Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

জ্বলে পুড়ে-মরে ছারখার, তবু মাথা নোয়াবার নয়

র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী
২৬ মার্চ ২০২৪ ০৯:১৬

কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে/ভূমিহীন মনুমিয়া গাইবে তৃপ্তির গান জ্যৈষ্ঠে-বোশেখে/বাঁচবে যুদ্ধের শিশু সসম্মানে সাদা দুধে-ভাতে। (একটি পতাকা পেলে- হেলাল হাফিজ)

পতাকা আমরা পেয়েছি। প্রায় ৩০ লক্ষ শহীদের রক্ত, ২ লক্ষ মা-বোনের ইজ্জত এবং জানা অজানা বহু মানুষের ত্যাগে অঙ্কিত লাল সবুজ পতাকা। এই অর্জন হাজার বছরের বাঙালির সর্বকালের সেরা অর্জন। আমার সৌভাগ্য এই ইতিহাসের একজন অংশীদার হতে পেরে। জাতির পিতার নেতৃত্বে এবং তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে শত্রুর মুখোমুখি যুদ্ধ করেছি। মৃত্যুকে তুচ্ছ করে দেশ মাতৃকার মুক্তির সংগ্রামে আমাদের একটাই লক্ষ্য ছিল- স্বাধীন বাংলাদেশ। যার মূলনীতি হবে- জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। যা আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনায় বর্ণিত হয়েছে এইভাবে- আমরা অঙ্গীকার করিতেছি যে, যে সকল মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদদিগকে প্রাণোৎসর্গ করিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল- জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার সেই সকল আদর্শ এই সংবিধানের মূলনীতি হইবে।

বিজ্ঞাপন

১৯৭১ সনে স্বাধীন বাংলাদেশ ছিল বাঙালির শ্রেষ্ঠতম অর্জন আর বিশ্বময় বিস্ময়। একই সঙ্গে বিশ্বমোড়লদের অনেকেরই পরাজয়বরণের গ্লানিবোধ। তারাই বাংলাদেশের ভবিষ্যত নিয়ে নানা প্রশ্ন, যদি, কিন্তু আরও কত কী তুলেছিল? সব দ্বিধা, সংশয় আর শঙ্কাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে জাতির পিতার ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে বাঙালির স্বাধীনতার পূর্ণতা পায়। যাত্রা শুরু হয় নতুন বাংলাদেশের। বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ সর্বক্ষেত্রে একের পর এক সাফল্য অর্জন করে। তার শাসনামলে বাংলাদেশ কমনওয়েলথ, জাতিসংঘ ও ইসলামি সম্মেলন সংস্থার সদস্যপদ লাভ করে। এ সময়ে পাকিস্তানসহ বিশ্বের ১৪০টি রাষ্ট্রের স্বীকৃতি অর্জন সম্ভব হয়। কিন্তু এই সময়েও ষড়যন্ত্র থেমে ছিল না। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী দেশি-বিদেশি শক্তি ৭১-এ স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঠেকাতে ব্যর্থ হলেও স্বাধীনতার পর তারা নতুন এ রাষ্ট্র এবং মুজিব সরকারের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। উৎপাদন ও বণ্টনব্যবস্থা ব্যাহত এবং সরকারকে অসফল করার উদ্দেশ্যে এরা নানা নাশকতামূলক তৎপরতায় মদদ দেয়।

বিজ্ঞাপন

এইসব অপতৎপরতা ও ষড়যন্ত্র মোকাবেলায় বঙ্গবন্ধু কর্তৃক একটিমাত্র বৈধ রাজনৈতিক দল গঠনের পর দ্রুত দেশের সামগ্রিক অবস্থার উন্নতি ঘটতে থাকে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির লক্ষণীয় উন্নতি হয়, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্য হ্রাস পায়, দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। ঠিক এমনই সময় সংঘটিত হয় ১৫ই আগস্টের নির্মম, নৃশংস হত্যাকাণ্ড। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা, বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের উপস্থিত সকল সদস্য এ হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। এর সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত দেশি-বিদেশি শক্তি ও এদের প্রতিক্রিয়াশীল সহযোগী গোষ্ঠীর সংশ্লিষ্টতা ছিল। এটি ছিল ষড়যন্ত্রমূলক রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড। ষড়যন্ত্রকারীরা বঙ্গবন্ধু কর্তৃক একটিমাত্র বৈধ রাজনৈতিক দল গঠনকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত সাময়িক বিভ্রান্তিকর রাজনৈতিক পরিস্থিতির সুযোগ নেয়।

স্বপ্নের মতো যাত্রা শুরু করা বাংলাদেশ পথ হারায় প্রাতিষ্ঠানিকভাবে। সংবিধানের মৌলিকনীতি থেকে সরে আসে বাংলাদেশ। তথাকথিত বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে যুদ্ধাপরাধীদের পুর্ণবাসন, ধর্মের নামে রাজনীতি ব্যবসার সম্প্রসারণ, ক্যু পাল্টা ক্যুসহ বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে নেমে আসে অন্ধকারতম অধ্যায়। আমাদের চোখের সামনে রক্তে কেনা পতাকা গাড়িতে উড়িয়েছে চিহিৃত যুদ্ধাপরাধীরা। একজন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এই দৃশ্য বুকের ভেতর রক্তক্ষরণ বাড়িয়েছে। তাই বলে আমরা বসে থাকিনি। ৭৫ পরবর্তী প্রতিরোধ সংগ্রামে সম্মুখ সারি থেকে লড়াই করেছি। জেল জুলুম আর সমরতন্ত্রের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর মতোই তার কন্যার শক্তিও জনগণ।

আজকে স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভাবি আমাদের অর্জন কী? কিংবা কতদূর এগুলো বাংলাদেশ? চোখের সামনে ভেসে উঠে সমৃদ্ধ আগামী। আমরা আশাবাদী সকল ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়তে পারব। এই সময়ে অনেক দিক থেকে আমাদের অগ্রগতি শুধু সন্তোষজনকই নয়, বিস্ময়করও বটে। তবে এ সময়ের মধ্যে আমরা টেকসই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। যদিও এমনটি প্রত্যাশিত ছিল না। এই ব্যর্থতার দায় আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি সবারই। ক্ষমতার মোহ এবং জনগণকে পাশ কাটিয়ে ক্ষমতার সিড়িতে উঠার প্রবণতা থেকে বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক, স্বৈরতান্ত্রিক ও তথাকথিত সুশীল সরকার গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিকরূপ না দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন পথের আশ্রয় নিয়েছেন। ফলে জনগণের ইচ্ছের প্রতিফলন ঘটবে এমন নির্বাচন ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণের পথ তৈরি হয়নি। তবে আশার কথা হচ্ছে- জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নির্বাচন কেন্দ্রিক যে দূর্বলতা ছিল এগুলোকে দূর করে প্রাতিষ্ঠানিকরূপ দেয়ার চেষ্টায় বহু উদ্যোগ গ্রহণে জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে। পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতার সিড়িতে পা রাখার পথ চিরতরে রুদ্ধ। অপ্রত্যাশিত এই দুঃখবোধ ছাড়া গত ৫৩ বছরে বাংলাদেশের যা অর্জন তা নিঃসন্দেহে গৌরব করার মতো। বিশ্বময় পরিচিত ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা আর দারিদ্র্যতার দেশ আজ বিশ্বকে প্রতিনিয়ত চমক দেখাচ্ছে। এত জনঘনত্বের মধ্যেও আমাদের দ্রুত অগ্রগতি গবেষণার বিষয়। বিগত দুই তিন দশক আগেও স্বাধীনতা বা বিজয় দিবস এলে আমরা পাকিস্তানের সঙ্গে তুলনা করতাম। এখন সেই বাস্তবতা নেই। যে মানুষ অর্থনীতি কিংবা রাজনীতির জটিল মারপ্যাচ বুঝে না সেও চোখ বন্ধ করে বলে দেবে কোথায় পাকিস্তান আর কোথায় বাংলাদেশ। এখানেই বাংলাদেশের সাফল্য।

আমাদের অর্থনীতি, কূটনীতি, উন্নয়ন এখন আর অন্যের দয়ানির্ভর না। পারস্পারিক মর্যাদা আর দেশের স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের বাস্তবতায় আমরা অবস্থান করছি। এক পদ্মা সেতুর ঘটনা বিবেচনায় নিলেও বিষয়টি বুঝতে সুবিধা হবে। আমাদের নিশ্চয় মনে আছে পদ্মা সেতু নির্মাণকে কেন্দ্র বিশ্ব ব্যাংক তথা সা¤্রাজ্যবাদীরা তথাকথিত দুর্নীতির অভিযোগ তুলে অর্থায়ন থেকে সরে আসে। তাদের ধারণা ছিল অর্থায়ন বন্ধ করে দিলে এই সেতু বানাতে আমরা সক্ষম হবো না। কিন্তু সব ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে নিজস্ব অর্থায়নে সেতু নির্মাণ করে বিশ্বের বুকে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছি। পদ্মা সেতু শুধুমাত্র একটি সেতু নয়, এটি আমাদের সক্ষমতার প্রতীক। সারা বিশ্বে আজ বাংলাদেশের পরিচিতি একটি উন্নয়নশীল এবং উদীয়মান অর্থনীতির দেশ হিসেবে। বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যমের চোখে বাংলাদেশ এখন আর আগের বাংলাদেশ নেই। এটি আগামী দেড় দশক পর অর্থাৎ ২০৪০ সালে বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী অর্থনীতির দেশে পরিণত হবে। সে লক্ষ্যে পাল্লা দিয়ে ছুটছে প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর দিকে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্ব, দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা, এমডিজি অর্জন, এসডিজি বাস্তবায়নসহ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, লিঙ্গ সমতা, কৃষি, দারিদ্র্যসীমা হ্রাস, গড় আয়ু বৃদ্ধি, রপ্তানীমূখী শিল্পায়ন, ১০০ টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, পোশাক শিল্প, ঔষধ শিল্প, রপ্তানী আয় বৃদ্ধিসহ নানা অর্থনৈতিক সূচক। পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পায়রা গভীর সমুদ্র বন্দর, ঢাকা মেট্রোরেলসহ দেশের মেগা প্রকল্পসমূহ বাংলাদেশকেই বদলে দিচ্ছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও প্রযুক্তিসহ সর্বক্ষেত্রে আমাদের অগ্রযাত্রা সুন্দর আগামীকে নির্দেশ করে। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার ৮টি লক্ষ্যের মধ্যে শিক্ষা, শিশুমৃত্যুহার কমানো এবং দারিদ্র হ্রাসকরণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য উন্নতি প্রদর্শন করতে সক্ষম হয়েছে। নোবেল বিজয়ী ভারতীয় অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের মতে কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিশ্বকে চমকে দেবার মতো সাফল্য আছে বাংলাদেশের। বিশেষত শিক্ষা সুবিধা, নারীর ক্ষমতায়ন, মাতৃ ও শিশু মৃত্যুহার ও জন্মহার কমানো, গরিব মানুষের জন্য শৌচাগার ও স্বাস্থ্য সুবিধা প্রদান এবং শিশুদের টিকাদান কার্যক্রম অন্যতম।

বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশ। স্বনির্ভর বাংলাদেশের অর্থনীতি দ্রুত বর্ধনশীল। বিগত এক দশকে রাজনৈতিক সরকারের স্থিতিশীলতার ফলে সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ধারাবাহিক উন্নয়ন অর্জিত হয়েছে। যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে যে দেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলা হতো, সেই বাংলাদেশ আজ উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হয়েছে। বর্তমান বিশ্বে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ রোল মডেল হিসেবে অভিহিত। এই স্বীকৃতি এসেছে জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবির মতো আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান থেকে। মাথাপিছু আয়, খাদ্য ও পুষ্টি প্রাপ্তি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ। নানাবিধ সমস্যা এবং দুঃসময়েও বিশ্বের বুকে সগর্বে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। এ অর্জন বড় আনন্দের এবং গৌরবের। যদিও এগুলো ধরে রাখতে আমাদের অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। সেই আলোচনা অন্য কোন লেখায় করব।

এই লেখার শুরুতেই কবি হেলাল হাফিজের একটি কবিতার লাইন দিয়ে শুরু করেছিলাম। শেষ করছি কবির লেখার সূত্র ধরেই- পতাকা পেয়েছি। ভূমিহীন মনুমিয়ারা আজকে গৃহহীন নয় জননেত্রী শেখ হাসিনা সরকারের উদ্যোগের ফলে। যুদ্ধের শিশুও সসম্মানে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে বিশ্বের বুকে। এই অর্জন বাংলাদেশের। এই অর্জন আপামর জনতার। হাজার বছরের বাঙালির ইতিহাসে মুক্তিযুদ্ধ বিজয়ের পর বাংলাদেশের অগ্রগতির খবরের চেয়ে বড় কোন আনন্দের খবর নেই। তাই তো কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের মতো বলতে চাই- সাবাস, বাংলা দেশ, এ পৃথিবী/অবাক তাকিয়ে রয়:/জ্বলে পুড়ে-মরে ছারখার/তবু মাথা নোয়াবার নয়।

লেখক: মন্ত্রী, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এবং যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা

সারাবাংলা/এসবিডিই

জ্বলে পুড়ে-মরে ছারখার তবু মাথা নোয়াবার নয় মত-দ্বিমত র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী

বিজ্ঞাপন

খুলনায় যুবকের পেটে মিলল ইয়াবা
২২ নভেম্বর ২০২৪ ১২:০২

আরো

সম্পর্কিত খবর