রক্তাক্ত পিলখানা: বাংলাদেশকে অকার্যকর করার ষড়যন্ত্র
২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৫:২৮
২৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৪ পিলখানা ট্রাজেডির ১৫তম বার্ষিকী। ২০০৯ সালের এই দিন ঢাকার পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের নাটক মঞ্চস্থ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার অতন্ত্র প্রহরী দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে ধ্বংস করে বাংলাদেশকে একটি অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিনত করার চক্রান্ত শুরু হয়েছিল।
ষড়যন্ত্রকারীদের ষড়যন্ত্রে বাংলাদেশের দীর্ঘ প্রায় ২০০ বছরের ঐতিহাসিক বিডিআরের চেতনাকে ধ্বংস করেছে। ১৯৭১‘র মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ২৩ মার্চ যে বাহিনী প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেছিল সেই বাহিনীকে করেছে কলংকিত। শুধু বাংলাদেশ নয়, সম্ভবত পৃথিবীর ইতিহাসে এতজন সেনাকর্মকর্তাকে নারকীয় হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটেছে ২৫ ফেব্রুয়ারী পিলখানায়।
জাতি হিসাবে আমাদের দুর্ভাগ্য, দীর্ঘ চার দশকেও আমরা আমাদের ঘর সামলাতে সক্ষম হইনি। পারিনি শক্ত মাটিতে পা রেখে চলতে। কে আমাদের বন্ধু এবং কে আমাদের শত্রু তাও সঠিকভাবে নির্নয় করতে পারিনি। ইতিহাস বলে ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে যুদ্ধের নামে যে প্রহসন সংঘটিত হয়, তার অদূরে হাজারো জনতা আগ্রহ ভরে দেখেছিল কি হচ্ছে। দেখতে দেখতে বাংলার স্বাধীনতার লাল সূর্য্য অস্তিমিত হয়। দীর্ঘ প্রায় ২০০ বছর লেগেছে সেই সূর্য্য ছিনিয়ে আনতে। আবারো পাকিস্তানী শাসকগেষ্টির বিরুদ্ধে আরেকটি রক্তক্ষয়ি মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালে পৃথিবীর মানচিত্রে প্রতিষ্ঠিত হয় লাল সবুজের পতাকা আর স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। দুঃখজনক হলেও সত্য যে যে রাষ্ট্রের জন্ম মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত প্রান্তরে, সেই রাষ্ট্রের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব আজ শুকুনীর কালো থাবায় ক্ষত-বিক্ষত।
২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারী বিডিআর বিদ্রোহের যে নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিল তা যে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বে উপর চরম আঘাত তা দিবালোকের মত স্পষ্ট। ঐদিন বিডিআর সদর দফতরে সেনাকর্মকর্তাদের হত্যার মাধ্যমে যে বিপুল ক্ষতি সাধিত হয়েছে তা পূরনে বিশেষজ্ঞ মহল মনে করে ২০-২৫ বছর লেগে যাবে বাংলাদেশের। বাংলাদেশ বিরোধী ষড়যন্ত্রকারীরা সে কাজটি সূচরুভাবে সম্পাদন করতে পেরেছিল তাদের আভ্যন্তরিন দালালদের সহযোগিতায় আর আমাদের জাতীয় ঐক্য না থাকার সূযোগে। এই হত্যাকান্ড তো বাংলাদেশের কারো লাভ হয়নি, তাহলে লাভ হয়েছে কাদের? তাদেরই যারা বাংলাদেশকে দেখতে চায় একটি অকার্যকর, দুর্বল, ভঙ্গুর ও ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসাবে দেখতে চায় তাদেরই। সেনাকর্মকর্তাদের ওপর পরিচালিত এই গণহত্যায় নিঃসন্দেহে দুর্বল হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-স্বার্বভৌমত্ব রক্ষার অতন্ত্র প্রহরী সেনাবাহিনী ও সীমান্ত রক্ষার জনগনের আস্থার স্থল বিডিআর। বিডিআরের বীরত্ব ও সাহসীকতা সর্বজনবিদিত।
২৫ ফেব্রুয়ারী বিডিআর বিদ্রোহের আগের দিন হঠাৎ করেই বাংলাদেশের সীমান্তে ভারতীয় বিএসএফ ভারী অস্ত্রশস্ত্রসহ নিরাপত্তা জোরদার করে তোলে। আমদানি-রফতানিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। এঘটনা থেকে প্রশ্ন উদ্বেগ হওয়াটা স্বাভাবিক তাহলে কি ভারত জানত পরদিন বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কোন ঘটনা ঘটছে? স্বাধীনতার পর থেকেই ভারতের অব্যাহত আগ্রাসনের কারনে বাংলাদেশ কখনো মাথা সোজা করে দাড়াতে পারেনি। গুটি কয়েক ভারতীয় পাচাঁটা দালাল বাদে ভারতের অব্যাহত সীমান্ত-সাংস্কৃতিক-পানি-বাণ্যিজ্য আগ্রাসনের কারনে দেশবাসী মনেই করে ভারত কখনো বাংলাদেশের সৎ প্রতিবেশীর পরিচয় দিতে পারেনি।
স্বাধীনতার পর পরই বাংলাদেশকে একটি অকার্যকর ও ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিনত করার যে চক্রান্ত ধাপে ধাপে সে ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন চলছে। ২০০৯ সালে ২৫ ফেব্রুয়ারী পিলখানায় নির্মম হত্যাকান্ড সেই ষড়যন্ত্রেই অংশ। এই ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের ধারাবাহিকতায়ই বিডিআর বিদ্রোহের নাটক মঞ্চস্থ করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও বিডিআর দু‘টোকেই দুর্বল করে দিতে সক্ষম হয়েছে। সেনাবাহিনীর বিভিন্ন স্তরের এতগুলো কর্মকর্তাকে একসাথে হত্যা কোন কাতালীয় ঘটনা কিংবা দুঘর্টনা হিসাবে চিহ্নিত করার কোন সুযোগ নেই। ৬৩জন সামরিক কর্মকর্তাকে হত্যার মাধ্যমে সেনাবাহিনীর মেধা ও সক্ষমতাকে বাঁধাগ্রস্থ করা হয়েছে। অপর দিকে যে বিডিআর স্বাধীন বাংলাদেশে দীর্ঘ ৩৭বছর ধরে অতন্ত্র প্রহরীরুপে সীমান্তে বিদেশী আগ্রাসন সফল ভাবে প্রতিহত করেছে, সেই প্রতিষ্ঠানটির অস্তিত্ব মুছে গেছে। ঐতিহ্যবাহী বিডিআর এখন বিজেপি নাম ধারন করেছে।
আর সীমান্তে জোরদার হয়েছে ভারতীয় বিএসএফের আগ্রাসন। এখন সীমান্তে প্রতিনিয়ত বাংলাদেশের নাগরিককে নির্বিচারে হত্যা করছে ভারতীয় বিএসএফ, হত্যার পর ফেলানী লাল কাটা তাঁরে ঝুলিয়ে রেখে উল্লাশ করেছে বিএসএফ। পিলখানার ঘটনা যে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে দুর্বল করে দেবার জন্যই যে ঘটানো হয়েছিল তা আজ দিবালোকের মতই স্পষ্ট। এটি ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে ঠান্ডা মাথায় ষড়যন্ত্র। এক ধরনের প্রতিশোধও বটে।
বিডিআর ট্রাজেডির ৭ বছর হলেও এখন পর্যন্ত এর প্রকৃত রহস্য জাতি জানতে পারেনি। দুটি তদন্ত কমিটি গঠন হলেও একটি তদন্ত কমিটির আংশিক প্রকাশ হলেও পুরোটা আজও জাতি জানে না। সেনাবাহিনীর আভ্যন্তরিন তদন্ত কমিটির রিপোর্ট জাতি জানে না। দুঃখ ৭ বছরে জাতীয়ভাবে ২৫ ফেব্রুয়ারীকে শোক দিবস হিসাবে পালন করতে পারিনি আমরা। রাজনৈতিক দলগুলো এখনও এই বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি। প্রকারন্তরে ২৫ ফেব্রুয়ারী নিয়ে অনেক রাজনৈতিক দলগুলোর ভুমিকা দেখলে মনে হয় ভারত অখুশি হতে পারে বলেই তারা বিষয়টি এড়িয়ে চলেন।
২৫ ফেব্রুয়ারী পিলখানা ট্রাজেডির গতানুগতিক বিচারে কি প্রকৃত রহস্য উদঘাটন হবে। জাতির স্বার্থেই এই ঘটনার সাথে জড়িতদের চিহ্নিত করা উচিত। চিহ্নিত করে যদি অপরাধীদের বিচার করা সম্ভব না হয় তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে আজকের নেতৃত্বে ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে থাকবে। জাতীর এই কলংক জনক অধ্যায়কে মুছে ফেলতে প্রকৃত রহস্য উদঘাটন করতে হবে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এতগুলো চৌকশ কর্মকর্তাকে একদিনে হত্যা করা জাতির স্বাধীন অস্তিত্বের জন্য কত বড় আঘাত তা আমাদের উপলব্ধি করতে হবে। এই ঘটনা নিরব পলাশী হিসাবে যেন চিহ্নিত না হয়।
জাতীয় ইতিহাসের এই পলাশীতে কারা নব্য মীরজাফর, কারা নব্য জগৎশেঠ-রাজবল্লব-ক্লাইভ তাদের চিহ্নিত করতে হবে। গত ১৪বছরেও সেটা চিহ্নিত করতে না পারাও কিন্তু প্রশ্নবিদ্ধ ? এই রাষ্ট্রঘাতি চক্রান্তের ভয়বহতা যদি আমরা সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে না পারি তাহলে জাতি আমাদের কিছুতেই ক্ষমা করবে না। ২৫ ফেব্রুয়ারী শুধুমাত্র একটি হত্যাকান্ড নয় এটি হলো বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের উপর চরম আঘাত।
বাংলাদেশের ইতিহাসের অনেক পাতাই রক্তে রঞ্জিত। অনেক রক্ত আমরা দেখেছি, দেখেছি উম্মুক্ত প্রান্তরে, শহরের রাজপথে কিংবা সেনাছাউনীতে। আর কত উচ্ছৃঙ্খলতা, কত হানাহানি, কত রক্তক্ষরন বাকী ? এর শেষ হবে খোথায় ? পিলখানার ট্রাজিডির কলংক কবে মুছবে ? আর কত নতজানু হতে হবে জাতিকে? ক্ষমতায় যেতে কিংবা ক্ষমতায় টিকে থাকতে শাসকগোষ্ঠীর ভারতীয় প্রভুদের পদলেহনের দৃশ্য আর কত কাল দেখবে জাতি ? আমাদের শাসকগোষ্টি মাথা নত করতে করতে এখন মাটিতে মাথা ছুয়ে ফেলেছে বলেই হয় ২৫ ফেব্রুয়ারীকে দায়সারা ভাবে স্মরণ করতে চাইছি। কে এই দিনটি আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে জাতীয় শোক দিবস হিসাবে পালন করতে পারছি না ?
আমরা যদি ক্ষমতায় টিকে থাকতে কিংবা ক্ষমতায় যেতে আধিপত্যবাদী ও আগ্রাসী শক্তির কাছে নিজেদের বিবেক-বিবেচনা বন্ধক দেই, যদি আমরা পরাভূত হই সেই অপশক্তি ও অপশক্তির দালালদের কাছে, আপস করে ফেলী, তাহলে আমি নিশ্চিত ২৫ ফেব্রুয়ারীর চাইতে ভয়াবহ ঘটনার পুনরাবৃত্তি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। অপশক্তির লালনকারীরা ধারকে ও বাহকরা আরও উৎসাহিত হয়ে তাদের স্বার্থ চরিতার্থে আরও ভয়ংকর ঘটনা ঘঁটাবে এই কথা দ্বীধাহীনভাবে বলা যায়। আর যারা আপোষ করবেন তাদের স্থান হবে ইতিহাসের আস্তকুরে। আপোষ করে হয়ত ক্ষমতায় টিকে থাকা যাবে কিংবা কিছু সময়ের জন্য ক্ষমতায় টিকে থাকা যাবে কিন্তু ইতিহাসে মীরজাফর হিসাবেই চিহ্নিত হয়ে থাকতে হবে।
আজ আমাদের ঐ আগ্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। আজ প্রয়োজন, জরুরী প্রয়োজন, একান্ত প্রয়োজন আধিপত্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্য। দলীয় সংকীর্ণতার উর্দ্বে উঠে, ক্ষমতায় যাওয়া কিংবা ক্ষমতায় টিকে থাকার মোহমুক্ত হয়ে সবাই সবাইকে নিয়ে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় নিয়োজিত হওয়া, নিবেদিত হওয়া। মনে রাখতে হবে দেশ থাকলে সবাই থাকবেন। যে দেশ মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন হয় তার ক্ষয় নাই, পরাজয় নাই। আজ প্রয়োজন মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারন করে ঐক্যবদ্ধ ভাবে ২৫ ফেব্রুয়ারী পিলখানা ট্রাজেডি থেকে শিক্ষা গ্রহন করে জাতীয় এজন্ডা নির্ধারন করা। আসুন সকলে ঐক্যবদ্ধ ভাবে ২৫ ফেব্রুয়ারী পিলখানা ট্রাজেডি স্মরণে জাতীয় শোক দিবস পালন করি।
লেখক: রাজনীতিক ও কলামিস্ট, মহাসচিব, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-বাংলাদেশ ন্যাপ ও আহ্বায়ক, জাতীয় কৃষক-শ্রমিক মুক্তি আন্দোলন
সারাবাংলা/এসবিডিই
এম. গোলাম মোস্তফা ভুইয়া মত-দ্বিমত রক্তাক্ত পিলখানা: বাংলাদেশকে অকার্যকর করার ষড়যন্ত্র