মিশন ২০৪১: আমিই সল্যুশন— কেমন হবে আগামীর স্মার্ট পরিবেশ
১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ২০:৩৭
টাইম মেশিনে চড়ে ভবিষ্যতের বাংলাদেশে গিয়ে দেখলেন, গ্যাস মাস্ক পরা মানুষজন ঘুরছে। শ্বাস নিতে গিয়ে শিশু থেকে বৃদ্ধ সবাই হাঁপিয়ে উঠছে। বিশুদ্ধ পানির জন্য করছে হাহাকার। সুজলা-সুফলা চিরসবুজ বাংলার মাটি ফেটে চৌচির। আবার অতিবৃষ্টি ও বন্যায় ভিটেমাটি ছাড়া হচ্ছে মানুষ। ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়ছে মানুষের জনজীবন ও অর্থনীতি। ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসসহ নানাবিধ প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিত্যনতুন আতঙ্ক ছড়াচ্ছে।
টাইম মেশিনে হোক অথবা ঘুমের মাঝে কিংবা কল্পনায়— আপনি কি ভবিষ্যতে এমন বাংলাদেশ দেখতে চান? না, একদমই না। আর সেটি না চাইলে, ভবিষ্যত বদলাতে হলে এখনই আমাদের কাজে নেমে পড়তে হবে। এমন প্রাণ-প্রকৃতি বিনাশী ধূসরের বিরুদ্ধে আমাদের সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। আর তাই প্রাণ-প্রকৃতিতে সমৃদ্ধ অপার সম্ভাবনাময় উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশের জন্য স্মার্ট পরিবেশ নিশ্চিত করা হবে।
প্রাকৃতিক পরিবেশকে দূষণের হাত থেকে রেহাই দিলেই ভালো থাকবে পরিবেশ। প্রশ্ন জাগতেই পারে— প্রকৃতির দূষণ না করে বাংলাদেশ উন্নত হবে কীভাবে? উন্নত হতে হলে তো দেশে শিল্পায়ন ঘটবে। শিল্প-কারখানা হলে তো অবধারিতভাবে দূষণ হবে।
এ প্রসঙ্গেই আসে টেকসই উন্নয়নের আলাপ, যেখানে প্রাধান্য থাকবে পরিবেশের। এটা সত্য, শিল্প-কারখানা থেকে উৎপাদিত বিভিন্ন উপজাত পদার্থ ও বর্জ্য পরিবেশকে দূষিত করে। কিন্তু শিল্প-কারখানার উৎপাদন প্রক্রিয়াকে তো আমরা পরিবেশবান্ধব করতে পারি। উৎপাদিত বর্জ্যকে পরিশোধন ও উপজাত পদার্থগুলোকে পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে এই সমস্যার টেকসই সমাধান করা সম্ভব। নিত্যনতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও বিদ্যমান প্রযুক্তির ব্যবহার এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
আশাবাদের বিষয়, দেশের তরুণ প্রজন্ম এরই মধ্যে এ নিয়ে কাজ শুরু করেছে। তাদেরই উদ্ভাবন একটি ডিভাইস, যেটি চামড়া, বস্ত্র ও পোশাকসহ বিভিন্ন কারখানা থেকে নিসৃত বর্জ্যে থাকা লেড, ক্রোমিয়াম, সালফাইডসহ নানাবিধ দূষকের মাত্রা জানিয়ে দেবে। নদীসহ যেকোনো জলাশয়ের পানিতে স্থাপন করা যায় এটি। ডিভাইসটির মাধ্যমে যেকোনো জায়গায় বসেই স্মার্টফোনে মুহূর্তেই দূষণের মাত্রা জানতে পারবেন মালিক, সরকার, ক্রেতা বা পরিবেশবাদীরা। এর মাধ্যমে দেশের পানির উৎসগুলো ব্যবহার উপযোগী রাখার মাধ্যমে অপচয় রোধ করা সম্ভব হবে।
দূষণের মাত্রা তদারকির দেশীয় ও সুলভ এই কার্যকর ডিভাইসটি তৈরি করেছেন বাংলাদেশে তরুণ এম এইচ এম মাজেদুর রহমান। ডিভাইসটি এমনকি মাছের খামারের পানির দূষণও সঠিকভাবে বলে দিতে পারে। এরকম তরুণদের হাত ধরেই আসবে আমাদের পরিবেশ দূষণ ও রক্ষার সমাধান।
স্মার্ট পরিবেশ নিশ্চিতে আমাদের অপচয় বন্ধ করতে হবে। বিশেষত, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি। বর্তমানে সবুজ পরিবেশ নিশ্চিতে সারাবিশ্ব ঝুঁকছে দূষণমুক্ত পুনঃনবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে। বাংলাদেশও পিছিয়ে নেই। তারই এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত দেশের বৃহত্তম সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র তিস্তা সোলার পাওয়ার প্ল্যান্ট। গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে ৬৫০ একর পরিত্যক্ত চরের জমিতে গড়ে উঠেছে এই স্মার্ট প্রকল্প। পাঁচ লাখ ৫০ হাজার সোলার প্যানেলের ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতাসম্পন্ন এই কেন্দ্রটি যেন কোটি সূর্যের আলো ধারণ করে দেশকে আলোকিত করছে। এতে কমবে দূষণ, বাড়বে জ্বালানি নিরাপত্তা। পাশাপাশি ঘটবে আঞ্চলিক উন্নয়নও। সবমিলিয়ে তৈরি হয়েছে টেকসই ভবিষ্যতের ভিত্তি।
কিন্তু বাংলাদেশ তো ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যাসহ নানারকম প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ একটি দেশ। প্রকৃতিকে তো আর আমরা ঠেকাতে পারব না। তবে আমাদের অভ্যাসগুলোতে পরিবর্তন এবং বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি অনেকাংশে কমানো সম্ভব।
নদীমাতৃক ও বৃষ্টিবহুল বাংলাদেশে প্রতিবছরই বন্যার তাণ্ডবে ক্ষয়ক্ষতি ও দুর্ভোগের শিকার হয় কোটি মানুষ। এই হতাশার অন্ধকারে আশার আলো দেখিয়েছে ডিজিটাল পদ্ধতিতে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ ব্যবস্থা। পানি উন্নয়ন বোর্ড, এটুআই আর গুগলের যৌথ প্রচেষ্টায় ২০২০ সাল থেকে চালু হয়েছে এই অভিনব উদ্যোগ। কখন বন্যা আসছে, আগে মানুষ সঠিকভাবে বুঝে উঠতে পারত না। এই উদ্যোগের ফলে তিন দিন থেকে তিন ঘণ্টা আগে বন্যা শুরুর ঝুঁকি, পানির সম্ভাব্য বৃদ্ধি ও হ্রাস, কোন এলাকা ঝুঁকিতে, এমনকি সুরক্ষা পরামর্শ ও জরুরি সেবার নম্বর— এমন সব তথ্যই চলে আসে স্মার্টফোনে!
সতর্কবার্তার এক পুশ নোটিফিকেশনেই সতর্ক হয়ে উঠলেন আপনি। শুকনো খাবার, পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলেন। শুধু একটি ক্ষুদ্র পুশ নোটিফিকেশন কত কোটি জীবন, কত কোটি স্বপ্নকে বাঁচায়!
এখন পর্যন্ত দেশের ৫৫টি জেলার ৯৯টি বন্যাপ্রবণ উপজেলায় এই সেবা চালু রয়েছে। এর পাশাপাশি প্রান্তিক জনসাধারণের কাছে পৌঁছাতে এসএমএস পদ্ধতি তো রয়েছেই। এই সেবা আরও উন্নত করতে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধগুলোর তথ্য সংগ্রহ চলছে। ব্যবহার করা হচ্ছে ডেটা অ্যানালিটিক্স, আধুনিক কম্পিউটেশন পদ্ধতি ও ডেটা মডেল।
শুধু দুর্যোগ প্রস্তুতির উদ্যোগ নিয়েই স্মার্ট পরিবেশ বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি ও দুর্যোগের ঝুঁকি দিন দিন আরও বাড়ছে। বিশ্বের বৃহত্তম ব-দ্বীপ বাংলাদেশে দুর্যোগ মোকাবিলা ও পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনায় নেওয়া হয়েছে ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০।
ব-দ্বীপ পরিকল্পনা হলো জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় একটি সমন্বিত পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা। এই পরিকল্পনায় শুধু পানি ব্যবস্থাপনা নয়, ভূমি ব্যবস্থাপনা, স্মার্ট বা জলবায়ুবান্ধব নগর পরিকল্পনা, অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন এবং নদীভিত্তিক পরিবহন, সুনীল অর্থনীতি ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির মতো বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। বিগত ৫০ বছরের পরিবেশ ও জলবায়ুর তথ্য সংগ্রহের পাশাপাশি ১০০টি আবহাওয়া কেন্দ্রও বসানো হয়েছে এই উদ্যোগের আওতায়। এই তথ্যগুলো বিশ্লেষণ করে একটি দীর্ঘমেয়াদি অভিযোজনভিত্তিক পরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে। ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ বাস্তবায়িত হলে এটি জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হবে।
স্মার্ট পরিবেশ নিশ্চিতে আমাদের অন্যতম একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো সামুদ্রিক পরিবেশের দূষণ কমানো। সমুদ্র বিজয়ে প্রাপ্ত এক লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার সমুদ্র এলাকার ৭১০ কিলোমিটার উপকূলজুড়ে কম-বেশি মানব কর্মকাণ্ড বিদ্যমান। সামুদ্রিক দূষণের জন্য মানবসৃষ্ট কারণগুলোই সবচেয়ে বেশি দায়ী হিসেবে বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে। স্থল উৎস থেকে বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ ও অপচনশীল অজৈব আবর্জনা এসে সমুদ্রে মিশে যায়। ফলে সামুদ্রিক পরিবেশ, সব জীবের স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক কাঠামোর ক্ষতি হয়।
দূষক পদার্থের উপস্থিতির কারণে সামুদ্রিক বাস্তুসংস্থান বিনষ্ট হওয়ার পাশাপাশি অজৈব পদার্থ, যেমন— প্লাস্টিকের ক্ষুদ্র কণাকে মাছ খাবার ভেবে গ্রহণ করে, যা পরে আমাদের খাদ্যচক্রের অংশ হয়ে যায়। সামুদ্রিক পরিবেশের ওপর যেকোনো ধরনের নেতিবাচক প্রভাব শুধু প্রাণিকূলের স্বাস্থ্যই নয়, স্থানীয় মৎস্যজীবী ও পর্যটন শিল্পকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (বিওআরআই) বিজ্ঞানীদের সাম্প্রতিক গবেষণায় বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলের পানি ও মাটিতে দূষক পদার্থের উপস্থিতি ছাড়াও সামুদ্রিক মাছের শরীরে মাইক্রোপ্লাস্টিকের (৫ মিলিমিটার ব্যাসের চেয়ে ছোট প্লাস্টিক কণা) উপস্থিতি পাওয়া যায়, যা সামুদ্রিক জীব তো বটেই, মানবস্বাস্থ্যের জন্যও ভয়ংকর বিপদসংকেত। সামুদ্রিক দূষণ কমানোর সমাধানগুলোর মধ্যে রয়েছে দূষণ প্রতিরোধের স্মার্ট উপায় নিরূপণে বিস্তর গবেষণা, নিয়মিত সৈকত পরিচ্ছন্নতা অভিযান পরিচালনা এবং ব্যাপক জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ।
স্মার্ট ও উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণে সুনীল অর্থনীতির উন্নয়ন যেমন খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি সমুদ্র স্বাস্থ্য সুরক্ষায় দূষণমুক্ত স্মার্ট সামুদ্রিক পরিবেশ তৈরি অপরিহার্য। স্মার্ট সামুদ্রিক পরিবেশ বাস্তবায়নে বিওআরআই সরকারের নির্বাচনি ইশতেহার, প্রেক্ষিত পরিকল্পনা, ব-দ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০ ও এসডিজি-১৪-এ উল্লেখ লক্ষ্য অনুযায়ী আধুনিক প্রযুক্তি সম্বলিত বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি দ্বারা গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। গবেষণালব্ধ ফলাফলের যথাযথ প্রয়োগ ও সকলের সমন্বিত প্রচেষ্টায় এটি অর্জন করা সম্ভব হবে বলে আমরা আশাবাদী।
স্মার্ট পরিবেশ বাস্তবায়নে প্রযুক্তিই একমাত্র সমাধান নয়। মানুষের চেতনাতেও পরিবর্তন দরকার। যেমন— প্রচুর গাছ লাগানোর পাশাপাশি ২০-৩০ বছর বয়সী বৃক্ষগুলোকে আগলে রাখতে হবে। কেননা এরাই কার্বন শোষণের মহামন্ত্র। ছাদ-বাগানের ছায়ায় শীতল হবে পরিবেশ, কমবে বিদ্যুৎ খরচ। দেশের প্রতিটি নাগরিককে পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে সচেতন করতে হবে। সবার অংশগ্রহণে এই ছোট ছোট পদক্ষেপগুলোই বয়ে আনবে ইতিবাচক ফলাফল।
দেশের পাশাপাশি বৈশ্বিক পরিমণ্ডলেও বাংলাদেশ কাজ করছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক চুক্তি ও নীতিমালা বাস্তবায়ন এবং বৈশ্বিক পরিবেশ আন্দোলনে সক্রিয় হয়ে জনমত গঠনে আরও ভূমিকা রাখবে। মাত্র শূন্য দশমিক চার শতাংশ কার্বন নিঃসরণ করেও বৈশ্বিক জলবায়ুর পরিবর্তনের বিরাট অর্থনৈতিক, সামাজিক ও প্রতিবেশগত ক্ষতি আমাদের বহন করতে হচ্ছে। আমাদের মতো দেশগুলোকে সঙ্গে নিয়ে এই ক্ষতির বিষয়ে সোচ্চার হয়ে ক্লাইমেট জাস্টিস নিশ্চিত করা হবে। পৃথিবী এখন এক, আর তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সবারই একসঙ্গে কাজ করা চাই।
২০৪১ সাল অনেক দূরে মনে হলেও এই স্মার্ট পরিবেশ ও স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার কাজ এরই মধ্যে শুরু হয়েছে। প্রযুক্তির হাত ধরে, সচেতনার আলো জ্বেলে আমরা এগোব। নির্মাণ করব এক সুন্দর, টেকসই বাংলাদেশ। প্রতিটি বাড়ি, প্রতিটি পাড়া, প্রতি জেলায় আমাদের উদ্যোগগুলো রাখবে সাফল্যের ছাপ। লিখবে সুস্থ, নিরাপদ, সবার বাসযোগ্য এক পৃথিবীর গৌরবময় ইতিহাস।
লেখক: অধ্যাপক, মেট্রোলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সারাবাংলা/টিআর