Friday 06 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

রোহিঙ্গা শরণার্থী নিয়ে বিশেষ আইন জরুরি

অর্পিতা চৌধুরী
২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৯:১০

ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় রোহিঙ্গারা বহুকাল আগে থেকেই বার্মা বা বর্তমানের মিয়ানমারে ছিলেন। কিন্তু মিয়ানমার তাদের ১৩৫টি জাতিসত্ত্বার ভেতর রোহিঙ্গাদের রাখেনি এবং তাদেরকে বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে যাওয়া অভিবাসী হিসেবে দেখে এসেছে। রাষ্ট্রের যে আধুনিক অবকাঠামো ও সীমানা তা নির্ধারিত হবার আগে থেকেই রোহিঙ্গারা আরাকানে ও রাখাইনরা চট্টগ্রামে ছিল। ২০১৭ সালে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা ও তার সাথে মদতদাতা বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর স্থানীয় লোকজন রোহিঙ্গাদের উপর অবর্ণনীয় অত্যাচার শুরু করলে দলে দলে রোহিঙ্গা বাংলাদেশ অনুপ্রবেশ শুরু করে। তৎকালীন পরিসংখ্যান অনুযায়ী এ অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যা ৯ থেকে ১০ লাখ। গত ৭ বছরে এ জনসংখ্যা আরও বেড়েছে।

প্রথমে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য অর্থ সাহায্য এলেও ২০২১ এ আসা করোনা মহামারী অনেক সাহায্যদাতা দেশ-সংস্থাকে বরাদ্দ কাটছাঁট করতে বাধ্য করে। আবারও অশান্ত হয়ে উঠেছে মিয়ানমার বাংলাদেশ সীমান্ত। ইতোমধ্যে মিয়ানমার থেকে দেশটির সীমান্তরক্ষী ৩৩০ বিজিপি সদস্য পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিলে তাদের অস্ত্র রেখে দিয়ে ফেরত পাঠায় বাংলাদেশ। এখনও শত শত রোহিঙ্গা সীমান্তে অপেক্ষমাণ অনুপ্রবেশের জন্য। তবে এবার বাংলাদেশ সীমান্ত খুলে দেয়ার বদলে পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত সামরিক জান্তা বিভিন্ন ছোট ছোট বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সাথে টিকে থাকতে না পেরে আপাতত কাচিন রাজ্যে পিছু হটেছে।

মানবিকতার কারণে প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ নিজের সীমিত ক্ষমতা ও সম্পদ সত্ত্বেও লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গাকে বিশেষ ক্ষেত্রে আশ্রয় দিয়েছে। বাংলাদেশের সীমান্ত যেসব দেশের সাথে আছে সেসব দেশ থেকে এর আগে কখনোই এত বিপুলসংখ্যক মানুষ শরণার্থী হিসেবে আসেনি এবং বাংলাদেশ জাতিসংঘের শরণার্থী আইনে কখনও স্বাক্ষরও করেনি। কিন্তু বারে-বারে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীরা আমাদের নতুন করে ভাবতে বাধ্য করেছে- জাতিসংঘের শরণার্থী আইনে কি আছে এবং কেন তা আমাদের পুনর্বিবেচনা করা উচিৎ। বাংলাদেশসহ বেশিরভাগ দক্ষিণ এশিয়ার দেশই শরণার্থী আইনে স্বাক্ষর করেনি কারণ, এ আইনটি মূলত ইউরোপকেন্দ্রিক। আফগানিস্তান ২০০৫ এ আইনে সাক্ষর করে। বাংলাদেশ ১৯৫১ সালের রিফিউজি আইনে সাক্ষর না করলেও ইউএনএইচসিআরকে আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ করতে দিয়ে পরোক্ষে এ আইনকে মেনে নিয়েছে। ১৯৯৫ সাল থেকে বাংলাদেশ

Executive Committee of the High Commissioner’s Programme (hereinafter, ExCom) এ নিজের প্রতিনিধি পাঠাচ্ছে। ২০১৭ সালে RMMRU বনাম Government of Bangladesh যে কেইস হয় সেখানে সুপ্রিম কোর্টও রিফিউজি আইনকে ভিত্তি ধরে মামলা পরিচালনা করে।

যে কয়েকটি কারণে রোহিঙ্গাদের নিয়ে ভাবা আবশ্যক হয়ে পড়েছে তার মধ্যে অন্যতম হল- শরণার্থী শিবিরগুলোতে ক্রমবর্ধমান অপরাধপ্রবণতার হার। দেখা যাচ্ছে, শরণার্থী শিবিরে বসবাসরত রোহিঙ্গারা কোনও অপরাধ করলে তাদের আইনের আওতায় আনা অনেকক্ষেত্রেই একটি প্রশ্নবিদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি করছে। মানবাধিকারের যে ধারা- সেগুলো দিয়ে হত্যার মতো অপরাধও বিবেচনায় আনতে হচ্ছে। কারণ ‘Universal Declaration of Human Rights’ যে আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের ঘোষণা দেয় সেখানে অধিকার রক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রের উপর অর্পিত হয়। যে জনগোষ্ঠী তার নির্দিষ্ট ভূ-খন্ড থেকে বিতাড়িত সেই জনগোষ্ঠীর অধিকার তাহলে কোন রাষ্ট্র দ্বারা রক্ষিত হবে? যে রাষ্ট্র তাকে শরণার্থী হিসেবে জায়গা দিয়েছে সেই রাষ্ট্র- এখন সেই রাষ্ট্রের যদি অবকাঠামোগত ক্ষমতা না থাকে তখন কি হবে? সেখানেই আসে শরণার্থী আইনের বিষয়টি। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ইউক্রেন রাশিয়ার যুদ্ধ চলছে: ইউক্রেনবাসীরা নানা দেশে রিফিউজি হিসেবে যেতে পারছে এই শরণার্থী আইন মেনেই।

আমাদের সে ধরনের কোন আইন না থাকায় রোহিঙ্গাদের নিজ ভূখন্ডে প্রত্যাবাসনের বিষয়টি সেই স্তরে জোরদার হচ্ছে না এবং রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের স্থানীয় জনগণের সাথে মিশে যাচ্ছে। রোহিঙ্গাদের জন্য আসা সাহায্য কমে যাওয়াতে তারা কাজের সন্ধানে স্থানীয়দের সাথে প্রতিযোগীতায় লিপ্ত হচ্ছে। অনেকে স্থানীয় জনগণের ভিটেমাটি কেড়ে নেওয়ার মতো কান্ডও ঘটিয়েছেন।

মানবাধিকার আইন অনুযায়ী, শরণার্থীদের পাসপোর্ট ও ফরেনার্স অ্যাক্ট দ্বারা পরিচালিত হওয়ার কথা বলা হয়েছে। পাসপোর্ট আইন অনুসারে যদি রোহিঙ্গাদের পরিচালনার বিষয় আসে তাহলে তাদেরকে পাসপোর্ট ব্যবহার করে বাংলাদেশে আসতে হবে। কিন্তু তারা তো পাসপোর্ট দিয়ে এ দেশে আসেনি। তারা যে পরিস্থিতিতে এ দেশে এসেছে এবং আশ্রয় পেয়েছে তা আন্তর্জাতিক আইন ও কনভেনশনের দৃষ্টিকোণ থেকে হয়েছে। আবার ফরেনার্স আইন অনুসারে তাদের অধিকার বিদেশি হিসেবে পরিচালিত হবে কিনা আইনে সেটিও স্পষ্ট নয়।

২০১৭ সাল থেকে আসা রোহিঙ্গাদের অনেকেই বাংলাদেশে সন্তানের জন্ম দিয়েছে। নতুন জন্ম নেওয়া এ শিশুরা কোন দেশের নাগরিক হিসেবে বিবেচিত হবে সে বিষয়টিও মানবাধিকার আইন অনুযায়ী পরিষ্কার নয়। এমতাবস্থায় ইউরোপভিত্তিক রিফিউজি আইনে যদি বাংলাদেশ স্বাক্ষর না-ও করে বাংলাদেশের সময় এসেছে নিজের ভূখন্ড ও আইন অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের নিয়ে ভাবার। এক্ষেত্রে একটি দৈনিক পত্রিকা গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করলে সেখানে বক্তারা বলেন-

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারপারসন অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, ‘তিনটি উপায় আছে সমস্যা সমাধানের। স্বেচ্ছা প্রত্যাবাসন, তৃতীয় দেশে তাদের অন্তর্ভুক্তিকরণ এবং বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্তিকরণ। অদূর ভবিষ্যতে আমরা স্বেচ্ছা প্রত্যাবাসনের কোনও সম্ভাবনা দেখি না। তৃতীয় দেশে রোহিঙ্গাদের অন্তর্ভুক্তিকরণের যে বিকল্প, তাতে ৭২ জনকে নিয়ে বড় করে দেখানো হচ্ছে। স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের সঙ্গে অন্তর্ভুক্তিকরণের প্রক্রিয়া এখনই শুরু হয়ে গেছে। আমরা কি এটা বন্ধ করে দিতে পারি? তাহলে তা হবে মানবাধিকার হরণ।’

শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার সুরক্ষার কথা বলে বাংলাদেশের ঘাড়ে সবকিছু চাপানোর একটা চেষ্টা আমরা দেখি। মিয়ানমারে যেখানে তাদের ডি-হিউম্যানাইজ করা হয়েছে, রাষ্ট্রীয় মদদে গণহত্যা হয়েছে, তখন তো তাদের কাছে ভালো কিছু আশা করি না। রোহিঙ্গাদের জন্য যৌথ সাড়াদান পরিকল্পনা বা জেআরপিতে ২০২২ এসেছে মাত্র ৪৮ শতাংশ। জেআরপির তহবিল পেলে তাদের খাবারের বিষয়টি নিশ্চিত হবে। এটা কিন্তু মানবাধিকার।’

মিজানুর রহমান বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের অন্তর্ভুক্তিকরণ বিষয়টি চলছে। বিয়ে হচ্ছে। শিবিরের বাইরে তারা যাচ্ছে। আমরা তো মিয়ানমার নই যে তাদের গলায় দড়ি দিয়ে আটকে রাখব। আমরা অন্তর্ভুক্তিকরণ চাই না। এমনকি তৃতীয় দেশে পাঠানোও কোনো সমাধান নয়। আমাদের একমাত্র লক্ষ্য প্রত্যাবাসন।’

এখন এই প্রত্যাবাসন সহসা না হলে আমাদের করণীয় কী? আমাদের করণীয় রোহিঙ্গাদের জন্য আমাদের দেশের উপযোগী আইন প্রচলন করা। অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনির রোহিঙ্গাদের বিষয়ে বলেন- অধিকার এবং দায়িত্ব এ দুটোর সংমিশ্রণ করলে রোহিঙ্গাদের জন্য যে আইন তৈরী করা হবে সেই আইনটির গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে । তবে আইন না করলেও কিছু বিধি নিষেধ তৈরি করা যেতে পারে।

আসিফ মুনির আরও বলেন, ‘আইন এবং বিধির ক্ষেত্রে জাতিসংঘের মানবাধিকার ঘোষণাপত্রের ধারা সেইসঙ্গে আন্তর্জাতিক আইনের কিছু ধারাকে সন্নিবেশিত করা যেতে পারে। তবে খেয়াল রাখতে হবে আমাদের সাংবিধানিক অধিকার ও দায়িত্বগুলো তাদের ক্ষেত্রে যেন সাংঘর্ষিক না হয়।’

যুগে যুগে দেশে দেশে যুদ্ধ বিগ্রহ একটি নির্মম কিন্তু স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। আমরা যতই সভ্যতার দুদ্ধুভি বাজাই না কেন রক্তপাত, জাতিগত বিদ্বেষ রয়েছে মানুষ নামের প্রাণীর রন্ধ্রে রন্ধ্রে। রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা আমাদের সেই রাজায় রাজায় যুদ্ধ ও সম্পদের ভাগ নিয়ে নেওয়ারই একটি প্রমাণ মাত্র। বাংলদেশকে তাই তার নিজের সার্বভৌমত্ব, মর্যাদা ও অধিকার অক্ষুণ্ণ রেখে রোহিঙ্গাদের জন্য যুগোপযোগী আইন তৈরী করতে হবে। তাহলে ক্রমবর্ধমান রোহিঙ্গাদের আইনি অধিকার রক্ষা করা ও তাদের করা কাজের জন্য তাদেরই দায়বদ্ধ করা সহজ হবে।

লেখক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট

সারাবাংলা/এসবিডিই

অর্পিতা চৌধুরী মত-দ্বিমত রোহিঙ্গা শরণার্থী নিয়ে বিশেষ আইন জরুরী


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

ধানমন্ডি থেকে গ্রেফতার শাজাহান খান
৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০২:৪৫

সম্পর্কিত খবর