খেয়ালের সুনিপুণ এক মহান শিল্পীর প্রয়াণ
১৫ জানুয়ারি ২০২৪ ১৪:১৬
শাস্ত্রীয় সংগীতের তালিম নিতে শুরু করেছিলাম শৈশবেই। কিন্তু শাস্ত্রীয় সংগীতের অন্যতম গায়নশৈলী খেয়াল আমার মনে কোনো আগ্রহ জানাতে পারেনি। বরং বলা চলে খেয়াল নিয়ে বিরক্তিই ছিল আমার মধ্যে। তবু শিখতে হয়েছে, সেটি করেছি মনের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই। স্কুলের গণ্ডি পার হওয়ার পরও খেয়ালের প্রতি ভালো লাগা তৈরি হয়নি। ওস্তাদ শেখ বদিউজ্জামান, ওস্তাদ কাজী সুলতান মাহমুদের কাছে তালিম নেওয়ার পর খেয়াল-ধ্রুপদের তালিম নেওয়ার জন্য গেলাম অধ্যাপক ড. অসিত রায়ের কাছে। সেখানেই প্রথম পরিচয় এক অদ্ভুত কণ্ঠস্বরের সঙ্গে। খেয়ালের সঙ্গে সম্পর্ক বদলের যাত্রাও শুরু ওই কণ্ঠস্বরের মাধ্যমে।
প্রথম যে খেয়ালটি শুনেছিলাম সেটি ছিল রাগ মধুবন্তীর বড় খেয়াল। মুখড়া হলো ‘তোরে গুণ গাউঁ’, ছোট খেয়ালের মুখড়া ‘উন সোঁ মোরি লগন লাগি রে’। খেয়ালও যে এরকম হয়, তা এই বন্দিশ শোনার আগে আমার জানা ছিল না। ঠিক তখনই মনে হলো— এ রকম খেয়াল আমাকে গাইতেই হবে। শুরু করলাম গুরুর তালিম অনুযায়ী চর্চা।
তখনো সংগীতের বেশির ভাগ পরিভাষাই (মিউজিক টার্মিনোলজি) আমার জানা-বোঝার বাইরে। তাই যে গানটি আমার মনপ্রাণ জয় করছে, কীভাবে তার প্রশংসা করব বুঝতাম না। শুধু বুঝতাম, এই গান আমাকে টানছে। আমি রোজ তার প্রেমে পড়ছি। খেয়াল গায়নশৈলীর বেলায় সেটিই আমার প্রথম প্রেম, যে অসাধারণ গায়নশৈলীর অধিকারী সদ্যপ্রয়াত ওস্তাদ রাশিদ খান (বাঙালিদের মধ্যে রশিদ খান হিসেবে প্রচলিত)।
আরও পড়ুন- চলে গেলেন ধ্রুপদী সংগীতের উজ্জ্বল নক্ষত্র ওস্তাদ রশিদ খান
রাশিদ খানের রেকর্ড শুনতে শুনতেই তার সম্পর্কে জানতেও শুরু করি। উত্তরপ্রদেশে জন্ম হলেও ১০ বছর বয়সেই নানার সঙ্গে চলে আসেন কলকাতায়। আমৃত্যু কলকাতাতেই থেকেছেন। কলকাতার প্রতি বিশেষ টান ছিল তার। প্রোস্টেট ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ায় শেষ দিকে মুম্বাইয়ের টাটা মেমোরিয়ালে তাকে ভর্তি করা হয়েছিল। কিন্তু রাশিদ খান বলেছিলেন, যদি মৃত্যুও হয়, শেষ নিঃশ্বাস কলকাতাতেই ফেলতে চান। তার ইচ্ছা অনুযায়ীই তাকে কলকাতায় নিয়ে আসা হয়েছিল। সেখানেই গত ৯ জানুয়ারি তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন।
রাশিদ খানের রেকর্ডের সূত্র ধরেই খেয়ালের প্রতি যে ভালো লাগা তৈরি হলো, তা ক্রমেই ভালোবাসাতেও রূপ নেয়। ধরে ধীরে বুঝতে পারি রাশিদ খানের খেয়াল পরিবেশনের জাদু। রাগের আলাপ শুরু করতেন মধ্য সপ্তকের ষড়জের আশপাশের কোনো স্বর থেকে। সঙ্গে বাজাতেন সুরমণ্ডল (স্বরমণ্ডল নামেও পরিচিত)। তার কণ্ঠে ছিল অদ্ভুত এক আকর্ষণ, যে কারণে সুর লাগানোর সঙ্গে সঙ্গেই শ্রোতাদের মন ছুঁয়ে যেত। ছোট আলাপ করেই শুরু করতেন বড় খেয়াল। স্থায়ী শেষ করে গাইতেন বিস্তার। কী অসাধারণ বিন্যাস, স্বরসঙ্গতি আর রাগদারি।
মূলত কিরানা ঘরানার ঢংয়ে রাগের বিস্তার করতেন রাশিদ খান। ওস্তাদ আমীর খাঁ আর পণ্ডিত ভীমসেন যোশীর প্রভাব ছিল তার ওপর। ফলে বিস্তারের অংশটুকু ছিল পাহাড়ের মতো অনড়। তবে নিজস্ব কিছু হরকতও তিনি খুব সুস্পষ্টভাবেই প্রয়োগ করতেন দেখা যেত তার বিস্তারে। বিভিন্ন ধরনের অলংকার যেমন— খটকা বা মুরকির ব্যবহারও রাশিদ খানের বিস্তারে অত্যন্ত সুস্পষ্ট। আগেও অনেকে এ ধরনের অলংকার খেয়ালে প্রয়োগ করেছেন। কিন্তু খেয়াল গায়নশৈলীর মেজাজ পুরোপুরি বজায় রেখে এত সূক্ষ্মভাবে ছোট ছোট অলংকার প্রয়োগ খুবই কম দেখা যায়।
রাশিদ খানের খেয়ালে এরপর শুরু হতো তানকারি। তান শব্দটি অনেক প্রাচীন। সাধারণ অর্থে তান বলতে সুর বা রাগের বিস্তার বোঝানো হয়। কিন্তু খেয়ালে তান বলতে স্বরগুলোকে অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে পরিবেশন করানোকেই বোঝানো হয়। রাশিদ খানের খেয়ালে বিস্তার যেমন ধীর-স্থির, ঠিক তেমনি তার তানও ঝড়ের মতো। সেই তানের ঝাপটায় যেন শ্রোতাকে সুরের সাগরে ভাসিয়ে নিয়ে যান অন্য এক জগতে। সবকিছু মিলিয়েই রাশিদ খানের পরিবেশন করা খেয়াল এক অন্যরকম দ্যোতনা তৈরি করে। আর সে কারণেই তার গান সংগীতজ্ঞ বা বিজ্ঞ শ্রোতারা যতটা উপভোগ করতেন, শাস্ত্রীয় সংগীতের সঙ্গে তেমন পরিচয় না থাকা শ্রোতাদের কাছেও তেমনি তার গান ততটাই উপভোগ্য হয়ে ওঠে।
শুধু খেয়াল নয়, ঠুমরি বা দাদরা গানগুলোও অসামান্য দক্ষতায় পরিবেশন করতেন রাশিদ খান। তারও গুরু যারা ছিলেন, তারা সবাই শাস্ত্রীয় সংগীতের এসব প্রকরণ পরিবেশনের সময় শাস্ত্র প্রয়োগের দিকেই যতটাসম্ভব মনোনিবেশ করতেন। তবে রাশিদ খান এর সঙ্গে আবেগকেও যুক্ত করে নিয়েছিলেন। খেয়ালের আলাপেও আবেগের বহিঃপ্রকাশ দেখিয়েছেন তিনি। কখনো বান্দিশের যে বাণী, সেই বাণীর অর্থ পরিস্ফূট করতেও আবেগের সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন। রাশিদ খানের ভাষায়, যে পরম সত্তার জন্য তিনি সংগীত পরিবেশন করেন, সেই পরম সত্তাই তাকে বলে দেয় ঠিক কোন সময়টিতে আবেগকে তিনি প্রয়োগ করবেন।
রামপুরা-সহসওয়ান ঘরানার শিল্পী ছিলেন রাশিদ খান। এই ঘরানার প্রতিষ্ঠাতা তারই পূর্বপুরুষ ইনায়েত হুসেইন খান। এই ঘরানার শেষ জীবন্ত কিংবদন্তি বাহক বলা হতো রাশিদ খানকে। সংগীত তার কাছে ছিল ইবাদতের মতো। সুখের মতো দুঃখকেও জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলেই মনে করতেন। দ্য হিন্দুকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘সংগীত আমার কাছে সর্বশক্তিমানের কাছে নিবেদিত নৈবেদ্যর মতো। আর জীবন সেই পরমাত্মার দ্বারাই নির্ধারিত। তিনি যা কিছু দিয়েছেন, তা নিয়েই আমি পূর্ণ। সুখের মতো দুঃখও জীবনের একটি অংশ। বরং দুঃখের ছোঁয়ায় সংগীত পরিবেশন আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।’
সহজ কথায় বলতে গেলে, এত সুন্দর কণ্ঠে সুনিপুণ কারুকাজ ও অলংকরণসহ খেয়াল গাওয়ার প্রচলন ওস্তাদ রাশিদ খানের হাত ধরেই। পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন মহান এই সংগীতশিল্পী। কিন্তু রেখে গেলেন তার গায়নশৈলী আর কোটি কোটি অনুরাগী। তার গায়নশৈলী এতই আধুনিক যে হাজার বছর পরও এই গায়কী সংগীত শিক্ষার্থীরা অনুসরণ করবে।
লেখক: সংগীতশিল্পী এবং সহকারী অধ্যাপক, সংগীত বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
সারাবাংলা/টিআর