Monday 25 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মিশন ২০৪১— কেমন হতে পারে আগামীর অর্থনীতি?

মো. তহুরুল হাসান
১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ২০:০০

মুদ্রা বা টাকার প্রয়োজন ফুরিয়েছে বলে মনে হচ্ছে কি? কাগজের এই নোটগুলো কি শুধুই ব্যক্তিগত মিউজিয়ামের শোভাবর্ধন করবে ভবিষ্যতে? টাকা ছাড়াই তো অনেক লেনদেন করা যায় এখন! জায়গায় জায়গায় কিউআর কোডের মাধ্যমে টাকা পরিশোধ করা যাচ্ছে নিমিষেই। কেউ আর খুব একটা ক্যাশ সঙ্গে নিয়েও ঘুরছেন না আজকাল। সব লেনদেনই ক্যাশলেস হয়ে আসছে।

ভাবছেন, পাশ্চাত্যের উন্নত কোনো দেশের অর্থনীতির গল্প শোনাচ্ছি? একদমই না। বিশ্বাস করুন কিংবা না-ই করুন, প্রযুক্তিরনির্ভর স্মার্ট অর্থনীতির দুনিয়ায় প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ।

বিজ্ঞাপন

২০৪১ সালের মধ্যে বিশ্ব অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হয়ে উঠতে প্রস্তুত বাংলাদেশ। উদ্ভাবন ও ডিজিটাল প্রযুক্তি মাধ্যমে একটি উচ্চ-আয়ের জ্ঞানভিত্তিক সমাজে রূপান্তরের লক্ষ্যে তৈরি করা হয়েছে বাংলাদেশের স্মার্ট অর্থনীতির পাটাতন। স্মার্ট অর্থনীতি বাস্তবায়নে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ সরকার। এর মধ্যে রয়েছে ২০৪১ সালের মধ্যে মাথাপিছু জিডিপি ১২ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলারে উন্নীত করা, যা বর্তমানের তুলনায় পাঁচ গুণ বেশি। পাশাপাশি সরকার জোর দিয়েছে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি এবং দারিদ্র্য হ্রাসের ওপরও। এ জন্য সিএসএমই বা ছোট ছোট শিল্পসহ বেসরকারি খাতের ডিজিটালাইজেশনে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। স্বল্প ও মধ্যম মেয়াদে অর্থাৎ ২০২৫ ও ২০৩১ সালের মধ্যে ডিজিটালাইজেশন এবং ২০৪১ সালের মধ্যে এই খাতের ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা হবে।

২০২৫ সালের মধ্যে দেশের জিডিপিতে ১ শতাংশ টোটাল ফ্যাক্টর প্রোডাক্টিভিটি (টিএফপি) তৈরি করা হবে। পরে ২০৪১ সালে এই প্রবৃদ্ধি ২ দশমিক ৫ শতাংশে নিয়ে যাওয়া হবে। পাশাপাশি হাই-টেক খাতে ১০ মিলিয়ন নতুন কর্মসংস্থান তৈরি করা হবে। এর ফলে কমবে বেকারত্ব এবং তৈরি হবে নতুন কাজের সুযোগ। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, বৃহৎ তথ্য এবং আইওটি বা ইন্টারনেট অব থিংসের মতো উদীয়মান প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী নেতৃত্ব দেবে বাংলাদেশ।

বিজ্ঞাপন

প্রযুক্তি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে এগিয়ে নিতে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করবে। উচ্চ গতির ইন্টারনেট ও ব্রডব্যান্ড সংযোগের মতো অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যাপক বিনিয়োগ হচ্ছে, যা উদ্ভাবন ও উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ের জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ তৈরি করবে।

ক্যাশলেস লেনদেনকে উৎসাহিত করতে বেশকিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ডিজিটাল পেমেন্ট গেটওয়ে ও মোবাইল ব্যাংকিং পরিষেবার বিকাশকে উৎসাহিত করা। অর্থিক ছাড়সহ নানামুখী প্রণোদনায় মানুষ নগদ অর্থের পরিবর্তে ডিজিটাল লেনদেন করতে আগ্রহী হচ্ছে। স্বল্পমেয়াদে ক্যাশলেস লেনদেনকে ৩০ শতাংশে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে। ২০৩১ সালের মধ্যে দেশের সব লেনদেনই ক্যাশলেস করার লক্ষ্য নিয়েছে সরকার।

এখন প্রশ্ন হতে পারে— গ্রামের মানুষও কি এই স্মার্ট অর্থনীতির অংশ হতে পারবে? স্মার্ট অর্থনীতি অর্জনের ক্ষেত্রে অন্যতম চ্যালেঞ্জ হলো গ্রামীণ ও শহুরে এলাকার মধ্যে বৈষম্য কমানো। গ্রামীণ অঞ্চলে বিদ্যুতায়ন প্রকল্পের সম্প্রসারণ এবং ডিজিটাল সাক্ষরতা কর্মসূচি বিকাশের মাধ্যমে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বেশ কয়েকটি উদ্যোগের বাস্তবায়ন চলছে। এই উদ্যোগগুলো সুনিশ্চিত করে যে সমস্ত বাংলাদেশির স্মার্ট অর্থনীতিতে অংশগ্রহণের সুযোগ থাকবে। মানে গ্রামের মানুষও পাবে শহরের সব সুবিধা। এ প্রসঙ্গে আমার গ্রাম, আমার শহর প্রকল্পের উল্লেখ না করলেই নয়।

স্মার্ট অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হলো উদ্ভাবনী উদ্যোক্তা সংস্কৃতি। ডিজিটাল প্রযুক্তি উদ্যোক্তাদের চিন্তাভাবনা, ঝুঁকি নেওয়া এবং নতুন ব্যবসায়িক মডেল তৈরির সুযোগ তৈরি করে। এ ছাড়া ফ্রন্টিয়ার টেকনোলজিতে সক্ষমতা বাড়ানো, এবং ব্যবসার সম্ভাবনা বাড়ানোর জন্য একটি কার্যকর সেবা প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা হবে। এ লক্ষ্যে ২০২৫ সালের মধ্যে পাঁচটি, ২০৩১ সালের মধ্যে ১৫টি এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ৫০টি ইউনিকর্ন স্টার্টআপ স্থাপন করা হবে। প্রচলিত অথবা উদ্ভাবনী, ক্ষুদ্র, মাঝারি কিংবা বৃহৎ উদ্যোগ, যাই হোক না কেন স্মার্ট বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিক হবেন স্মার্ট। ‘আমিই সল্যুশন’ মন্ত্রে নিজের সমস্যার সমাধান করবেন নিজেই।

বেকারত্ব নিরসনে ই-কমার্স নতুন স্বপ্ন দেখাচ্ছে। প্রযুক্তিনির্ভর এই খাতে তরুণ উদ্যোক্তাদের পাশাপাশি যোগ হচ্ছেন ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারাও। স্মার্ট কমার্স বাস্তবায়ন এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ভোগান্তি কমাতে ই-ট্রেড লাইসেন্সসহ সব গুরুত্বপূর্ণ সেবা ডিজিটাল পদ্ধতিতে প্রদান করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

স্মার্ট অর্থনীতির সাফল্য সরকারের ক্রমাগত উদ্ভাবন এবং বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতির ওপর নির্ভরশীল। সরকার ব্যবসার ক্ষেত্র সহজ করার মাধ্যমে ২০৩১ সালের মধ্যে দেশের জিডিপিতে সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগের (এফডিআই) অবদান ৩ শতাংশে উন্নীত করতে চায়। ২০৪১ সালের মধ্যে দেশকে পরিণত করতে চায় ফ্রন্টিয়ার টেকনোলজির আঞ্চলিক রফতানি হাবে। এ জন্য রফতানি পণ্য ও সেবার পাশাপাশি রফতানির গন্তব্যও বহুমুখীকরণের পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বিশেষ নজর দেওয়া হচ্ছে কৃষি ও কৃষিজাত পণ্য, ওষুধ এবং তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশ ও উন্নয়নে।

স্মার্ট বাংলাদেশ ও স্মার্ট অর্থনীতি গঠনে অ্যাসপায়ার টু ইনোভেশনের (এটুআই) অন্তর্ভুক্তিমূলক আর্থিক সেবাগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। সারাদেশে ৯ হাজার ৩৪টি ডিজিটাল সেন্টার থেকে জনগণকে বিভিন্ন আর্থিক সেবা দেওয়া হচ্ছে। এসব সেন্টার থেকে নাগরিকরা ব্যাংকিং সেবা, মোবাইল ব্যাংকিং সেবা, বিকাশ, জিটুপি, ই-চালান, একপে ও একশপসহ বিভিন্ন আর্থিক সেবা গ্রহণ করতে পারেন।

ডিজিটাল সেন্টারের মাধ্যমে এরই মধ্যে ৮৯ কোটি ৩১ লাখেরও বেশি নাগরিক সেবা দেওয়া হয়েছে। এসব ডিজিটাল সেন্টারে নাগরিকদের সেবা প্রদানের মাধ্যমে সাড়ে ১৬ হাজারের ওপর উদ্যোক্তা স্বাবলম্বী হয়েছেন, যার মধ্যে নারী উদ্যোক্তা রয়েছেন পাঁচ হাজার ২০০ জন। যাত্রাপথে নাগরিকদের সেবা দিতে একপাস পাইলটিং কার্যক্রম চালু হয়েছে। ডিজিটাল পদ্ধতিতে টোল আদায়ের এই সার্ভিসের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হবে দ্রুতই। এরই মধ্যে পদ্মা সেতুসহ ১৭টি সেতুতে চলছে পাইলটিং।

সাথী নেটওয়ার্কের মাধ্যমে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে নারী উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে আর্থিক সেবা দেওয়া হচ্ছে। এই নেটওয়ার্কের মাধ্যমে এখন পর্যন্ত দুই লাখ ৭০ হাজারের বেশি প্রান্তিক নারীকে ব্যাংকিং অ্যাকাউন্টের আওতায় আনা হয়েছে। এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকেও ব্যাংকিং সেবার আওতায় আনা হচ্ছে।

সামনে দীর্ঘ ও চ্যালেঞ্জিং পথ। তবু বিশ্ব অর্থনীতির অন্যতম প্রধান অংশীদার হতে প্রয়োজনীয় সব উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ। উপাদান রয়েছে। দেশের তরুণ, প্রতিভাবান জনগোষ্ঠী, কৌশলগত অবস্থান ও ক্রমবর্ধমান অর্থনীতি সবই বাংলাদেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যতকেই নির্দেশ করে। উদ্ভাবন ও ডিজিটাল প্রযুক্তিকে গ্রহণ করে স্মার্ট বাংলাদেশের স্মার্ট অর্থনীতির সুফল পাবে সবাই, বাদ যাবে না একজন নাগরিকও।

লেখক: হেড অব ডিজিটাল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস অ্যান্ড ডিজিটাল সেন্টার, এটুআই

সারাবাংলা/টিআর

আগামীর অর্থনীতি আমিই সল্যুশন এটুআই মিশন ২০৪১ স্মার্ট অর্থনীতি

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর