Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

কোভিড পরবর্তী অর্থনীতির নতুন রূপ

রজত রায়
২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৬:২৬

প্রায় চার বছর আগে ২০২০ সালের ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনা সনাক্ত হয়। মনে পড়ে? কোভিড-১৯ চলাকালীন বিশ্বের বির্পযস্ত অমানবিক স্মৃতিগুলো! তখন বিশ্বের সবার মনে যে প্রশ্নটি জোড়ালো হয়ে দেখা দিয়েছিল তা হলো, পৃথিবী কি আবার আগের রূপে ফিরবে-যেমনটি ছিল প্রি কোভিড পিরিয়ড? আর সঙ্গত কারণেই অর্থনীতিও পরিবতিত নতুন রূপে আত্মপ্রকাশ করেছিল। যা ছিল ‘দ্যা নিউ নরমাল ইকোনমিক্স’ বা নতুন স্বাভাবিক অর্থনীতি।

বিজ্ঞাপন

করোনাকালে বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত নতুন শব্দ ছিল ‘সোশ্যাল ডিসট্যান্স’ যদিও অনেকেই এই টার্মোলজি মানতে রাজি ছিল না, তারা ‘ফিজিক্যাল ডিসট্যাসিং’ শব্দে বেশি আগ্রহী ছিল। তবে বাংলাদেশের মতো সর্বোচ্চ ঘনবসতিপূর্ণ দেশে এই ডিসট্যাসিং নিশ্চিত করাটা ছিল দুরূহ, তবুও যতটুকু হয়েছিল কেউ কল্পনা করেনি আগে। সৃষ্টির শুরু থেকেই মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। মানুষ একত্রে থাকবে, এক অন্যের সাথে সুখে দুঃখে পাশে থাকবে, এটাই মানবধর্ম। করোনা এই মানবধর্মকে ত্বরান্বিত করেছে কিন্তু প্রক্রিয়াটি এতটাই আত্মরক্ষামূলক যা সামাজিক রীতিনীতিকে উল্টে দিয়েছিল। ফলশ্রুতিতে নিজেকে মানুষ অথবা অমানুষ হিসেবে প্রমাণ করার সুযোগ তৈরি হয়েছিল। যেমন আগে কোন ষ্টোরে বা প্রতিষ্ঠানে গ্লাভস বা মাস্ক পরে গেলে মানুষ অন্যরকম ভাবে তাকাত কিন্তু করোনাকালে ডিপার্টমেন্টে বা ষ্টোরসহ সকল প্রতিষ্ঠানে বড় করে সাইনবোর্ড লাগানো থাকতো ‘No Mask, No Entry’- এটিই ছিল নিউ নরমাল।

বিজ্ঞাপন

মানুষকে সবচেয়ে ক্ষতিকর ভাবছিল মানুষ, এড়িয়ে চলছিল একে অন্যকে। তখন বিচ্ছিন্ন থাকাটাই বেঁচে থাকা তবে সেটা হয়েছিল কনসাস লিভিং, হ্যান্ডশেক, কোলাকুলি যুগের অবসান হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের ব্রজেশ্বর চরিত্রের শুচিবায়ুগ্রস্থতাই স্বাভাবিকতায় পরিণত হয়েছিল। মন খারাপ বা হাসি আনন্দের ইম্প্রেশন ঢাকা পড়েছিল মাস্কের নীচে। লাইফ স্টাইলের সাথে মানুষের ইন্টারেকশন স্টাইল পাল্টে গিয়েছিল। বাঙালির চিরায়ত আড্ডা রূপান্তরিত হয়েছিল ভার্চুয়াল আড্ডায়। হেলদিয়ার ডিজিটাল লাইফ স্টাইলে অভ্যস্ত হতে হয়েছিল সবাইকে, যার গতি হয়েছিল জ্যামিতিক হারে। মীনা কার্টুনের মাধ্যমে সাবান দিয়ে হাত ধোয়া শেখাতে ১০ বছর সময় লেগেছিল ইউনিসেফের আর করোনা তা শিখিয়েছিল মাত্র কয়েক মাসে।

সময়ের প্রয়োজনেই বদলে যাচ্ছিল দীর্ঘদিন ধরে গড়ে ওঠা সব ব্যবস্থা ও মানুষের আচরণ। শারীরিকভাবে যখন কাছে যাওয়ার সুযোগ ছিল না তখন ডিজিটাল প্ল্যাটর্ফমই সবাইকে কাছাকাছি নিয়ে এসেছিল। অনলাইন ইন্টারেক্টিভ মিটিং টুলস যেমন- গুগল মিট, জুম, ফেসবুক, মেসেঞ্জার, গো-টু-মিটিং, ওয়েববক্স, গেটটু-ওয়েবিনার, মাইক্রোসফট মিটিং, স্ট্রিমইয়ার্ড, বিস্ট্রিম ও বি-লাইভের মতো সফটওয়্যার ও অ্যাপস নৈমিত্তিক কাজের ভরসা। এটা আমাদের মন ও মস্তিষ্কে নতুনের আহ্বানে সাড়া দিতে শুরু করেছে। এরই মধ্যে Work from Home বা বাসায় বসে কাজের রীতি চালু হয়ে গিয়েছে। অনেক অফিসে, জব বা ট্র্যাকিং টুলসের ব্যবহার, ভার্চুয়াল কাস্টমার সার্ভিস এবং বিভিন্ন সফটওয়্যার ভিত্তিক মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনাসহ কর্মক্ষেত্রে নানা পরিবর্তন পরিলক্ষিত।

বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল ও দ্রুত বিকাশমান অর্থনীতি করোনার কারণে শিল্পে ব্যবহার্য কাচাঁমাল ও ক্যাপিটাল মেশিনারিজ আমদানি হ্রাস পেয়েছিল ব্যাপকভাবে। বেশিরভাগ র্শিল্প প্রতিষ্ঠান ও কারখানার মালিক কর্মী ছাটাই করেছেন। বাংলাদেশের বেশি সংখ্যক মানুষের স্থায়ী কোন পেশা নেই। তারা কখনো ধান কাটেন, কখনো সবজি চাষ করেন, কখনো মাছ ধরেন, কখনো দিন মজুর, কখনো বড়লোকের তল্পিবাহক হিসেবে কাজ করেন। অন্য সময় তারা চা সিগারেট খেয়ে আড্ডা দিয়ে সময় কাটান। করোনাকালীন এই ধরনের পেশার মানুষগুলো পুরোপুরি কর্মহীন ছিল। সকল ধরনের ভাসমান ব্যবসায়ী, কামার, কুমার, গৃহকর্র্মী, রাজমিস্ত্রী, রিক্সা ও ক্ষুদ্র পরিবহন চালক বিভিন্ন জিনিস সংগ্রহের টোকাইসহ সকলেই আর্থিক যুদ্ধে লিপ্ত ছিল।
করোনার কারণে একটি অর্থনৈতিক রূপান্তর ঘটেছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সংযোজিত হওয়ার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা প্রধান কিন্তু আমরা যারা রাষ্ট্রে নিজেদেরকে সচেতন বলে মনে করি, তাদের ও দায়টা কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। প্রি-কোভিড যুগে বাংলাদেশে লক্ষ লক্ষ উদ্যোক্তা সহায় সম্বলহীন হয়েছে বৃহৎ পুঁজির কাছে। মুক্ত বাজার অর্থনীতির প্রবেশ দিয়ে আমরা কোটি কোটি মানুষের আয় বাণিজ্যের শেষ অবলম্বনটুকু কেড়ে নিয়ে তুলে দিয়েছি কর্পোরেটের হাতে। এক যুগ আগেও বাংলাদেশের প্রত্যেকটা উপজেলা এবং গ্রামে বেকারি অটোমিল, ঘানিসহ অনেক প্রকার ক্ষুদ্র ও হস্তশিল্প কারখানা ছিল। ঝালমুড়ি, চানাচুর, মোয়া বিক্রি করে কোটি কোটি মানুষের জীবন জীবিকা নির্বাহ করতো। আজ প্রায় সবই চলে গেছে ১/২টি কর্পোরেটের পকেটে। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের উৎপাদন ও বাজার যদি বৃহৎ পুঁজির প্রবেশাধিকার এখনই সংরক্ষিত করা হয় তবে ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের ঢেউয়ের সঙ্গেও অভিযোজিত হতে আমাদের সমস্যা হবে না।

শিল্পী আব্বাস উদ্দিনকে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল শহুরে মানুষ কেন তার গান শোনে? উত্তরে বলেছিলেন ‘রেডিওর অপর প্রান্তে যে মানুষ বসে থাকেন তাদের প্রত্যেকেরই একটা শিকড় আছে গ্রামে’। একমাত্র শিকড়ই বৃক্ষকে বাচাঁতে পারে। ভৌগলিক কিংবা অর্থনৈতিক কারণে বাংলাদেশে প্রযুক্তির উন্নয়নের ছোঁয়া সামান্য দেরিতে পৌঁছেছে বটে, বাংলাদেশে প্রতিটি সেক্টরে ইতোমধ্যে বেড়েছে প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রত্যক্ষ প্রভাবে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে ৬৫%, কৃষিজাত শিল্পে ৪০%, আসবাবপত্র শিল্পে ৫৫%, চামড়া ও জুতা শিল্পে ২৫% কর্মহীনতা তৈরি করবে বলে বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন। আগামী দিনের অর্থনীতি, বৈদেশিক বিনিয়োগ থেকে শুরু করে রাজনৈতিক অঙ্গন ও দক্ষ মানব সম্পদ এবং উচ্চ প্রযুক্তির ব্যবহার হয়ে উঠবে বাঞ্চনীয়।

ইতিহাসে এখন পর্যন্ত তিনটি শিল্প বিপ্লব ঘটেছে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব এখনও ধারণা। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের জনক ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা ক্লাউস সোয়াপ বলেছেন, আমরা চাই না চাই, আমাদের জীবনধারা, কাজকর্ম ও চিন্তা চেতনা আগে যেমনটা ছিল এখন তার পরিবর্তন হতে শুরু করেছে। এখন আমরা এক প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করছি। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে প্রযুক্তি, ইন্টারনেট অব থিংস, রোবোটিক্স, অটোমেশনস, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ক্লাউড কম্পিউটিং ইত্যাদি। অর্থাৎ সম্পূর্ণ প্রযুক্তি নির্ভর এ ব্যবস্থা বদলে দিবে শিল্প খাত।

বাজার অর্থনীতির যে রমরমা অবস্থা বহু দশক ধরে দেখা গেছে, তার জায়গায় এক ধরনের রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদী ব্যবস্থা কিংবা অর্থনীতিতে সরকারি খাতের ব্যাপকতর অংশগ্রহণ সামনের বছরগুলোতে দেখা যেতে পারে। ভবিষ্যতে কারখানার মালিকরা উৎপাদন ব্যয় কমানোর জন্য প্রযুক্তি নির্ভরতার দিকে ঝুঁকে পড়তে পারেন। আমাদের অভ্যন্তরীণ ভোগ চাহিদা অনেক কমে যাওয়ার আশংকা রয়েছে, কারণ সাধারণ মানুষের ভোগ চাহিদা বাড়ছে না। অর্থ ব্যয় করার সামর্থ্য কমে গেলে তা দেশের উৎপাদন ব্যবস্থায় নিশ্চিতভাবে প্রভাব ফেলবে। কোভিড পরবর্তী যুগে “কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি” মুক্তির গুরুত্বপূর্ণ এবং দেশের প্রধান ও একমাত্র পথ হতে পারে। বর্তমান “নিউ নরমাল” সময়ে মানুষ বিনিয়োগের জন্য কোন ক্ষেত্রগুলোকে গ্রহণ করবে তা নিয়ে যথেষ্ট ভাবনা চিন্তা প্রয়োজন আছে। এই নতুন অর্থনৈতিক রূপান্তর শহরের অর্থনীতি তথা দেশের অর্থনীতি টিকিয়ে রাখতে গ্রামীণ অর্থনীতি পুনর্গঠন অবশ্যম্ভাভাবী।

“নিউ নরমাল ইকোনমিক্স” হবে মূলত প্রযুক্তি নির্ভর অর্থনীতি আমাদের ভবিষ্যত অর্থনীতি সচল ও সমৃদ্ব রাখতে অর্থনীতিকে যান্ত্রিক ও প্রযুক্তির মাধ্যমে ঢেলে সাজাতে হবে। উন্নয়ন শাস্ত্রে “নিউ নরমাল” বলতে মানুষের আচরণগত পরিবর্তনকে নির্দেশ করে, যে আচরণ পূর্বে অস্বাভাবিক ছিল পরবর্তী অবস্থায় তা স্বাভাবিক হিসেবেই পরিচিত হয়। “নিউ নরমাল” হলো মানুষের আচরণগত যোগাযোগের নতুন কৌশল। তবু আমরা আশাবাদী, বাংলাদেশের সাহসী ও শ্রমজীবি মানুষ এটা মোকাবেলা করতে সক্ষম হবে এবং আমাদের কাম্য হবে কার্লমার্কস ও এডামস্মিথের একটি পলিটিক্যাল ইকোনমি নয় একটি “নিউ নরমাল ইকোনমি”।

লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক

সারাবাংলা/এসবিডিই

কোভিড-১৯ ও পরিবর্তিত অর্থনীতির নতুন রূপ মত-দ্বিমত রজত রায়

বিজ্ঞাপন

নতুন বার্সেলোনায় মুগ্ধ মেসি
২৩ নভেম্বর ২০২৪ ১০:৫৫

মাদকের টাকার জন্য মা'কে খুন
২৩ নভেম্বর ২০২৪ ০৮:৫৭

আরো

সম্পর্কিত খবর