বাইডেনের চিঠি, স্যাংশন জুজুকারীদের মাথায় বজ্রাঘাত
৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৬:১৮
গত ৪ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চিঠি লিখে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক লক্ষ্য অর্জনে সহযোগিতা করার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিশ্রুতিবদ্ধ জানিয়ে তিনি চিঠিতে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের উচ্চাভিলাসী অর্থনৈতিক সমর্থন করে। আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, জলবায়ু পরিবর্তন ও জ্বালানি, বৈশ্বিক স্বাস্থ্য, মানবিক সহায়তা বিশেষ করে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য কাজ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। এর আগে গত ১৮ জানুয়ারি জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্থনি গুতেরেস প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়ে চিঠি পাঠিয়েছেন। চিঠিতে মহাসচিব বলেছেন, ‘পুনরায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ায় আপনাকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। জাতিসংঘ বাংলাদেশের সঙ্গে থাকা সম্পর্ককে গভীরভাবে মূল্যায়ন করে। যার মধ্যে রয়েছে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশন, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রতি উদারতা এবং একটি টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা। গ্লোবাল ক্রাইসিস রেসপন্স গ্রুপে আপনার উপস্থিতি ও আপনার ওপর থাকা বিশ্বাসকে আমি সাধুবাদ জানাই। আমি আশা করতে পারি, বৈশ্বিক সমস্যা গুলোতে আপনাকে পূর্বের ন্যায় পাব। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের স্বার্থে জাতিসংঘ আপনার সরকারের সাথে কাজ করতে বদ্ধপরিকর। ‘গত ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পর থেকে বিশ্বের পাওয়ার-সুপার পাওয়ার, ছোট-বড় প্রায় সকল দেশ ও সংস্থার পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়েছে। শুধু ব্যতিক্রম ছিল যুক্তরাষ্ট্র। অবশেষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের চিঠি আলোচনা-সমালোচনার টেবিলে জল ঢেলে দিয়েছে।
ভূ-রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক বিশ্বের আগ্রহ একটু বেশিই ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান বাড়াবাড়ির অবস্থায় পৌঁছেছিল। অন্যদিকে ভারত, চীন, রাশিয়া একই অবস্থান নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের পাশে দাঁড়িয়েছিল। মূলত এবারের নির্বাচনে বিদেশিরা যেসব বিষয় পর্যবেক্ষণ করেছে সেগুলো হলো -নির্বাচন প্রকৃয়া, ভোটার উপস্থিতি, ভোটারদের স্বাধীনতা ও সহিংসতা। এর প্রতিটি সুচকে বাংলাদেশ অত্যন্ত সফলতার সাথে অতিক্রম করেছে। নির্বাচন প্রকৃয়া নিয়ে বড় দাগে কেউ অভিযোগ করতে পারেনি। ভোটার উপস্থিতি সন্তোষজনক না হলেও আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে কম নয়। প্রায় বিয়াল্লিশ শতাংশ ভোটার ভোট দিয়েছে। ভোটারদের ভোট দানে সরকারি দল থেকে কোনো প্রভাব খাটানো হয়নি। যার কারণে ৬২ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছেন। আর অতীতের যেকোনো নির্বাচন থেকে এবারের নির্বাচনে সহিংসতা খুবেই কম হয়েছে।
বিদেশি প্রায় দুইশো জন পর্যবেক্ষক নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেছেন। তাদের বক্তব্যেও অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের কথা বলা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, আয়ারল্যান্ড, নরওয়ে ও জাপানের পর্যবেক্ষকরা যৌথ সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় সকল পর্যবেক্ষক একমত যে, বাংলাদেশের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন শান্তিপূর্ণ ও সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হয়েছে। আমরা যেসব কেন্দ্র পর্যবেক্ষণ করেছি, সেখানে ভোটারদের সাথে কথা বলে জেনেছি তারা আসার পথে কোনো বাধার সম্মুখীন হননি। কোনো প্রকার ভয়ভীতি দেখানো হয়নি। এটা গণতন্ত্র ও ভোটাধিকারের জন্য ভালো ইঙ্গিত। ’
বিগত দুই বছর ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচন নিয়ে অযাচিত কথা বলে আসছিল। তাদের আচরণ অনেক ক্ষেত্রে শিষ্টাচার বহির্ভূত ছিল। তাদের প্ররোচনায় বিএনপি সহ এক শ্রেণির তথাকথিত বুদ্ধিজীবিরা উজ্জীবিত হয়ে উঠেছিল। রাষ্ট্রদূত পিটার হাসকেই তারা ত্রাতা মনে করেছিল। বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে গত বছরের ৩ মে ভিসা নীতি ঘোষণা করে যুক্তরাষ্ট্র। তখন বিএনপিপন্থী আঁতেলরা ধরেই সরকার পতন সময়ের অপেক্ষা মাত্র। এজন্য তারা দিনক্ষণ ঠিক করে সরকার পতনের ঘোষণা দিয়েছিল। হুংকার দিয়ে বারবার বলেছিল, সরকার পালানোর পথ পাবেনা। নির্বাচনকে সামনে রেখে মার্কিন স্যাংশন ও ভিসা নিষেধাজ্ঞার জুজুকে হাতিয়ার করে রাজনীতির মাঠ গরম করে বিএনপি -জামায়াত জোট। সরকারের উপর নিষেধাজ্ঞা যাতে আসে সেজন্য তারা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করে লবিস্ট নিয়োগ করেছে।
সরকারকে চাপে রাখতেই নিষেধাজ্ঞার কৌশল নিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। এ চাপের একমাত্র কারণ সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন নয়। কারণ তারা যে অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বলছে, তাদের মিত্র অনেক দেশেই তো গণতন্ত্র নেই। নির্বাচনকে ফোকাস করলেও তাদের কৌশল ছিল বাংলাদেশকে চাপে ফেলে তাদের স্বার্থ উদ্ধার করা।
কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিষেধাজ্ঞাকে আমলে না নিয়ে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন। তিনি ১৫ মে সংবাদ সম্মেলনে দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা দেন, ‘যারা আমাদের নিষেধাজ্ঞা দেন, তাদের কাছ থেকে আমরা কিছু কিনব না। ‘২৩ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের স্থায়ী মিশনে সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘যদি দেশের বাইরে থেকে নির্বাচন বানচাল করা হয়, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবে। আমরা দেখতে চাই, দেশের বাইরে থেকে যেন নির্বাচন বানচালের কোনো চেষ্টা করা না হয়। ‘
গত ১০ ডিসেম্বর বিশ্ব মানবাধিকার দিবসকে ঘিরে বিএনপি ও জামায়াত পন্থীরা প্রচার চালিয়ে ছিলো বাংলাদেশে আরো মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আসবে। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মানবাধিকার দিবসের আগে ১৩ দেশের ৩৭ জন ব্যক্তির উপর নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করে। সেখানে বাংলাদেশের কারোই নাম ছিল না। নিষেধাজ্ঞা না আসায় নির্বাচনের আগেই তারা নেতাকর্মীরা হতাশ হয়ে পড়ে। এক শ্রেণির তথাকথিত বুদ্ধিজীবিরা ফতোয়া দিলো নির্বাচনের আগেই নিষেধাজ্ঞা আসবে, সরকার নির্বাচন করতে পারবে না। চাপে পড়ে নির্বাচনের পতন ঘটবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথা শুনে বিভিন্ন দেশের সরকার পতনের ইতিহাস পর্যালোচনা করে টক শোতে গরম গরম বক্তব্য দেয়।
বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ, সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড, ২০০১ সালের নির্বাচনে ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং ও ওয়ান ইলেভেনসহ নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ মদদ ছিল। যুক্তরাষ্ট্র প্রতিটি নির্বাচনের আগে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য চাপ সৃষ্টি করা যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোন কোন সময় সফলও হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন সময়ে প্রকাশ্যেই ২০০১ সালের নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার কারণ সম্পর্কে বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের কাছে দেশের তেল গ্যাস বিক্রি করতে রাজি না হওয়ায় ওই নির্বাচনে তার দলকে হারিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ’এবারও ইন্দো প্যাসিফিকে বাংলাদেশকে পাশে পেতে নির্বাচনে শেখ হাসিনার উপর চাপ সৃষ্টি করা হয়। নিষেধাজ্ঞার জুজু দেখিয়ে দেশরত্ন শেখ হাসিনাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে চেয়েছিল। কিন্তু শেখ হাসিনার অসীম সাহস ও দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশল পরাজিত হয়েছে। শেখ হাসিনা প্রমান করেছেন বাংলাদেশ এখন আর আগের অবস্থায় নেই। কোনো একটি দেশ চাইলেই সরকারকে ফেলে দিবে কিংবা পরিবর্তন ঘটাবে, এমন অবস্থায় বাংলাদেশ আর নেই। আগের বাস্তবতা আর এখনকার বাস্তবতার বিস্তর ফারাক।
প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর কন্যা বলেই তাদের কোনো চাপ কৌশল কাজে লাগেনি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রণীত ‘সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়’ পররাষ্ট্র নীতির এই মূলমন্ত্রকে ধারণ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে ভূ-রাজনৈতিক ও ভূ -অর্থনৈতিক ভাবে দক্ষিণ এশিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে আছে। এজন্যই বিশ্বের পরাশক্তি গুলো বাংলাদেশকে কাছে পেতে প্রবল ভাবে আগ্রহী উঠেছে। বিগত পনের বছরে প্রতিবেশী ভারতের সাথে ঐতিহাসিক বন্ধত্ব, চীনের সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ক, রাশিয়ার সহায়তায় পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলোর সাথে বানিজ্যিক সম্পর্ক জোরদারের মাধ্যমে একটি ভারসাম্যের সম্পর্ক স্থাপন করা হয়েছে। সরকার নতজানু পররাষ্ট্র নীতির কবল থেকে বের হয়ে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করেছে।
নির্বাচনের পর বিএনপি মার্কিন স্যাংশনের দিকে তাকিয়ে ছিল। কিন্তু ফল হলো উল্টো। যে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস নির্বাচনে আগে বিএনপির অভিভাবকের ভূমিকায় ছিলেন, তিনিও এখন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক জোরদারে মন্ত্রীদের দ্বারেদ্বারে ঘুরছেন। বিএনপিপন্থীরা আশা করেছিল যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচন তো মেনে নিবেই না, বরং স্যাংশনের কবলে পড়বে সরকারের মন্ত্রী সহ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের চিঠি ও একত্রে কাজ করার অঙ্গীকার কারণে স্যাংশন জুজুকারীদের মাথায় বজ্রাঘাত পড়েছে।
লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা ও সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ
সারাবাংলা/এসবিডিই
তাপস হালদার বাইডেনের চিঠি- স্যাংশন জুজুকারীদের মাথায় বজ্রাঘাত মত-দ্বিমত