ব্যাংক খাতের সংস্কার ও আর্থিক সুশাসন
৫ মার্চ ২০২৪ ১৩:০৪
কোনও এক সকালে যদি সব আমানতকারী গচ্ছিত ধনরাশি ফেরত চান, পৃথিবীর সেরা ব্যাংকেরও লালবাতি জ¦লবে। কারণ গ্রাহকদের জমা রাখা আমানত থেকেই তো ব্যাংক ঋণ দিয়েছে। দীর্ঘ মেয়াদের সে সব ঋণ তো চাওয়া মাত্রই ফেরত পাওয়া যাবে না, তাহলে উপায়?
ডায়মন্ড-ডিবভিগের উল্লিখিত পেপারে এবং ডায়মন্ড একক ভাবে ২০০৭ সালে ইকনোমিক কোয়ার্টারলি-তে প্রকাশিত ‘‘ব্যাংকস অ্যান্ড লিকুইডিটি ক্রিয়েশন অ্যা সিম্পল এক্সপোজিশন অব দ্যা ডায়মন্ড ডিবভিগ মডেল” শিরোনামের প্রবন্ধে এই সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে, সরকারের আমানত বিমা প্রকল্প ব্যাংককে দেউলিয়া হওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে পারে। গ্রাহকরা যদি জানেন যে, কোন ব্যাংক কখনও ফেল করতে পারে না, তাহলে সেই ব্যাংক সত্যিই কখনও দেউলিয়া হবে না। প্রশ্ন হল সেই বিশ^াস আসবে কী করে? এর সহজ রাস্তা আমানত বীমার ভরসা। অথবা, সরকার নিজেই যদি সেই ভরসা দেয়। আর ব্যাংক রাষ্ট্রায়াত্ত করণের পিছনে অন্যতম উদ্দেশ্য কিন্তু সেই ভরসার জায়গা তৈরি করা।
আর্থিক সম্পদ ধারণ করা সমস্ত ব্যাংকিংয়ের মূল বিষয় এবং যেখানে এটি প্রাচীনকালে শুরু হয়েছিল – যদিও এটি ধনী পৃষ্টপোষকদের জন্য স্বর্ণমুদ্রা সংরক্ষণের চেয়ে অনেক বেশি বিস্তৃত হয়েছে। সবচেয়ে মৌলিক স্তরে, একটি ব্যাংক ব্যক্তি বা ব্যবসার কাছ থেকে আমানত নেয়, এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে যে আমানতকারী যখন এটি চায় তখন টাকা প্রত্যাহার করা যেতে পারে (যদিও কখনও কখনও তাড়াতাড়ি তোলার জন্য জরিমানাসহ) । অ্যাকাউন্টের প্রকারের উপর নির্ভর করে, ব্যাংক আমানতকারীর অর্থের উপর সুদও দিতে পারে। ব্যাংকগুলো তাদের অর্থ ব্যবহারের জন্য আনানতকারীদের যে সুদের হার দেয় এবং তারা ঋণ গ্রহীতাদের যে উচ্চ সুদের হার নেয় তার মধ্যে পার্থক্যের ভিত্তিতে মুনাফা করে। বেশিরভাগ দেশে ব্যাংকগুলির র্যাঙ্কিং কার্যক্রম পরিচালনা করতে এবং সরকারি ব্যাকস্টপ সুবিধাগুলির জন্য যোগ্য হওয়ার জন্য একটি সনদের প্রয়োজন হয়। যেমন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে জরুরী ঋণ এবং একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ পর্যন্ত ব্যাংক আমানত বীমা করার সুস্পষ্ট গ্যারান্টি। ব্যাংকগুলি তাদের দেশের আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় এবং সাধারণত নিয়মিত তত্ত্বাবধানে থাকে। যদি ব্যাংকগুলি বিদেশে সক্রিয় থাকে, তবে সেগুলি আয়োজক দেশ দ্বারা ও নিয়ন্ত্রিত হতে পারে। বিঘœ কমাতে সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংকগুলিতে হস্তক্ষেপ করার জন্য নিয়ন্ত্রকদের ব্যাপক ক্ষমতা রয়েছে।
একটি বড় সংখ্যক লোক একটি ব্যাংক থেকে টাকা তোলা শুরু করলে তখন তারা ভয় পায় যে প্রতিষ্ঠানের অর্থ ফুরিয়ে যাবে। একটি ব্যাংক রান সাধারণত প্রকৃত দেউলিয়া হওয়ার পরিবর্তে আতঙ্কের ফলাফল। যাই হোক, ভয়ের দ্বারা চালিত একটি ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে যেতে পারে। একটি ব্যাংক রান হলো যখন কোনও ব্যাংক বা অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকরা ব্যাংকের স্বচ্ছলতা সম্পর্কে ভয়ে একই সময়ে তাদের আমানত প্রত্যাহার করে। যত বেশি লোক তাদের তহবিল প্রত্যাহার করে, ডিফল্ট হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়, যার ফলে, আরও বেশি লোক তাদের আমানত প্রত্যাহার করতে পারে। চরম ক্ষেত্রে, ব্যাংকের রিজার্ভ উত্তোলন কভার করার জন্য যথেষ্ট নাও হতে পারে।
তারল্য ঝুঁকি বৃহত্তর অর্থনীতিকে প্রভাবিত করতে পারে। তারল্য ঝুঁকি বৃহত্তর অর্থনীতি জুড়ে প্রবল প্রভাব ফেলতে পারে। উদাহরণস¦রুপ, একটি আর্থিক সংকটের সময়, প্রধান আর্থিক প্রতিষ্ঠানে তারল্য সমস্যা ক্রেডিট সংকটের দিকে নিয়ে যেতে পারে। যেখানে ঋণ দেয়া সীমিত হয়ে যায়, যার ফলে ব্যবসা, ভোক্তা এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক বৃদ্ধি প্রভাবিত হয়। একইভাবে, বড় কর্পোরেশনগুলিতে তারল্য সমস্যা চাকরি হারাতে পারে, ভোক্তাদেরও ব্যয় হ্রাস করতে পারে এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা হ্রাস পেতে পারে।
অর্থব্যবস্থায়, বিশেষ করে আর্থিক সংকটের সময়ে, ব্যাংকের ভূমিকা কী? এক বিষয়টি আরও বুঝতে যে বিষয়টি মূল আলোচ্য তা হলো আসলে ব্যাংকের সৃষ্টিতত্ত্বের মধ্যেই তার মরণ বীজ লুকিয়ে থাকে। আধুনিক ব্যাংক গ্রাহকদের নানা ধরণের পরিষেবা দিয়ে থাকে। তবে ব্যাংকের মূল ব্যবসা ঋণ দেওয়া নেওয়ার। ব্যাংকের কাছে আমরা সঞ্চয় গচ্ছিত রাখি। তার বিনিময়ে ব্যাংক আমাদের একটি পূর্ব-ঘোষিত কিন্তু, সময়ে-সময়ে পরিবর্তনযোগ্য হারে সুদ দেয়। গ্রাহকরা চাইলে তাদের সেভিংস অ্যাকাউন্ট থেকে যে কোনও সময় আমানত তুলতে পারেন। আমানতকারীদের সুদ মেটাতে গেলে ব্যাংকের আয় চাই। সেই আয় আসে ব্যাংক ঋণ থেকে। লগ্নিকারীদের মূলধনের প্রধান উৎস হচ্ছে ব্যাংক থেকে নির্দিষ্ঠ সুদের বিনিময়ে ঋণ। আমরা বাড়ি গাড়ি ক্রয় করতে বা অন্য কোনও কারনেও ঋণ নেই। ব্যাংকের কাছে গচ্ছিত আমানত হচ্ছে ব্যাংকের লায়াবিলিটি বা দায় পুরোটাই ‘লিকুইড’ মানে যে কোনও সময়ে নগদে সম্পূর্ন পরিবর্তনযোগ্য। ব্যবসার ধরণটাই এমন হওয়ার ফলে ব্যাংকের সামনে বরাবর দেউলিয়া হওয়ার ঝুঁকি থেকেই যায়।
এক বছরে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণ বাড়ছে তাহলে কি কর্পোরেট সুশাসনের অভাব? ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাচ্ছে। ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপিদের পরিমাণও অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন নীতিমালা তৈরি করে ব্যাংকে সুশাসন ফেরানোর তাগিদ দিচ্ছে। সঞ্চিত সংরক্ষণের হার বাড়ানোর পাশাপাশি খেলাপি ঋণ গণনার মেয়াদও আন্তর্জাতিক মানদন্ডে উন্নীত করতে যাচ্ছে। এসব কারণে ব্যাংকের প্রকৃত মুনাফা বাড়ছে না।
বিশ্লেষকদের মতে, খেলাপি ঋণ পরিশোধে সহনশীলতা ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঋণ পুনঃতফসিল করার শিথিল নীতি নন- পারফমিং ঋণের (এনপিএল) বাড়তে থাকা ধারার ওপর রাশ টেনে ধরতে পারেনি, কেন্দ্রীয় ব্যাংক সম্প্রতি ঋণ পুনঃ তফসিল করার নীতি আরও শিথিল করেছে। খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমানোর জন্য এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশ ‘সিস্টেম্যাটিক রিস্ক ড্যাশবোর্ড’ শীর্ষক প্রকাশনায় সর্বশেষ সংখ্যার তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের জুন শেষে দেশের ব্যাংক খাতের আয় ব্যয়ের অনুপাত ছিল ৭১ শতাংশ। যা ২০২২ সালের জুন মাসে ছিল এ অনুপাত ৫৭ শতাংশ। একটি ব্যাংকের প্রতি ১০০ টাকা আয়ের জন্য কত ব্যয় করতে হয় সেটিকেই আয়-ব্যয়ের অনুপাতের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, দেশের ব্যাংকগুলোর প্রতি ১০০ টাকা আয়ের বিপরীতে ৭১ টাকা ব্যয় হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে পরিচালনা মুনাফা হিসাবে থাকছে মাত্র ২৯ টাকা। এ মুনাফার বিপরীতে আবার ৩৭ দশমিক ৫০ থেকে ৪০ শতাংশ পরিশোধ করতে হয় সরকারের কর হিসাবে। এছাড়া রয়েছে খেলাপি ঋণের বিপরীতে সঞ্চিতি সংরক্ষণের চাপ। ব্যয় বেড়ে যাওয়ার অর্থ হলো ব্যাংকগুলো বড় অংকের পরিচালন আয় করেও নিট মুনাফা গড়ে তুলতে না পারা। তাহলে? আন্তর্জাতিক মানদন্ড অনুযায়ী কোনো ব্যাংকের আয় ব্যয় অনুপাত ৪০ শতাংশের নিচে হলে সেটিকে সন্তোষ জনক হিসেবে ধরা হয়।
আমাদের নন-পারফর্মিং ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। সম্প্রতি আন্তজার্তিক মুদ্রা সংস্থা (আইএমএফ) জানিয়েছে, নন-পারফর্মিং ঋণের পরিমান বাড়তে থাকলে তা প্রবৃদ্ধির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি তার নিজস্ব বোধ ও বুদ্ধিমতো মুদ্রানীতি প্রণয়ন করতে পারে, তাতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর তাদের সম্পদ ও দায়ের মধ্যে একটি সুষম ভারসাম্যের পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। এমন আদর্শ পরিস্থিতিতে আর্থিক সংকট বা মন্দার মতো ভয়াবহতা অনেকটা কাটিয়ে ওঠা যায়। তাই, ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ ও স্বাধীনতার মধ্যে অবশ্যই ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। যা একটি দেশের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক চাপেও পরিবর্তিত হবে না।
লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক
সারাবাংলা/এসবিডিই