Monday 25 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মিউনিখ সম্মেলন: মূল ফোকাসে শেখ হাসিনা

তাপস হালদার
১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৯:২৬

দেশরত্ন শেখ হাসিনা টানা চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের পর জার্মানি সফরের মধ্যদিয়ে প্রথম বিদেশ সফর করলেন। সঙ্গত কারণেই সফরটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিল। মাত্র দেড় মাস আগে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। তার আগে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তাল মিলিয়ে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন সহ অনেক দেশ নির্বাচন বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছিল। যদিও নির্বাচনের পর সেসব দেশ আগের অবস্থান থেকে সরে এসে শেখ হাসিনার সঙ্গে কাজ করার দৃঢ় অঙ্গীকার করেছে। সেজন্য এবারের মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলন উপলক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জার্মানি সফর অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ছিল।

বিজ্ঞাপন

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবী দুই ভাবে বিভক্ত ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক শিবির ও যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পুঁজিবাদী শিবির। দুই শিবিরের নেতৃত্বে দুই সামরিক জোট গঠিত হয়েছিল। একটি নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন(ন্যাটো), অন্যটি ওয়ারশ জোট। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ওয়ারশ জোটের কার্যকারিতা কমে যায়। দুই জোটের তীব্র স্নায়ু যুদ্ধকালে ১৯৬৩ সালে এভাল্ড ভন ক্লাইস্ট ও হোর্স্ট টেল্টশিক মিউনিখের উদ্যোগে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, গবেষক ও নাগরিক সমাজের ব্যক্তিদের নিয়ে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা নিরাপত্তা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। তবে শুরুর প্রথম দিকে আন্তর্জাতিক ভাবে তেমন সাড়া ফেলতে পারেনি। শুধুমাত্র ন্যাটো ভুক্ত দেশগুলোর সাথে যুক্তরাষ্ট্র অংশগ্রহণ করতো।

বিজ্ঞাপন

পরবর্তীতে সম্মেলনে সার্বজনীনতা বাড়াতে এবং বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ইউরোপের বাইরে বিভিন্ন দেশ এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন ভুক্ত দেশগুলোকেও আমন্ত্রণ জানানোর কারণেই মিউনিখ সম্মেলনের গুরুত্ব বেড়ে যায়।

তারপর থেকে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র প্রধানগণ মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক ও বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলোচনা করার সুযোগ পাচ্ছেন। এটি একটি উন্মুক্ত ফোরাম। এখানে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা দ্বিপক্ষীয় ও বহুপাক্ষিক নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করার সুযোগ পান। সম্মেলনে রাষ্ট্র নেতারা ছাড়াও শিক্ষাবিদ, বানিজ্য ও অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞ, পরিবেশবিদ, মানবাধিকার কর্মী সহ সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি পেশার প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন।

বিশ্বে এই সময়ে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও ফিলিস্তানিদেন উপর ইসরায়েলের হামলা নিয়ে পুরো বিশ্ব খুবেই অস্থির সময় পার করছে। ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বিশ্ব অর্থনীতি টালমাটাল অবস্থা চলছে। এখন সময়ে বিশ্ব নেতাদের এক মঞ্চে উপস্থিত হয়ে পারস্পরিক আলোচনা নিঃসন্দেহে ভালো কিছু বয়ে আনবে।

মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলন এবার ৬০ তম বার্ষিকী পালন করেছে। দীর্ঘ এই সময়ে সম্মেলনে অনেক বৈচিত্র্য এসেছে। এবারের সম্মেলনেও বিশ্ব নেতারা গুরুত্বপূর্ণ অনেক আন্তর্জাতিক বিষয়, যেমন বৈশ্বিক অর্থনীতি, আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও জলবায়ু পরিবর্তনজনীত ঝুঁকি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস-প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক, ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁ, পোল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট আন্দেজ দুদা, জার্মানির চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎস, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর, চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইও, জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক টেড্রোস আধানম ঘেব্রেইসাস, বিশ্বব্যাংক সহ আন্তর্জাতিক সংস্থার শীর্ষ প্রতিনিধিগণ সহ বিশ্ব নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। সম্মেলনে প্রায় ৬০ টি দেশের সরকার প্রধান, আন্তর্জাতিক সংস্থা, সুশীল সমাজ, সরকারি -বেসরকারি খাতের শীর্ষ স্থানীয় প্রায় পাঁচশ প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। ১৬ ফেব্রুয়ারি সম্মেলনের উদ্বোধন হয়ে ১৮ ফেব্রুয়ারি শেষ হয়।

মিউনিখ সিকিউরিটি কনফারেন্স-২০২৪ এ ‘ফ্রম পকেট টু প্লানেট: স্কেলিং আপ ক্লাইমেট ফাইন্যান্স’ শীর্ষক প্যানেল আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্ব নেতাদের সামনে ছয়টি প্রস্তাব দিয়েছেন। প্রথম প্রস্তাব:আমাদের সঠিক পথে রাখতে জলবায়ু অর্থায়নের বরাদ্দ ছাড় করার সমাধান খুঁজে বের করা। উন্নত দেশগুলোকে পরিকল্পনার ভিত্তিতে ২০২৫ সাল পর্যন্ত ১০০ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি মেনে চলা। দ্বিতীয় প্রস্তাব:বিশ্বকে যুদ্ধ ও সংঘাত, অবৈধ দখলদারিত্ব এবং নিরস্ত্র বেসামরিক নাগরিকদের বিশেষ করে নারী ও শিশুদের নির্মম হত্যাকাণ্ড থেকে পরিত্রাণ পেতে হবে। যা গাজা ও অন্যত্র বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করেছে। তৃতীয় প্রস্তাব:জলবায়ুর প্রভাব প্রশমন ও অভিযোজনের জন্য অর্থায়নের তীব্র ভারসাম্যহীনতা দূর করার জন্য অভিযোজন অর্থায়ন দ্বিগুণ করা। চতুর্থ প্রস্তাব:বিদ্যমান আন্তর্জাতিক জলবায়ু তহবিল থেকে উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থ প্রাপ্তি সুগম করার লক্ষ্যে দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত সমস্যাটি তাদের সক্ষমতায় বিনিয়োগ করার সুযোগ সহ সমাধান করা। পঞ্চম প্রস্তাব: বৈশ্বিক অর্থায়নের ব্যবস্থাপনায় সংস্কারের ক্ষেত্রে বিশেষ করে জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ন দেশগুলোর ঋণের বোঝা দূর করতে তাদের জন্য অনুদান ও সুবিধাজনক লাভের সুযোগ বাড়ানোর মাধ্যমে অর্থপূর্ণ ফলাফল দেখানো। ষষ্ঠ প্রস্তাব:জলবায়ু কর্মসূচির জন্য বেসরকারি পুঁজি প্রবাহের জন্য সরকার গুলোকে সঠিক পরিকল্পনা, নীতি ও ব্যবস্থার ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করতে হবে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান গুলোকে প্রকল্পের জন্য বেসরকারি পুঁজি আকৃষ্ট করার জন্য আহবান জানানো।

প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার সাথে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা করেছেন বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র প্রধানগণ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিগণ। তাদের মধ্যে অন্যতম জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ স্কোলজ, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি, ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী মিস মেট ফ্রেডেরিকসেন, কাতারের প্রধানমন্ত্রী আব্দুল রহমান আল-খানি, নেদারল্যান্ডসের প্রধানমন্ত্রী মার্ক রাটা, আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভ, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর, যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন, জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্থনি গুতেরেস, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক টেট্রোস আধানম ঘেব্রেইসাস, মেটার (ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ) গ্লোবাল এফেয়ার্স প্রেসিডেন্ট স্যার নিক ক্লেগ, উইমেন পলিটিক্যাল লিডারসের (ডব্লিউপিএল) সভাপতি সিলভানা কোচ মেহরি, বিশ্বব্যাংকের সিনিয়র ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ্যাক্সেল ভ্যান ট্রটসেনবার্গ, জার্মানির আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন বিষয়ক মন্ত্রী ভেনজা শুলজ বৈঠক করেছেন।

এবারের সফরে দেশ-বিদেশে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির সাথে বৈঠক। কারণ বাংলাদেশের সাথে রাশিয়ার যে ভালো সম্পর্ক সেসময় ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের সাথে করা নিঃসন্দেহে একটি স্পর্শকাতর বিষয় ছিল। কিন্তু শেখ হাসিনা প্রমান করেছেন বাংলাদেশ নতজানু পররাষ্ট্র নীতিতে বিশ্বাসী নয়। বাংলাদেশ বর্তমানে চলছে বঙ্গবন্ধু প্রণীত পররাষ্ট্র নীতি ‘সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারও সাথে বৈরিতা নয়’। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আমরা সব ধরনের যুদ্ধের বিরুদ্ধে।

কিভাবে রাশিয়া -ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করা যায় সে বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলেছেন। বৈঠক বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড.হাসান মাহমুদ স্পষ্ট করেই বলেছেন, এধরণের বৈঠকে রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। স্বাধীনতার সময়ে বাংলাদেশ ও রাশিয়ার মধ্যে গড়ে ওঠা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্থ হবে না। মুক্তিযুদ্ধের সময় রাশিয়া আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে এবং যুদ্ধের পর বাংলাদেশের পুনর্গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে।

দেশরত্ন শেখ হাসিনা এখন শুধুমাত্র বাংলাদেশেরই কন্ঠস্বর নয়, তিনি আন্তর্জাতিক বিশ্বের নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষের কন্ঠস্বর। সম্মেলনে তার ছয়টি প্রস্তাব সেটিরই প্রমান দেয়। তিনি শুধু বাংলাদেশের কথা বলেননি, ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিটি দেশের কথাই বলেছেন। ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও জেলেনস্কিকে পাশে বসিয়ে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং গাজায় নিরীহ নারী-শিশুদের উপর গণহত্যা বন্ধ করার কথা জোড়ালো ভাবে বলেছেন। শেখ হাসিনার বিদেশ সফরে প্রতিবারই চমক থাকে, এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে এত বড়বড় রাষ্ট্র নেতাদের ভিড়েও ফোকাসের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা।

লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা ও সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ

সারাবাংলা/এসবিডিই

তাপস হালদার মত-দ্বিমত মিউনিখ সম্মেলন: মূল ফোকাসে শেখ হাসিনা

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর