Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

স্বাভাবিক মৃত্যুর লেটেস্ট গ্যারান্টি

মোস্তফা কামাল
২ মার্চ ২০২৪ ১৭:৫৭

বনানীর এফ আর টাওয়ারে আগুনকাণ্ডের পর মন্ত্রী -মেয়র মিলে ‘আইন ভেঙে ভবন নির্মাণকারীদের বিরুদ্ধে ইতিহাসের কঠোরতম পদক্ষেপ নিয়ে ১৫ দিনের মধ্যে সব ঠিক করে ফেলার’ বজ্রকঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সেই ১৫ দিন হতে বছর কয়েক বাকি। পনেরো বছর হওয়ার আগেই এখন বেইলি রোডের বহুতল ভবনে আরো হৃদয়বিদারক ঘটনা। মন্ত্রী-মেয়র ছাড়াও রাজউকসহ কয়েকটি সংস্থার সাহেবদের এখন আবার ইস্পাত কণ্ঠ। আর বরদাস্ত না করার ধমক। সঙ্গে ঠমকও। তবে, দায় নেয়ার কেউ নেই। এর মাঝে আবার যারা মরেছে তাদেরই দায়ী করার একটি প্রবণতা লক্ষীয়। তারা কেন গেল সেখানে? যাওয়ার আগে দেখবে না ? সারকথা মৃতরাই মৃত্যুর জন্য দায়ী।

বিজ্ঞাপন

আইনের তেমন অভাব নেই। কেবল রেস্টুরেন্ট নয়, ছোটখাট মুদি বা স্টেশনারি দোকান বসাতেও বেশ কয়েকটি কর্তৃপক্ষের লাইসেন্স বা সনদ নিতে হয়। এনওসি বা নো অবজেকশন সিগনাল নিতে হয়। তবে, কোনো ভবনে কতোগুলো রেস্টুরেন্ট করা যাবে- তার কোনো বাধাধরা নীতিমালা নেই। তবে, অঘটনের পর জানানো হয় বিল্ডিং কোড মানেনি, ফায়ার সেফটির আয়োজন ছিল না, ফায়ার এক্সিটের ব্যবস্থা ছিল না। এবার আরো শোনা যাচ্ছে কাচ্ছি ভাই নামে জমে ওঠা রেস্টুরেন্ট ও ভন মালিককে অন্তত তিনবার নোটিশ দেয়া হয়েছিল । তাই একে একবাক্যে বিনানোটিশে মৃত্যু বলা যায় না। বলা হয়ে থাকে, মৃত্যুর কোনো নোটিশ বা গ্যারান্টি থাকে না। টাইমটেবিল বা ঠিক ঠিকানা থাকে না। সেই বিবেচনায় বেইলি রোড়ে মৃত্যুর ঘটনার নোটিশ ছিল, মানে মৃত্যসহ আগুন কাণ্ডটি ঘোষিত। ভবনে কোনো অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ছিল না। মানুষের আসা–যাওয়ার জন্য কেবল একটি সিঁড়ি ছিল। ভবনটি একটি টাইম বোমার মতো, ভেন্টিলেশনের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। কোনো বিপৎকালীন আলাদা বহির্গমন পথ ছিল না।

বিজ্ঞাপন

ভবনটির নিচতলা বাদে উপরের তলাগুলোর ভেতরের নকশা কোনোভাবেই বাণিজ্যিক কাজের উপযুক্ত নয়। বিষয়টি কি কখনো তদারকি করা হয়েছিল? সেখানে কি কখনো অগ্নি দুর্ঘটনার মহড়া হয়েছিল? আসলে ঢাকা শহরে বহুতল ভবনগুলোতে এমন মহড়া কয়টা হয়? ফলে এসবের অভাবে বা অবহেলায় একটি দুর্ঘটনা কতটা ভয়াবহ হতে পারে, তা আবারও আমরা দেখলাম বেইলি রোডে। এর আগে গত কয়েক বছরে আরও ঢাকা শহরের আরও কয়েক জায়গায়। অন্যান্য ঘটনার মতো বেইলি রোডের ঘটনাও তামাদি প্রায়। মৃতদের দাফন হয়ে গেছে। তদন্ত কমিটি গঠন, লেখালেখি, কলাম-টকশো, বিশেজ্ঞ মতামত হয়েছে যথেষ্ট। গণমাধ্যমে আরো নানা সাবজেক্ট চলে এসেছে। আট তলা ভবনটির শুধু আটতলায় আবাসিক স্থাপনার অনুমোদন আছে। এক থেকে সাততলা পর্যন্ত বাণিজ্যিক অনুমোদন। তবে তা শুধু অফিসকক্ষ হিসেবে ব্যবহারের জন্য। রেস্তোরাঁ, শোরুম বা অন্য কিছু করার জন্য অনুমোদন নেওয়া হয়নি। রেস্তোরাঁ করার অনুমোদনই ছিল না বলে জানিয়েছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-রাজউক। অথচ ভবনটিতে রেস্তোরাঁ ছিল আটটি। একটি জুস বার, একটি চা-কফি বিক্রির দোকানও ছিল। মুঠোফোন ও ইলেকট্রনিকস সরঞ্জাম এবং পোশাক বিক্রির দোকানও ছিল।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের তথ্য হচ্ছে- আগুনের সূত্রপাত নিচতলা থেকে। ভবনে অনেকগুলো গ্যাস সিলিন্ডার থাকায় সেগুলো বিস্ফোরিত হয়ে দ্রুত আগুন ছড়িয়ে যায়। পরিণতিতে যা হবার হয়েছে। একদিকে আগুনপোড়া ৪৬ জনের দাফন, আরেকদিকে একটু দূরে বইমেলায় হাস্যবদনে সাজুগুজুতে মোজ-মাস্তি, অফিসার্স ক্লাবে বিজয়ী বরেণ্যদের আনন্দ- আড্ডা, অভিনন্দনের ঝড়, শরীর ঠিক রাখতে রমনা পার্কে গ্রুপে –গ্রুপে জগিং, অসংখ্য পিকনিকে ছুটে চলা কিছুই বাদ যায়নি। এমন কি কাচ্চি ভাইর আশপাশের রেস্টুরেন্টগুলোও ঠিক মতোই চলেছে। ভয়াবহ এ অগ্নিকাণ্ডের প্রেক্ষিতে শুক্রবার দিনটিতে পুলিশ সপ্তাহর মতবিনিময় সভা ছাড়া আর কিছু বাতিল বা না করার খবর চোখে পড়েনি। এটাই নিষ্ঠুর বাস্তবতা, সবই স্বাভাবিক। এ শহর তো মৃতদশায় অনেক আগ থেকেই। একে একে হারিয়ে গেছে খোলা মাঠ। কথিত উন্নয়নের জেরে জলাশয়গুলো হারিয়ে গেছে। আকাশ ডেকেছে জিডিপিতে। নিঃশ্বাসের সাথে বিষাক্ত বাতাস, শহরের চারপাশে অন্তহীন কালো অন্ধকার। সবুজ ঘাসে পা ছড়িয়ে গল্প করার মতো এক চিলতে পরিসরও থাকছে না।

এসব রেস্টুরেন্টে কাঁচঘেরা ঘর। আগুন লাগলে কাচের ভবন দ্রুত আগ্নেয়গিরি হয়ে ওঠে। বাতাস বের হতে না পারায় আগুন ও ধোয়া নিমেষেই উপরের দিকে ছড়িয়ে পড়ে। কাচঘেরা একেকটা বহুতল ভবন যেন একেকটা মৃত্যুকূপ। মোটকথা অগ্নিকাণ্ড ঘটলে অসংখ্য মানুষের হতাহত হওয়ার সব ‘ব্যবস্থা’ সেখানে করাই ছিল। একে তো কাচঘেরা ভবন তারপর সিঁড়িতে রাখা ছিল গ্যাস সিলিন্ডার। আগুন লাগার পর সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হওয়ায় উপরে ওঠার কিংবা বেরিয়ে যাওয়ার কোনো পথ ছিল না। ভবনটিতে কোনো অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল না। ঝুঁকিপূর্ণ জানিয়ে ভবন কর্তৃপক্ষকে তিনবার চিঠি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সেই রাতের বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মৃত্যুর কারণ ‘কার্বন মনোক্সাইড পয়জনিং’, সহজ ভাষায় যাকে বিষাক্ত ধোঁয়া বলা যায়। সেই বিবেচনায় হোটেল-রেস্টুরেন্ট বা কনো পরিসরে গিয়ে মরে যাওয়া আর দুর্ঘটনার মধ্যে পড়ছে না। এগুলো স্বাভাবিক মৃত্যুর মতোই। হাসপাতালে ভর্তিদের অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাদের অনেকের শ্বাসনালি পুড়েছে। বোবা হয়ে ট্রমায় পড়ে আছেন অনেকে।

রাজধানী ঢাকার জনসংখ্যা দুই কোটি ছাড়িয়ে গেছে। এই মানুষগুলোর জন্য কোথাও কোনো খোলা জনপরিসর নেই। কোথাও কারো সঙ্গে দেখা করে দুটো কথা বলার জায়গা নেই। ঢাকার মানুষ তাহলে কোথায় যাবে? গোছালো পরিবেশে কিছুটা সময় বন্ধু, পরিজনদের সঙ্গে দেখা করার, আড্ডা দেওয়ার, কথা বলার বা গেট টুগেদারের একটা সুযোগ তৈরি হয়েছে। আবার অনেকের আর্থিক সামর্থ্য কিংবা ব্যয় করার অভ্যস্ততা পরিবর্তন হওয়ায় নতুন ধরনের রেস্তোরাঁর শিল্প দ্রুত বিকাশ হচ্ছে। বেইলি রোড, খিলগাঁও, সাত মসজিদ রোড, ধানমন্ডি, বনানী এখন রেস্টুরেন্ট হাব। সুবেশী সব কর্মী। ইংরেজি-বাংলা মিশিয়ে আন্তরিকভাবে তারা কথা বলেন। আমাদের ছেলেমেয়েদের সেখানে নিয়ে যাচ্ছি। সুন্দর করে সাজানো গোছানো সব রেস্টুরেন্ট। এত এত আয়োজন, কোথাও কোনো কৃপণতা নেই। গ্যাসসিলিন্ডারে ভরা এসব রেস্টুরেন্ট এক একটা মৃত্যুকূপ। কোথাও কোথাও সিঁড়ি থাকলেও সেগুলো কাস্টমারদের জন্য নয়। রেস্টুরেন্টের মালসামানা রাখার জন্য। কাস্টমারদের এতো কিছু দেখারই বা সময় কই!

শুধু রেস্তোঁরা কেন, এর আগে এমন অনেক ঘটনা ঘটেছিল। বসুন্ধরা সিটির মত অত্যাধুনিক ভবনেও আগুন হানা দিয়েছিল, বনানীর সুউচ্চ আধুনিক ভবনে আগুন লেগে অনেক মানুষ হতাহত হয়েছিল, বঙ্গবাজার পুড়ে ছাই হয়েছে। নারায়ণগঞ্জের মসজিদে আগুন লেগে ৪০ জনের উপর মুসুল্লি মারা গিয়েছিল! একেক ঘটনার প্রেক্ষাপট একেকরকম। মৃত্যুর আয়োজন একই। বিদ্যমান ব্যবস্থায় এ ধরনের মৃত্যু বন্ধ হয় না, হবে না। আর যার যার মৃত্যুর জন্য সে নিজেই দায়ী হবে। নোটিশ ছাড়া মরছে না, সেটা নিশ্চিত হয়েছে। ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই’ শিরোনামে বহু বছর আগে একটি উপ-সম্পাদকীয় লিখে ব্যাপক আলেঅচিত হয়েছিলেন, বাম প্রগতিশীল নেতা, বিশিষ্ট সাংবাদিক নির্মল সেন। এতো বছরে ধীরে ধীরে তার সেই শিরোনামের আকুতি ফলতে শুরু করেছে। সব মৃত্যুই যেন এখন স্বাভাবিক।

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট

সারাবাংলা/এজেডএস

মোস্তফা কামাল স্বাভাবিক মৃত্যুর লেটেস্ট গ্যারান্টি

বিজ্ঞাপন

বরিশালে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ২
২৩ নভেম্বর ২০২৪ ১৭:৩১

বাঘায় কৃষককে গলা কেটে হত্যা
২৩ নভেম্বর ২০২৪ ১৬:৪৩

আরো

সম্পর্কিত খবর