হাঁস শিকার ষড়যন্ত্র ও অভূতপূর্ব গণজাগরণ
২১ মার্চ ২০২৪ ১৬:৪৮
সমৃদ্ধ সিন্ধু সভ্যত গোড়াপত্তন নীলনদকে কেন্দ্র করে। ভারত-পাকিস্তানে বিস্তৃত এই নদের তীরে যেসব শহর গড়ে উঠেছে সেগুলোর মধ্যে অন্যতম পাকিস্তানের লারকানা। দেশটির সিন্ধু প্রদেশের অন্যতম সৃমদ্ধ ও গুরুত্বপূর্ণ শহর এটি। হাজার মাইল দূরের এই শহরটির সাথে বাঙালি জাতির স্বাধীনতা আন্দোলনের এই গুরুত্বপূর্ণ এক অধ্যায় জড়িয়ে আছে। কারণ এই শহরেই চূড়ান্ত হয়েছিল শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের বদলে বাঙালি নিধনযজ্ঞের নীলনকশা।
পাকিস্তানি রাজনীতির এক বড় চরিত্র ক্ষমতালিপ্সু জুলফিকার আলী ভুট্টো। যিনি এই লারকানার নবাব হিসেবে পরিচিত। ভুট্টো ছিলেন লারকানার বিখ্যাত জমিদার পরিবারের উত্তরাধিকারী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষা শেষে তিনি পাকিস্তানের রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছিলেন। ১৯৫৮ সালেই হয়েছিলেন পাকিস্তানের সর্বকনিষ্ঠ মন্ত্রী। এরপর আইয়ুব ও ইয়াহিয়া খানের মন্ত্রিসভাতেও ছিলেন। উচ্চভিলাষী ভুট্টো ১৯৬৭ সালে গঠন করেন পাকিস্তান পিপলস্ পার্টি। ১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচনে ভুট্টো ছিলেন দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা। ফলাফল নির্ধারণী এই নির্বাচনে পূর্ব-পশ্চিম পাকিস্তান মিলে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগ। নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে যে দলটির’ই সরকার গঠনের কথা। নির্বাচনের পর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান অন্তত দুইবার সাংবাদিকদের সাথে কথা বলার সময় শেখ মুজিবুর রহমানকে আগামী দিনে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। নির্বাচনী ফল অনুযায়ী ক্ষমতা হস্তান্তরে আপাতদৃষ্ঠিতে ইয়াহিয়া খানকে কিছুটা আগ্রহী মনে হলেও ভুট্টোর চিন্তা ছিল ভিন্ন। ক্ষমতার প্রশ্নে ভুট্টো ছিলেন কঠোর, কট্টর, কুচক্রী ও প্রবলভাবে বাঙালি বিদ্বেষী। বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে বিরোধী দলীয় নেতার চেয়ারে বসার কোনো আগ্রহ বা ইচ্ছে ভুট্টোর ছিল না। আর এজন্যেই ছয় দফাকে সামনে নিয়ে আসে ভুট্টো। ভুট্টো বাঙালির মুক্তির এই সনদকে বিচ্ছিন্নতাবাদের সনদ বলে অভিহিত করেন। ছয় দফার প্রশ্নে ভুট্টো ছিলেন আপোষহীন। যে কারণে ছয় দফা অনুযায়ী শসনতন্ত্র প্রণয়নে ভুট্টো কট্টর বিরোধিতা শুরু করেন। এ সময় তাঁর সাথে ছিলেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ জেনারেল।
সব গোয়েন্দা প্রতিবেদনকে মিথ্যা প্রমাণ করে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ভূমধস বিজয় পান শেখ মুজিবুর রহমান। পাকিস্তানের ইতিহাসের প্রথম এই জাতীয় নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পরপরই শুধু হয় পশ্চিম পাকিস্তানের ষড়যন্ত্র। যে কূটচক্রের ফলাফল নির্ধারণী বৈঠক হয়েছিল ভুট্টোর লারকানার সেই জমিদার বাড়িতে। জাতীয় নির্বাচনের পর ১৯৭১ সালের ১১ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এসে শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে সাক্ষাৎ করেন। অবিলম্বে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ও শাসনতন্ত্র নিয়ে আলাপ হয় শেখ মুজিব ও তাঁর সহযোগিদের সাথে। মুজিবের সাথে ইয়াহিয়া খানের এই বৈঠকটি সৌহার্দপূর্ণ ছিল না। দীর্ঘ সাত ঘন্টার বৈঠকে তারা কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেননি। অনেকেই তাদের বৈঠককে হতাশাব্যাঞ্জক বলে অভিহিত করেছেন। এরপরই ঘটনার নাটকীয় মোড়। করাচী ফিরে হঠাৎই ভুট্টোর আতিথ্য গ্রহণ করেন ইয়াহিয়া খান। ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ দলবলে লারকানায় যান পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট। এ সময় তাঁর সাথে ছিলেন সেনাপ্রধান জেনারেল হামিদ, প্রধান স্টাফ অফিসার লে.জে. পরীজাদাসহ পাকিস্তানি শীর্ষ সেনা কর্মকর্তারা। রাজনৈতিক ক্রান্তিকাল দেশের দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ট দলের নেতার বাড়িতে এমন আতিথ্য গ্রহণ নিশ্চিতভাবেই দৃষ্টিকটূ ছিল। এই সফরের প্রকাশ্য উদ্দেশ্য ছিল পিপিপি প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টোর পৈত্রিক বাড়িতে হাঁস শিকার করা। যদিও ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, হাঁস শিকারের আড়ালে ক্ষমতা হস্তান্তরের বদলে চূড়ান্ত হয়েছিল শক্তি প্রয়োগের সিদ্ধান্ত। এই লারকানাতেই গণহত্যা চালিয়ে বাঙালি জাতিকে পদানত করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ছিলেন হাঁস শিকারী পশ্চিম পাকিস্তানিরা। বিভিন্ন সংবাদ প্রতিবেদন ও পাকিস্তানি জেনারেলদের লেখায় উঠে এসেছে, লারকানার ঐ মহাভোজের পর ভুট্টো খুবই উচ্ছ্বসিত ছিলেন। কারণ এই বৈঠকেই সংখ্যাগরিষ্টদের নেতা শেখ মুজিবকে পাশ কাটিয়ে ভুট্টোকে কাছে টেনে নেন পাকিস্তানি জেনারেলরা। যার ফলে ছয় দফা প্রশ্নে ভুট্টো আরও কট্টর অবস্থানে চলে যান।
লারকানায় ভুট্টো-ইয়াহিয়া আঁতাতের পরই পরিস্থিতি দ্রুত বদলে যেতে শুরু করে। লারকানার ঐ বৈঠকের এক সপ্তাহ পরেই ৩ মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া গণপরিষদের অধিবেশন স্থগিত করেন ইয়াহিয়া খান। শুরু হলে ষড়যন্ত্রের চূড়ান্ত রূপ দেওয়ার প্রক্রিয়া। এখানে একটি বিষয় লক্ষ্যনীয়, শেখ মুজিব ছিলেন সংখ্যাগরিষ্ট দলের নেতা কিন্তু তারপরও অধিবেশন স্থগিত করার আগে তাঁকে কিচ্ছুই জানানো হয়নি। এখানেই পরিষ্কার হয়ে যায়, ইয়াহিয়া-ভুট্টো নতুন কোনো চক্রান্ত করেছেন। যাই হোক, অধিবেশন স্থগিত হওয়ার পরই বাংলার শহর-বন্দর-গ্রামে শুরু হয় অভূতপূর্ব গণআন্দোলন। তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা-মেঘনা-যমুনা, ঢাকা না পিন্ডি, ঢাকা ঢাকা- এইসব শ্লোগানে তখন প্রকম্পিত সারাবাংলার আকাশ-বাতাস। যে আন্দোলনের ¯্রােতে পাকিস্তানি শাসন কাঠামো পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়ে। শেখ মুজিব পরিণত হন ডি-ফ্যাক্ট লিডারে। অন্যদিক পাকিস্তানিরাও বসে থাকেনি। গণহত্যার নীলনকশা বাস্তবায়নে সিভিল ড্রেসে বেসামরিক বিমানে সেনা আসতে থাকে। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর রিয়াল এ্যাডমিরাল আহসানকে প্রত্যাহার করে তাঁর স্থানে নিয়োগ দেওয়া হয় বেলুচিস্তানের কসাই খ্যাত টিক্কা খানকে।
এদিকে পহেলা মার্চ থেকেই ঢাকাসহ সারাদেশ অগ্নিগর্ভ। শেখ মুজিব ২ মার্চ হরতালের ডাক দেন। ৭ই মার্চ উচ্চারণ করেন বাঙালির মুক্তির অমর বাণী। সাথে চলতে থাকে অহিংস অসহযোগ। এ সময় সামরিক আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো হয়। পরিবহন সেবা অচল হয়ে পড়ে। মুজিবের নির্দেশনা অনুযায়ী কর দেওয়া বন্ধ হয়। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো নিস্ক্রিয় হয়ে পড়ে। বন্ধ হয়ে যায় আন্তঃপ্রাদেশিক লেনদেন। বলা যায়, সর্বত্রই কার্যকর ছিল শেখ মুজিবের নির্দেশনা। এমনকি ক্যান্টনমেন্টে পাকিস্তানি সেনাদের জন্য খাবারও সরবরাহও বন্ধ করে দেওয়া হয়। যদিও এরইমধ্যেই বাঙালি জাতিকে শায়েস্তা করার পূর্ব পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে পাকিস্তান। আলোচনার নামে কালক্ষেপণের মধ্যেই খুব সম্ভবত ১৮ অথবা ১৯ মার্চ অপারেশান সার্চলাইটের অনুমোদন দেন ইয়াহিয়া খান। ২৫ মার্চ বিকেলে গোপনে ঢাকা ত্যাগের পরই শুরু হয়ে ইতিহাসের বর্বরতম হত্যাযজ্ঞের চূড়ান্ত প্রস্তুতি। ঢাকা থেকে কলম্বো হয়ে ইয়াহিয়া খানকে বহনকারী বিমান যখন মাঝ আকাশে তখন তিনি খবর পর ঢাকার বুকে শুরু হয়েছে ইতিহাসের বর্বরতম হত্যাযজ্ঞ। বসন্তের হিমহিম বাতাসে ঢাকা শহরে হালাকু খানের তা-ব শুরু করেছে পাকিস্তানি সেনারা।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সারাবাংলা/এসবিডিই
মত-দ্বিমত রাহাত মিনহাজ হাঁস শিকার ষড়যন্ত্র ও অভূতপূর্ব গণজাগরণ