কেমন হলো নির্বাচন?
৯ জানুয়ারি ২০২৪ ১৪:৫৫
কেমন হলো নির্বাচন? এমন প্রশ্নের উত্তরে শোণা গেল-ফ্রি, ফেয়ার, ট্রান্সপারেন্ট, প্রফেশনালি ওয়েল অর্গানাইজড -অবাধ, সুষ্ঠু, স্বচ্ছ, এবং পেশাদারিত্বের সঙ্গে নিখুঁত আয়োজন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষণে আসা বিভিন্ন দেশের ও সংস্থার পর্যবেক্ষক ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের মূল্যায়ন এটি। এরই মধ্যে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে, প্রিন্ট ও সোশ্যাল মিডিয়ায় বিদেশী পর্যক্ষেকদের এসব মন্তব্য সবাই শুণেছেন, জেনেছেন। ৩৪ দেশের ও সংস্থার ১২৭ জন পর্যবেক্ষক ও বিশেষজ্ঞ এবং বিভিন্ন দেশের ও আন্তর্জাতিক মিডিয়ার ৭৬ জন সাংবাদিক এবারের নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেছেন। রাষ্ট্রীয়, প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তিগত–এই তিন শ্রেণিতে বিদেশি পর্যবেক্ষকরা নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেছেন। এদের মধ্যে রাশিয়া, ভারত, মরিশাস ও শ্রীলঙ্কার নির্বাচন কমিশনের প্রতিনিধি ছিলেন। তারা অবাধে নিজেদের ইচ্ছামতো বিভিন্ন কেন্দ্র পরিদর্শন ও ভোটপ্রদান প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করেছেন। শুধু ঢাকার বিভিন্ন কেন্দ্রই নয় তারা নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, গাজীপুর, সীতাকুন্ডসহ বিভিন্ন জেলায় তারা নিজেদের ইচ্ছে মতো স্বাধীনভাবে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেছেন। জাপানের সাংবাদিকরা এক প্রশ্নের জবাবে বলেছেন তারা এই নির্বাচনকে ১০০ তে ৯০ দিবেন। সব নির্বাচন পর্যবেক্ষকই বলেছেন নির্বাচন হয়েছে অবাধ,স্বচ্ছ এবং নিরপেক্ষ। তারা দেখেছেন ভোটাররা স্বত:স্ফুর্তভাবে ভোটকেন্দ্রে এসেছেন এবং নিজের ইচ্ছেমতো ভোট দিয়েছেন। পরিবেশ শান্তিপূর্ণ ছিল। সহিংসতা,অনিয়মের ঘটনা তারা দেখতে পাননি। সবাই পেশাদারিত্বের সঙ্গে নির্বাচন আয়োজনের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। একজন মার্কিন নির্বাচন বিশেষজ্ঞ মিডিয়ার এক প্রশ্নের জবাবে জানিয়েছেন তারা নির্বাচনের প্রসেস পর্যবেক্ষণ করছেন। কোন দল নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে বা নিচ্ছেনা কিংবা কতজন ভোটার ভোট দিচ্ছেন সেটি তারা দেখছেন না। তারা তাদের পর্যবেক্ষণ নির্বাচনের যে প্রসেস দেখেছেন সেটি আন্তর্জাতিকমানের। জানান বাংলাদেশ এ নিয়ে গর্ব করতে পারে। রাশান প্রতিনিধি দল জানিয়েছে বাংলাদেশের নির্বাচন দেখে তারা অভিভূত।
বিএনপির নির্বাচন বয়কট প্রসঙ্গে এক ইউরোপীয় পর্যবেক্ষক জানান অগতান্ত্রিক, অসাংবিধানিক, অবাস্তব দাবী নিয়ে অনড় না থেকে সূষ্টু নির্বাচন আয়োজনের ব্যাপারে কথা বলা উচিত ছিল। পৃথীবিতে এক পাকিস্তান ছাড়া আর কোথাও কেয়ারটেকার সরকার নেই। আর মানুষ ভর্তি বাস, ট্রেনে আগুন দিয়ে মানুষ পোড়ানো কোনভাবেই গ্রহনযোগ্য নয়। তিনি নিজে ট্রেনের আগুন দেখে মর্মাহত হয়েছেন।
মিডিয়ার আরেক প্রশ্নের জবাবে এক মার্কিন পর্যবেক্ষক বলেছেন ভোটের হার নিয়ে তিনি কোন মন্তব্য করতে চান না। সেটি ১% বা ২%ও হতে পারে। কারণ ভোট দেয়া এবং না দেয়া দুটিই মানুষের গণতান্ত্রিক অধকার। নিজস্ব সিদ্ধান্ত। ভোটের হার নয় ভোটের প্রসেসটি মূখ্য বিষয়। ভোট অবাধ, স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ, শান্তিপূর্ণ হচ্ছে কিনা সেইটিই দেখার বিষয়। তিনি বলেন লো ভোটকাস্ট রেট নিয়ে অনেকেই ইস্যু তৈরি করতে পারে। এধরণের বিষয়ের জন্য মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার মিডিয়ার পিছনে খরচ করা হয় বিশ্বজুড়েই।
অস্ট্রেলিয়া ও নরওয়ের দুই পর্যবেক্ষক জানালেন সকালে যখন তারা পরিদর্শন শুরু করেন তখন ভোটার সংখ্যা কম দেখেছেন। দুপুরে বিভিন্ন কেন্দ্রে যখন গেছেন তখন দেখেছেন ভোটার সংখ্যা বাড়ছে। দিনের শেষ দিকে কেন্দ্রগুলোতে অনেক ভোটার আসতে দেখেছেন। তারা জানান ভোটার সংখ্যা নয় ভোটের প্রসেস ও পরিস্থিতির দিকেই তাদের পর্যবেক্ষণ ছিল।
ইউরোপীয় এক পর্যবেক্ষক এক প্রশ্নের জবাবে জানান বড় একটি দল নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেনা এতে হয়তো ভোটের হার কম হবে কিন্তু ইউরোপের অনেক দেশের নির্বাচনেই ২৫% ভোট পড়ে না। ভোটার নিজের ভোটটি ইচ্ছে মতো দিতে পারছেন কিনা? সেই পরিবেশ আছে কিনা সেটিই দেখার বিষয়। তার মতে বাংলাদেশের নির্বাচনটি তার ধারণার চেয়েও শান্তিপূর্ণ, স্বচ্ছ ও অবাধ হয়েছে।
বিদেশী অনেক পর্যবেক্ষক স্বচ্ছতার জন্য ছবিসহ ভোটার লিস্ট ও হাতে অমোচনীয় কালি দেয়ার ব্যাপারটি দেখে অবাক হয়েছেন। পর্যবেক্ষকরা ভোটারদের সঙ্গেও কথা বলেছেন। তাদের মতামত জেনেছেন। ভোট কেন্দ্র দেখতে আসা কয়েকজন ইউরোপীয় পর্যবেক্ষক ও সাংবাদিকের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। জানতে চেয়েছেন ভোট দিয়েছি কিনা? পরিবারে ভোটার কয়জন। তারা ভোট দিয়েছে কিনা? ভোট দিতে গিয়ে কোন সমস্যা হয়েছে কিনা? ভোটের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আমার মতামত কি? সাংবাদিক পরিচয় জেনে অন্যদের চেয়ে বাড়তি জানতে চাইলেন বড় একটি দল কেন ভোটে আসেনি সে ব্যাপারে আমার মতামত। এভাবে তারা শুধু নির্বাচন পর্যবেক্ষণই করেননি নির্বাচন নিয়ে তাদের অন্যান্য প্রয়োজনীয় তথ্যও জেনে নিয়েছেন সাধারণ মানুষের কাছ থেকে।
এই বিদেশী পর্যবেক্ষক ও সাংবাদিকরা বাংলাদেশের দ্বাদশ সাধারণ নির্বাচনের ব্যাপারে একটি স্বচ্ছ ইতিবাচক ধারণা পেয়েছেন। বিভিন্ন দেশি-বিদেশী প্রচার প্রচারণা থেকে তারা আগাম যে ধারণা পেয়েছিলেন তার চেয়ে অন্যরকম ধারণা পেয়েছেন তারা বাংলাদেশ, বাংলাদেশের রাজনীতি ও নির্বাচনের ব্যাপারে।
মাইলস্টোন নির্বাচন
আমাদের নির্বাচনের ইতিহাসে এবারের নির্বাচনটিকে মাইলস্টোন নির্বাচন বলা যেতে পারে। দেশি-বিদেশী নানামুখী প্রবল চাপ মোকাবেলা করে এই নির্বাচন করতে হয়েছে। অবাধ সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনের দায়বদ্ধতা ছিল। ট্রেনে-বাসে আগুণ দিয়ে যেভাবে জীবন্ত মানুষ পোড়ানো হয়েছে সেসব ভয়কে উপেক্ষা করে মানুষ ভোটকেন্দ্রে আসবে কিনা তা নিয়ে শংকা ছিল। কঠিন ছিল এইসব পরিস্থিতি সামাল দেয়া এবং সব ধরণের চাপ প্রতিকূলতাকে মোকাবেলা করে একটি ভাল নির্বাচন আয়োজন করতে পেরেছে নির্বাচন কমিশন। সব পক্ষ চাইলে কোন সরকারের আমলেও যে নির্বাচন কমিশন কঠোরভাবে ক্ষমতা প্রয়োগ করে ভাল নির্বাচন করতে পারে তার উদাহরণ হয়ে রইলো এবারের নির্বাচন। বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাসে সবচেয়ে কম সহিংসতার নির্বাচন হয়েছে এবার। ২৯৯টি আসনের জন্য ৪২ হাজার ১৪৯টি সেন্টারে ২ লক্ষ ৬২ হাজার পোলিংবুথের মধ্যে ১৫টি ক্ষেত্রে অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। ৩৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অনিয়মের অভিযোগ পেয়েই ২টি সেন্টারের ভোট গ্রহণ স্থগিত করা হয়। নির্বাচনী আচরণ বিধি লঙ্ঘন করে অসাদাচারণের দায়ে সরকার দলীয় এক প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল করা হয়েছে। এক মন্ত্রীর ভাইয়ের বিরুদ্ধে মামলা করে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। নির্বাচনের আগে আচরণবিধি ভঙ্গের ঘটনা নজরদারির জন্য তিন শতাধিক টিম কাজ করেছে ম্যাজিস্ট্রেটদের নেতৃত্বে। নির্বাচন কমিশন আচরণবিধি ভঙ্গের জন্য বাঘা বাঘা হেভিওয়েট প্রার্থীদেরকে তলব করে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। জরিমানা করেছে। নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গের অভিযোগে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, স্বতন্ত্র প্রার্থীসহ তাদের সমর্থকদের ৫৮৯টি শোকজ ও তলব নোটিশ দিয়েছে নির্বাচনী অনুসন্ধান কমিটি। গণহারে ডিসি,ওসি বদলি করেছে। প্রশাসনের যার বিরুদ্ধেই অভিযোগ উঠেছে এবং সত্যতা মিলেছে তাকেই সরিয়ে দেয়া হয়েছে। এসব অনেক কিছুই বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম ঘটনা। নতুন নজীর। প্রধানমন্ত্রী প্রথম থেকেই বলেছেন এবারের নির্বাচন হবে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ। প্রধান নির্বাচন কমিশনারও বার বার প্রতিশ্রুতি দেন শান্তিপূর্ণ অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের। শেষ পর্যন্ত কাংখিত মানের সেই নির্বাচনটি হয়েছে। বিদেশী পর্যবেক্ষকরা এই নির্বাচনকে আন্তর্জাতিক মানের নির্বাচন হিসেবে প্রশংসা করেছেন। সবপক্ষ চাইলে কোন সরকারের অধীনেও যে নির্বাচন কমিশন সূষ্ঠু নিরপেক্ষ শান্তিপূর্ণ নির্বাচন আয়োজন করতে পারে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন তার একটি উদাহরণ হয়ে থাকবে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এটি একটি মাইলস্টোন নির্বাচন হিসেবে বিবেচিত হবে।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, সংবাদ বিশ্লেষক
সারাবাংলা/এসবিডিই