে তিনি আজকে একজন উদ্ভাবনী শক্তিসম্পন্ন রাষ্ট্রনায়ক। যে উদ্ভাবনা এখন স্বীকৃতি পেয়েছে ‘দ্য শেখ হাসিনা ইনিশিয়েটিভ’ নামে। কমিউনিটি ক্লিনিককে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়ার স্বীকৃতিস্বরূপ যুক্তরাষ্ট্রের ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘বিশেষ সম্মাননায়’ ভূষিত করা হয়। সেই সাথে তিনি নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়ে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন যা জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যের গুরুত্বপূর্ণ পঞ্চম লক্ষ্যের মূলকথা। জাতিসংঘের মহাসচিব হিসেবে এখন পর্যন্ত কোনো নারীকে নিয়োগ দেয়া হয়নি। এক্ষেত্রে নারী নেতৃত্ব দ্রুতই পাওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।

পুরো বিশ্ব আজকে অসহযোগিতা ও অসহনশীলতার দিকে ধাবিত হচ্ছে জা বিশ্বকে চরম বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিতে পারে, এই অমোঘ সত্য কথাটি শেখ হাসিনা অকপটে তুলে ধরেন। সাম্প্রতিক কালে গোটা বিশ্বে যে অর্থনৈতিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে,তার পরিপ্রেক্ষিতে একটি ন্যায় সংগত আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার কাজে আরও তড়িৎ ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে পারে যদি ঘতে সকলের মধ্যে মানবিক ঐক্যবদ্ধ-ভ্রাতৃত্ববোধের পুনর্জাগরণ। পারস্পরিক নির্ভরশীলতার স্বীকৃতিই কেবল বর্তমান সমস্যার যুক্তিসংগত সমাধান ঘটাতে সক্ষম।বর্তমান দুর্যোগ কাটাতে হলে অবিলম্বে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা দরকার। প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে রোহিঙ্গা সংকট, জলবায়ু পরিবর্তন, খাদ্য সংকট, নারীর ক্ষমতায়ন, স্বাস্থ্য সেবা, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি), সন্ত্রাসবাদ এবং সরকারের অন্তর্ভুক্তমূলক অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং অন্যান্য বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক সমস্যার কথা গুলো স্পষ্ট ভাষায় তুলে ধরেন। তার ভাষণে তিনি যুদ্ধের পথ পরিহার করে শান্তির পথ অনুসরণের আহ্বান জানান। মানবজাতির কল্যাণ ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য একযোগে কাজ করার গুরুত্ব তুলে ধরেন। যুদ্ধ ও সংঘাতের পথ কখনই কাম্য নয়, বরঞ্চ জনগণ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য স্থায়ী শান্তি,মানবজাতির কল্যাণ এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য সম্মিলিতভাবে কাজ করার মধ্যেই নিহিত আছে বৈশ্বিক সকল সমস্যার সমাধান। সেই সাথে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্ব্যর্থহীন ভাবে ঘোষণা করেন,বাংলাদেশে সংবিধানের আলোকে গণতন্ত্র,আইনের শাসন ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত হয়ে আসছে, ভবিষ্যতেও হবে।

মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধা ও মমত্ববোধের ক্ষেত্রে শেখ হাসিনা তার যোগ্য পিতার যোগ্য কন্যা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর পদাঙ্ক অনুসরণ করে প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনাও প্রতিবারই সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলায় বক্তব্য দিয়েছেন।বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনা ছাড়া আর কোনো রাষ্ট্রনায়ক বাংলা ভাষায় কখনো বক্তব্য রাখেন নি।বিএনপি দেশপ্রেমের কথা বলে অথচ বেগম খালেদা জিয়া ১০ বছরের ক্ষমতায় থাকাকালীন তিনবার জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগদান করেন।তিনি একবারের জন্যও বাংলায় ভাষণ দেননি। এছাড়া জিয়াউর রহমান, হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদ ও ড.ফখরুদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশের পক্ষে জাতিসংঘে প্রতিনিধিত্ব করেছেন, তারাও একটি বারের জন্যও বাংলায় ভাষণ দেননি। প্রধানমন্ত্রীর প্রতিটি ভাষণের মাধ্যমে বাংলা ভাষা বিশ্বমঞ্চে সম্মানিত হয়েছে, আমরা পেয়েছি বৈশ্বিক বিভিন্ন সমস্যার যথা উপযুক্ত সমাধান, আলোর পথের দিশা। ক্ষণস্থায়ী এই পৃথিবীতে কেউই চিরকাল থাকবেনা। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করার অনন্য রেকর্ড গড়ার মাধ্যমে নিজেকে করে তুললেন চির স্মরণীয়, সেই সাথে হাজারো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জন করে নেওয়া আমাদের মাতৃভাষা বাংলাকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেলেন। একদিকে তিনি জাতিসংঘে সর্বাধিক ভাষণ দেওয়া ব্যক্তিত্ব, অন্যদিকে প্রতিটি ভাষণই ছিল বাংলায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আগে জাতিসংঘে ১৬ বার বক্তব্য দেওয়ার রেকর্ড করেছিলেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ। সেদিক থেকে জাতিসংঘে সর্বাধিক সংখ্যক বার ভাষণ দেওয়ার রেকর্ড একমাত্র শেখ হাসিনার। এমন রেকর্ড উন্নত কিংবা উন্নয়নশীল দেশের আর কোনো সরকার প্রধান অর্জন করতে পারেনি। শেখ হাসিনার গৌরবগাথা অব্যাহত থাকুক, বিংশতিতম ভাষণের অপেক্ষায় থাকবে বাংলাদেশ।

লেখক: ট্রেজারার, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সাবেক চেয়ারম্যান, ট্যুরিজম অ্যান্ড হস্পিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সারাবাংলা/এসবিডিই

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া মত-দ্বিমত শেখ হাসিনা: বিশ্বমঞ্চে নিপীড়িত মানুষের চির আকাক্সিক্ষত কণ্ঠস্বর

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর