উৎসব কি অর্থব্যবস্থাকে গতিশীল করতে পারবে?
৫ এপ্রিল ২০২৪ ২১:১৭
“যদি আমাকে আপন করে পেয়ে থাকো আজ প্রভাতে সেই পাওয়ার আনন্দকেই যদি তোমাদের প্রকাশ করবার ইচ্ছে হয়ে থাকে তাহলেই এই উৎসব স্বার্থক”─ রবি ঠাকুরের সেই তুলনাহীন আনন্দের আশাই যে এখন আমাদের বেঁচে থাকবার অনুষঙ্গ। উৎসব তো শুধু আনন্দ অনুষ্ঠান বা ক্ষেত্র বিশেষে ধর্মীয় আয়োজন মাত্র নয়, বেশির ভাগ উৎসবের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে অর্থনীতির প্রশ্নটি। বড় উৎসব অনেক ক্ষেত্রেই বহু মানুষের প্রায় সারা বছরের রোজগারের জোগান দেয়। সারা বিশ্বেই উৎসবের সময় বাড়ি সাজানো হয়, কেনা হয় পোশাক, উপহার হস্তশিল্প, ব্যক্তিগত ও ধর্মীয় জিনিসপত্র। খরচ করা হয় খাওয়া দাওয়া আর বেড়ানোয়। পুষ্ট হয় অর্থনীতিও। বড় উৎসব অর্থনৈতিক জড়তা ভেঙ্গে উত্তরণের একটা কার্যকর মাধ্যম।
প্রাচীনকাল থেকেই বাংলাদেশ পৃথিবীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে আসছে। এই ভুখণ্ডের মানুষদের সংগ্রামমুখর জীবন মাথা উচুঁ করে বাঁচার দৃঢ় প্রত্যয়, বিশ্বকে সময়ে সময়ে বিস্ময়ে হতবাক করে দিয়েছে। এ জাতি কখনও মাথা নত করেনি কোন অপশক্তির কাছে। মেনে নেয়নি কোন লুটেরা, বেনিয়া শাসক শোষক গোষ্ঠীর অবিচার, অত্যাচার, জুলুম। বর্গিরা এখানে হানা দিয়েছে সম্পদ লুণ্ঠনের আশায়, পুর্তুগিজ জলদস্যুরা ও এসেছে লুটে নিতে বাংলাদেশের সম্পদ। বাণিজ্য করতে এসে ইংরেজরা বনে গিয়েছিল শাসক। বাংলাদেশের মানুষ সে শাসন-শোষণকে নীরবে মেনে নেয়নি। জ্বলে উঠেছে ক্ষণে ক্ষণে। ইংরেজ বিদায় নিল। নতুন এক শাসকগোষ্ঠী আবির্ভাব হলো বাংলার ওপর। কিন্তু বাংলাদেশ রুখে দাঁড়াল। আর ১৯৭১ সালে বাঙালি কী দুরন্ত সাহসে রুখে দিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে। বাংলাদেশ আমাদের গর্ব, আমাদের অহংকার। আমরা গর্বিত কারণ পৃথিবী অবাক হয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকে।
২০০৭ এ শুরু হওয়া বিশ্বজোড়া মন্দার সময়ও নানা উৎসব হয়েছে পৃথিবীতে কাঁটছাট করেই। ২০২০-র কোভিডকালে ও উৎসবের মরসুমে ভোগ্যপণ্যের চাহিদা ও বিক্রি অর্থনীতিকে খানিক ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করেছে। কিন্তু কেনাকাটার সার্বিক পরিমাপই কি উৎসবের ঠিকঠাক অর্থনৈতিক সূচক হতে পারে? বিশেষ করে সমাজে অসাম্য যেখানে প্রবল এবং শতাব্দীর ভয়ঙ্করতম অতিমারি যখন সেই অসাম্যকে বাড়াবাড়ি রকমের বাড়িয়ে দিয়েছে? অর্থনৈতিক পুনরুত্থানের রাস্তাটাও এগুচ্ছে অসাম্যের জটিল পথে। তা বড় অর্থনীতিবিদরা তথ্য নিংড়ে দেখাচ্ছেন, কোভিড উত্তর অর্থনীতির পুনরুত্থানের রূপরেখা অনেকটা ইংরেজি ‘‘কে’’ অক্ষরের মতো ব্যক্তির ক্ষেত্রেও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও। ‘‘কে’’-র একটা হাত উর্ধ্বমূখী এ ক্ষেত্রে যা ধনীদের আরও সম্পদ-বৃদ্ধির নির্দেশক। ‘‘কে’’র নিম্নমূখী হাতখানা নির্দেশ করে এক অতল গহ্বরের দিকে দরিদ্ররা যেখানে তলিয়ে যাচ্ছে আরও। আজ যখন অতিমারি নিয়ন্ত্রণে আন্তর্জাতিক পণ্যমূল্যও বাধন ছাড়া নয়, তখন ধনীরা হাত খুলে খরচ করতেই চাইবেন উৎসবের আমেজ।
মুসলিমদের জন্য ঈদুল ফিতর আনন্দের এক বড় অনুষ্ঠান। ইতোমধ্যেই আসন্ন ঈদুল ফিতর। সবার লক্ষ্য ঈদের নতুন পোশাকসামগ্রী কেনা। ঈদের পোশাকসহ চাহিদা মতো অন্যান্য পণ্যসামগ্রী কেনাকাটা শুরু করেছেন। এতে করে একটু চাঙ্গা হচ্ছে ঈদবাজার। ঈদকেন্দ্রিক উৎসবের বেচা বিক্রিতে অর্থনীতিকে নতুন গতি সঞ্চার হবে বলে আশা করা যায়। ঈদ উৎসবের সাথে অর্থনীতির রয়েছে ব্যাপক সম্পর্ক। ঈদ উৎসবকে ঘিরে অর্থনীতিতে যুক্ত হয় নতুন চাহিদা। আর এ চাহিদার যোগান দিতে প্রয়োজন হয় বাড়তি সরবরাহের। বাড়তি সরবরাহের জন্য প্রয়োজন বাড়তি উৎপাদন। আর অতিরিক্ত উৎপাদন আসে বাড়তি কর্মসংস্থান থেকে। এভাবে ঈদ প্রতি বছর দেশের অর্থনীতিকে গতিশীল করে।
সাম্প্রতিক সময়ে মানুষের জীবনযাত্রার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। কেনায় আার উপহারে ছোট থেকে বড় অনেকেই একাধিক সেট পোশাক পেয়ে থাকে ঈদে। খাবারেও থাকে ঐশ্বর্য। ঈদ কেনাকাটার জন্য বিপুল সম্ভারে আরো আয়োজন থাকে শপিংমলগুলোতে। মানুষের সামর্থ্য বিবেচনায় নানরকম মার্কেট তৈরি হয়েছে দেশজুড়ে। এমন এক অগ্রগতির ধারায় বহমান বাংলাদেশ।
আমরা জানি যে, বাংলাদেশের অর্থনীতির তিনটি বড়খাত হচ্ছে কৃষি, শিল্প এবং সেবা খাত। প্রতিটি খাতের কয়েকটি উপখাত আছে। যেমন কৃষির উপখাত হল শস্য উৎপাদন, প্রাণী সম্পদ এবং মৎস্য সম্পদ। স্বল্প মেয়াদে এই সকল উপখাতে উৎপাদন না কমলেও দেশি বিদেশী অর্থনীতিসমূহ অবরুদ্ধ থাকার কারণে প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। সূত্র মোতাবেক প্রতিবছরই নতুন চাহিদার সঙ্গে বাড়ছে ঈদ অর্থনীতি। ঈদকে সামনে রেখে সেজেছে রাজধানীসহ দেশের ছোট বড় সব মার্কেট ও শপিংমল, উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত সবাই এখন নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী কেনাকাটায় ব্যস্ত। ফলে ঈদে অর্থনীতির চাকা বাড়ছে।
শ্রমশক্তির দেয়া তথ্য মোতাবেক, দেশে মোট কর্মজীবী মানুষের সংখ্যা ৬ কোটি ১০ লাখ। এর মধ্যে ১ কোটি মানুষকে আনুষ্ঠানিক কর্মজীবী মনে করা হয়। বাকিরা সব অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন। জাতীয় পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে সারাদেশে পুরুষ, নারী ও শিশুদের পোশাকের দোকান রয়েছে ২৫ লাখ। এসব দোকানে প্রতিদিন সাধারণত তিন হাজার কোটি টাকার পোশাক বিক্রি হয়। এ বছর কর্মজীবী মানুষেরা বোনাস পেয়েছেন ১০ থেকে ১২ হাজার কোটি টাকা। এ টাকার সবটুকু খরচ হয়ে যাবে দেশের পোশাকের বাজারে। এ তথ্য প্রমাণ করে যে, এ বছর ২৫ লাখ পোশাকের দোকানে এক মাসের বিক্রয় লব্দ টাকার পরিমাণ দাঁড়াবে ২ থেকে ৩ লাখ কোটি টাকা। শহরে নগরে বন্দরে গ্রামে আর গঞ্জে─সবখানেই অর্থনীতির কারবার। পোশাক থেকে খাবার, সেলুন থেকে পার্লার আর শপিংমল থেকে দর্জিবাড়ি শুধু ব্যস্ততা আর ব্যস্ততা। চারদিকে ঈদের আমেজ ও অর্থের ছড়াছড়ি। বাসে, ট্রেনে লঞ্চে, স্টিমারে, বিমানে, লেগুনাতে-সবখানেই শুধু একটা জিনিষের হাকডাক। আর সেটা হলো অর্থ, অর্থ এবং অর্থ। চারিদিকে শুধু ঈদের আমেজ ও অর্থের ছড়াছড়ি।
আমাদের অর্থনীতি চাহিদার উপরে নির্ভরশীল। মানুষের কেনার ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে পারলে তবেই অর্থনীতি সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। অর্থনীতির দুটো চিত্র পরিলক্ষিত হয়। একটি যা আমরা সাদা চোখে দেখতে পাচ্ছি। আরেকটি বিষয় যা অনেক পজেটিভ খবরের মধ্যে চাপা পড়ে যায়। সেই চাপা পড়া দিকটা হচ্ছে কর্মসংস্থান। আমরা দেখতে পাচ্ছি নন-ফরম্যাল অর্থাৎ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের অবস্থা বেশি খারাপ অর্থাৎ সংগঠিত নয় প্রাতিষ্ঠানিক বা করপোরেট আকারে নয় যেসব কর্মকান্ড তা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে সবচেয়ে বেশি, এর মধ্যে খেটে খাওয়া মানুষ, রিকশাওয়ালা, ছোট ছোট দোকানদার, নির্মাণকর্মী, সেলুনকর্মী, ফেরিওয়ালা চানাচুর-মুড়ি বিক্রেতা, ভ্যানচালক, সবজি বিক্রেতা, দৈনিক শ্রমবিক্রির শ্রমিক, স্ব-নিয়োজিত লোকজন ইত্যাদি পেশার লোক।এরাই সংখ্যায় কোটি কোটি। আর রয়েছে কর্মহীন, চাকরীহীন, ব্যবসাহীন ব্যক্তি। এদের মধ্যে প্রাণসঞ্চার না হলে অর্থনীতির গতি ফিরে আসবে না। অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা তৈরি হওয়ায় খরচ করার ক্ষেত্রে এখন মানুষ খুব সাবধান। অতি প্রয়োজনীয় জিনিস ছাড়া এখন মানুষ অন্য কিছু কিনতে চাচ্ছে না। বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি বড় শক্তি হচ্ছে ভোক্তা ব্যয়। অর্থাৎ বিভিন্ন খাতে মানুষ যে টাকা খরচ করে সেটার উপর নির্ভর করে শিল্পপ্রতিষ্ঠানও টিকে আছে। এই ব্যয়ের উপর নির্ভরশীল যারা আছেন, ছোট উৎপাদক থেকে শুরু করে শিল্পখাতে এবং সেবা খাতে সবাই বিক্রির সংকটে পড়বে। বাঙালি আমোদে এবং অতিথিপরায়ন জাতি। একজন মানুষের সঙ্গে পরিচয় হলে বা বন্ধুত্ব হলে একটা হোটেল বা রেঁস্তোরায় গিয়ে খাওয়া দাওয়া করা, রিকশায় চড়ে ঘুরে বেড়ানো বা উৎসবে কাপড়-চোপড় কেনা, প্রসাধনী কেনা, বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দয্য মন্ডিত স্থানগুলো ঘুরে বেড়ানো─এই রকম বিভিন্ন ধরণের ব্যয় যে মানুষ করে, সেই সকল ব্যয়গুলো সব সময়ই করে।
অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি খাতের নাম হলো রেমিট্যান্স। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কর্মরত বাংলাদেশি শ্রমিকসংখ্যা প্রায় এক কোটি। প্রতিটি ঈদে তারা ঈদ অর্থনীতিতে বিপুল অংকের টাকা যোগান দিয়ে থাকে। মার্চ মাসে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় রেমিট্যান্স খুব বেশি আসেনি। মার্চ মাসের ২৯ দিনে বৈধ বা ব্যাংকিং চ্যানেলে ১৮১ কোটি ৫১ লাখ মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। বাজার চাঙ্গা হতে পারে চাহিদা থাকলে অর্থাৎ পণ্যের “ডিমান্ড” থাকলে। পণ্যের চাহিদা সৃষ্টির জন্য দরকার ক্রয়ক্ষমতা। এটা নেই সিংহভাগ মানুষের। উৎসবে ভ্রমনও হতে পারে নতুন উদ্যম। সম্পন্নদের এই খরচ কিন্তু অর্থনীতিকে সমৃদ্ধই করবে। তাদের কেনাকাটা, রেঁস্তোরায় খাওয়া, বেড়ানো এসবের ফলে অর্থনীতি ফুলেফেপে উপকৃত হবে দরিদ্রের অর্থনীতিও।
ঈদ তথা উৎসবের অর্থনীতি দেশের মোট জাতীয় উৎপাদনের জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে একটা উল্লেখ্যযোগ্য ভূমিকা রেখে আসছে। এবারও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না যদিও এর পরিমাণগত দিকটি নির্নয় করা কঠিন। সরকারি নীতি-পরিকল্পনা ও নীতি নির্ধারণী বিভাগের গবেষনা শাখা থেকে এ নিয়ে কাজ হতে পারে। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানও কাজ করতে পারে। এর মধ্যে থেকে উৎসবের অর্থনীতির একটি তথ্য উপাত্তভিত্তিক বড় ছবি বেরিয়ে আসতে পারে যা আবার ব্যবহৃত হতে পারে উৎসবের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডকে নীতি সহায়তা জোরদার করায়।
লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক
সারাবাংলা/এজেডএস