ইমরানের সফলতা বনাম বিএনপির ব্যর্থতা
১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৮:৩৮
অগণতান্ত্রিক পথে ক্ষমতা আরোহণে অভিলাষী বিএনপি-র দেউলিয়া নেতৃত্বের ইমরান খানের পদক্ষেপসমূহ থেকে শিক্ষণীয় সম্পর্কে বিভিন্ন মহল থেকে উপদেশ বিলি করা হচ্ছে। তার কোনোটাই যে বিএনপির মূল নেতা তারেক রহমানের পছন্দ হচ্ছেনা, তা বলাই বাহুল্য! তবু টকশো বিশেষজ্ঞ ও কলামিস্টদের চেষ্টার খামতি নেই!
গত ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ তারিখে অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের নির্বাচনে শত প্রতিকূলতার মধ্যেও জেল থেকে ইমরান খানের নির্দেশে তার দলের নেতাকর্মীরা নির্বাচনে বিভিন্নভাবে অংশগ্রহণ করে একটি সফল রাজনৈতিক কৌশল গণতান্ত্রিক বিশ্বকে দেখাতে সক্ষম হয়েছেন।
কথা হচ্ছে, ইমরান খানের সফলতা ব্যর্থতা থেকে বিএনপির অথবা নেতা হিসেবে লন্ডন-এ পালিয়ে বিলাসী জীবন যাপনরত তারেক রহমানের শিক্ষা নেয়া সম্পর্কে!
বাংলাদেশের পর্যবেক্ষকদের মধ্যে অনেকেই গত ৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন থেকে বিএনপির শিক্ষণীয় বিষয়াদি আবিষ্কারে ব্যস্ত। এই নির্বাচনে পাকিস্তানের ইমরান খানের পদক্ষেপসমূহ থেকে শিক্ষা নেয়ার জন্য পর্যবেক্ষক-বিশ্লেষকগণ বিএনপির উদ্দেশে আরো সুনির্দিষ্টভাবে তারেক রহমানের উদ্দেশ্যে “সবক” দিচ্ছেন! এপ্রসঙ্গে বিএনপি মূল নেতৃত্বের “মাইন্ড সেট” গড়ে ওঠার প্রক্রিয়ার দিকে হালকাভাবে দৃষ্টিনিবদ্ধ করা যেতে পারে।
তারেক রহমানের জন্ম কালে অর্থাৎ ১৯৬৫ সালের ২০ নভেম্বরের ১০ মাস আগে থেকে অর্থাৎ মাতৃগর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় ঘটমান এবং তারপরের ঘটনা প্রবাহের ইতিহাস আমরা স্মরণ করতে পারি। এসময় অর্থাৎ ১৯৬৫ সালে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে যেয়ে পাকিস্তান শোচনীয়ভাবে পরাজয় বরণ করেছিল। সেই যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একজন অফিসার হিসেবে জিয়াউর রহমানের বীরত্ব প্রদর্শন ও খেতাব অর্জনের পরিবেশে তার পুত্র তারেক রহমান সেসময় বেড়ে উঠছিল। কিছু না বোঝার বয়স হলেও মণস্তাত্ত্বিকদের গবেষণা অনুযায়ী উপলব্ধি করতে চাইলে আমরা বলতে পারি প্রতিবেশী গণতান্ত্রিক দেশের প্রতি শত্রুতামূলক মনোভাবের উপাদান দিয়েই তার মণোজগত তখন আস্তে আস্তে গড়ে উঠছিল!
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। এরপর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে কন্সটিটিউয়েন্ট এসেম্বলিতে প্রণীত কন্সটিটিউশন অনুযায়ী ১৯৭৩ সালের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সরকার গঠন করে। গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক এই সরকারকে জিয়াউর রহমান পছন্দ করতেন না! যদিও উপরে উপরে সুযোগ সুবিধা পাবার লোভে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে নিয়মিত যেতেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নির্বাচিত সরকার প্রধান,জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার গুপ্ত মন্ত্রণাদাতা ও বেনিফিসিয়ারি হিসেবে রাজনীতিতে জিয়াউর রহমানের আবির্ভাব হয়েছিল। অগণতান্ত্রিক ও অবৈধ পথে জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা দখল। তারেক রহমানের নেতৃত্বাধীন হাওয়া ভবনে কুক্ষিগত বিএনপি কর্তৃক ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা করে বিরোধী দল আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করার হীন ষড়যন্ত্র। এসব ঘটনা প্রবাহ মাথায় রেখে আন্দোলন ও নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে ইমরান খানের সফল নেতৃত্ব থেকে তারেক রহমান তথা বিএনপি সম্পর্কে কথাবার্তা বা পর্যবেক্ষণপ্রসূত মন্তব্য করাই শ্রেয়। মোটাদাগে, এভাবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে তারেক রহমানের প্রবেশ, তার নেতৃত্বাধীন বিএনপির পাকিস্তানের আইএসআই ভিত্তিক ক্ষমতা চর্চা তথা “রাজনৈতিক সামাজিকীকরণ” হয়েছে! প্রকৃতপক্ষে এমনকি মাতৃগর্ভে থাকা অবস্থায়, সেখান থেকে ভূমিষ্ঠ হওয়া, এবং জীবনের প্রতিটি স্তরে মানুষ যে শিক্ষা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা অর্জন করে রাজনীতি বা বাস্তব অন্য কোনো ক্ষেত্রে সেসবের ভিত্তিতেই সে পদক্ষেপ গ্রহণ বা কাজ করে থাকে।
তারেক রহমানের মত এধরনের কোন অভিজ্ঞতা ইমরান খানের নাই। এর বিপরীতে ইমরান খানের আছে ক্রিকেট খেলায় প্রতিযোগিতা করে বিজয়ী হওয়ার অভিজ্ঞতা। সমগ্র বিশ্ব ইমরান খান-কে একজন সুদক্ষ ক্রিকেটার হিসেবেই চেনে। ক্রিকেট খেলতে খেলতে ইমরান বুঝেছেন প্রতিযোগিতা থেকে পালিয়ে যেয়ে জয়ী হওয়া কখনও সম্ভব নয়। তিনি এও বুঝেছেন যে খেলতে গিয়ে যেমন জয়ী হওয়া যায়, তেমনি খেলতে গিয়ে কখনো কখনো পরাজয়-ও বরণ করে নিতে হয়! ক্রিকেট খেলোয়াড় এবং সংগঠক হিসেবে সুনাম অর্জন করার পর বয়সের কারণে অবসর নিয়ে রাজনীতিতে প্রবেশ করে তার পূর্ব অভিজ্ঞতা কাজে লাগাচ্ছেন ইমরান খান।
পাকিস্তানের নির্বাচনে ভোটের ফলে দেখা যাচ্ছে, নওয়াজ শরিফের পাকিস্তান মুসলিম লিগ পিএমএল-এন এবং বিলাওয়াল ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ে ইমরান খানের দল পিটিআই জাতীয় পরিষদে বেশি আসন পেয়েছেন।
পিটিআইয়ের একজন ইমরান খান আছেন। বিএনপির তারেক রহমান সেরকম কোনো নেতা নন। তিনি আবার গ্রেপ্তার এড়াতে দেশেই আসেন না। তাই বিএনপির প্রধান সমস্যা নেতৃত্বের সংকট।
পাকিস্তানে ইমরান খানকে ঠেকানোর জন্য সব ব্যবস্থাই করা হয়েছিল। কিন্তু পারেনি তার সাহসিকতার জন্যই। অনেকে কথা প্রসঙ্গে ২০১৮-এর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কথা বলেন। তারা বলেন, ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি মাত্র ছয়টি আসন পেয়েছিল, কিন্তু বিএনপি কি ছয়টি আসন পাওয়ার দল? কথায় যুক্তি আছে। তবে সেই নির্বাচনটিও বিএনপি খুব সিরিয়াসলি করেছে এমন নয়। মনোনয়নবাণিজ্যসহ নানা অপবাদ আছে দলের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে। শত বাধা বিপত্তি ও প্রতিকূল পরিস্থিতি মেনে নিয়েই ইমরান খানের দলের সদস্যরা বিভিন্নভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। বলা হয়ে থাকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী কখনো কোনো যুদ্ধে জয়লাভ করেনি, তবে দেশের ভেতরের কোনো নির্বাচনেই তারা হারেনি। পাকিস্তান সম্পর্কে একথাও শোনা যায় যে, ‘সব দেশের একটি করে সেনাবাহিনী থাকলেও শুধু পাকিস্তান সেনাবাহিনীরই একটি দেশ আছে’।
কোনোভাবেই যেন ইমরান খান ও তার দল নির্বাচনে অংশ নিতে না পারে তার চেষ্টা সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনির নানা ভাবে করেছিলেন। এমন পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও নির্বাচন কমিশন যতভাবে পারে, ইমরানকে আটকেছে। ইমরান খান নিজে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারেননি। তিনি জেলে ছিলেন, তার দল প্রতীক পায়নি, তাদের দলীয় প্রতীক ক্রিকেট ব্যাট বাতিল করা হয়েছে। এ অবস্থায় ইমরানের দল পিটিআই প্রার্থীরা নানা প্রকার খুচরা প্রতীক নিয়ে গত ৮ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। কারচুপি সহিংসতাপূর্ণ এবং পক্ষপাতদুষ্ট এই নির্বাচনের মাধ্যমে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে তা হল জনগণ ইমরানের পক্ষে।
ন্যূনতম সুষ্ঠু নির্বাচন হলেও এতে ইমরান খানের দল পিটিআই বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া কোন বিষয়ই ছিল না। উপরের আলোচনার পর আমরা সম্প্রতি অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের নির্বাচন, ইমরান খানের দলীয় নেতাদের তাতে অংশগ্রহণ এবং বিএনপির বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে নীচের ৭ টি উপসংহারে উপনীত হতে পারি।
(১) মাতৃগর্ভে থাকাকালে এবং ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকে ৫৯ বছর ব্যাপী লব্ধ “গণতান্ত্রিক ভারতের প্রতি শত্রুতামূলক মনোভাব, অগণতান্ত্রিক ও অবৈধ পথে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা”র স্থলে গণতান্ত্রিক পথে জনসমর্থণ লাভের লক্ষ্যে প্রতিদ্বন্দ্বীতাপূর্ণ নির্বাচনে তারেক রহমান স্বাভাবিকভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে নাই, যা ইমরান খান পেরেছেন; (২) ‘খেলায় হারজিৎ আছে’ এ সত্ত্বেও খেলায় অংশগ্রহণ করতে হয়, এটি ইমরান খান তার ক্রিকেট জীবন থেকে মণেপ্রাণে শিখেছেন; রাজনীতিতে এসেও তাই শত বাধা বিপত্তি উপেক্ষা করে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছেন, নেতা তারেকের নির্দেশে পরিচালিত বিএনপির মত নির্বাচন প্রতিহত করার আহ্বান জানান নি;
(৩) ইমরান খান প্রমাণ করতে পেরেছেন জনগণের মধ্যে জনপ্রিয়তা থাকলে তাকে কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারে না ; (৪) তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়টি অজুহাত ছাড়া কিছুই নয়। পাকিস্তানের নির্বাচনে দেখা গেছে, এমনকি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনেও কারচুপি হয়েছে ; (৫)গ্রেপ্তার, হয়রানি কোন অজুহাত হতে পারে না। ইমরান খানের পিটিআই এর সহস্রাধিক নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। অনেকে নির্বাচন করতে পারেনি, চাপের মুখে অনেকে দলত্যাগ করেছিল। কিন্তু তারপরও ইমরান খান তার লক্ষ্যে অটল ছিলেন এবং জনগণের সমর্থন নিয়ে তিনি চমক দেখিয়েছেন। আর এখন বিএনপির নেতারা যে কথায় কথায় তাদের নেতাদের গ্রেপ্তার হয়রানির কথা বলেন, তারা কি পাকিস্তানের দিকে একবার তাকিয়ে দেখবেন? পাকিস্তানে পিটিআই এর ওপর যে পরিমাণ নিপীড়নের হচ্ছে তার একশ ভাগের এক ভাগও বিএনপির ওপর হয়নি। তাহলে বিএনপি কেন আন্দোলন গড়ে তুলতে পারল না? বিএনপি কি এই আত্ম উপলব্ধির সুযোগ নেবে—পাকিস্তানের নির্বাচন থেকে; (৬) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ষড়যন্ত্র পাকিস্তানে শেষ পর্যন্ত সফল হতে পারেনি; (৭) দুর্নীতিবাজদের জনগণ প্রত্যাখান করে।
দলটির বর্তমান দেউলিয়া নেতৃত্বের অগণতান্ত্রিক চেতনা পরিবর্তন না হলে বর্তমান বিএনপির পক্ষে ইমরান খানের মত গতিশীলতার সাথে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ তথা আন্দোলন সফল করতে পারবে না, যেমন বিএনপি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনও প্রতিহত করতে পারে নাই।
লেখক: পরিচালক, সেন্টার ফর সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ। সাবেক ডিন, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাবেক চেয়ারম্যান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সারাবাংলা/এজেডএস