Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বিনাযুদ্ধে দেশে-দেশে বাঙালির দখল কায়েম


২৮ মে ২০১৮ ১০:৪২

।। মোস্তফা কামাল ।।

মার্কিনি বা ইসরাইলিদের মতো মারনাস্ত্রে নয়, ন্যায্য টাকায় বিশ্বের দেশে দেশে বাঙালির নীরব দখল কায়েম হচ্ছে। ঠিকঠাক মতো তা চলতে থাকলে আমরা বিশ্বের অনেক দেশই দখলে নিতে পারবো। সেই সম্ভাবনা বেশ বেগবান। গতিময়। এরইমধ্যে তা এগিয়ে গেছে অনেক দূর। লক্ষণও বেশ ভালো। কোনো ক্যাচাল বা ভেজাল হচ্ছে না। কোথাও কেউ আপত্তি বা বাধা দিয়েছে এমন দুঃসংবাদও নেই।

দুনিয়াজোড়া মিডিয়ায় এখন তাজা খবর: ইসরায়েল কামান-বন্দুক দিয়ে প্যালেস্টাইন দখল করছে। কিন্তু বেখবরে-চুপচাপে আমরা হকহালালিভাবে দখল করে নিচ্ছি মালয়েশিয়া, আমেরিকা, কানাডার মতো ধনী দেশের জায়গা-সম্পত্তি। তাদের জমি- ফ্লাট-পার্কিং স্পটসহ অনেক হাত করে নিচ্ছি। এখন পর্যন্ত কোথাও থেকে বাঙালির বিরুদ্ধে কোনো বেইনসাফির অভিযোগ আসেনি। রক্তারক্তি দূরে থাক কাউকে উচ্ছেদ বা জাল-জালিয়াতির ছিঁটাফোটার ঘটনাও ঘটেনি। এ বিষয়ে হালনাগাদ খবরের মধ্যে রয়েছে আমেরিকার জ্যামাইকাতে আমাদের এক মন্ত্রীপুত্রের ১২ টি ফ্লাট আর চারটি পার্কিং স্পটের মালিকানা প্রতিষ্ঠা।

পাচার করা টাকার একটা সিংহভাগ বিনিয়োগ হচ্ছে বিভিন্ন দেশে ‘সেকেন্ড হোম’ প্রকল্পে। ২০০২ সাল থেকে বিদেশি নাগরিকদের স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য মালয়েশিয়া অফার করছে ‘মাই সেকেন্ড হোম প্রোজেক্ট’। এতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বিনিয়োগের প্রবণতা বাড়ছে বাংলাদেশিদেরও। এক তথ্যে জানা গেছে, ২০১৭ সাল পর্যন্ত কেবল মালয়েশিয়ার ‘সেকেন্ড হোমে’ বাংলাদেশি বিনিয়োগকারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে তিন হাজার ৬৫৬ জনে। যা বিশ্বে তৃতীয়। বিশ্বের অন্যান্য দেশের ‘সেকেন্ড হোমে’ও ছুটছেন বাংলাদেশিরা। কানাডায় বাংলাদেশিদের সেকেন্ড হোমের নাম ‘বেগম পাড়া’। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে ‘সচিব পাড়া’। থাইল্যান্ড, হংকং, সিঙ্গাপুরের সেকেন্ড হোমে বাংলাদেশি বিনিয়োগকারীর সংখ্যাও কম নয়। বাংলাদেশের আইনে, ‘সেকেন্ড হোম প্রকল্পে’ বৈধভাবে বিনিয়োগের সুযোগ নেই। ফলে এ বিনিয়োগকর্মটি চলছে পাচার করা টাকায়।

বিজ্ঞাপন

সুইস ব্যাংকের এক প্রতিবেদনেও বাংলাদেশিদের বিদেশে টাকা পাচারের কিছু হিসাব উঠে এসেছে। তারা বলছে, ২০১৬ সালে বাংলাদেশ থেকে ব্যাংকটিতে জমা হয়েছে পাঁচ হাজার ৬৮৫ কোটি টাকা। আর ১১ বছরে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে সাড়ে ২৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। এ ধরনের চুরি বা পাচারকে কারো কারো লেনদেন বলতে পছন্দ। আবার কেউ বলেন রফতানি। শুনতে রসিকতার মতো হলেও চুরি, পাচার, লেনদেন, রফতানি প্রায়োগিকভাবে কাছাকাছি টার্ম হয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমেও দেশ থেকে প্রতি বছর প্রচুর অর্থ বিদেশে পাচার হচ্ছে। ব্যাংকিং খাতের গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অফ ব্যাঙ্ক ম্যানেজমেন্ট বা বিআইবিএমের গবেষণায়ও এর প্রমাণ মিলেছে। এতে বলা হচ্ছে, আমদানি-রপ্তানির আড়ালে মানি লন্ডারিং হচ্ছে। এর মাত্রাও ব্যাপক। কিন্তু টাকার অংক বের করা কঠিন। তবে অসম্ভব নয়। কারণ ব্যাঙ্কারদের যোগসাজসেই হচ্ছে এ কর্মটি। শুল্ক বিভাগের কিছু অংশও এর সাথে জড়িত থাকতে পারে।

গবেষণাটির কেস স্টাডি বেশ ইন্টারেস্টিং। তাতে দেখা গেছে, শুল্ক বেশি দিতে হয় এরকম পণ্য বিদেশ থেকে আনতে ডিক্লেয়ারে বলা হয় হাঁস মুরগির খাবার বা পোল্ট্রি ফিড। এক্ষেত্রে হয়তো মোট পেমেন্ট হওয়ার কথা ছিল এক হাজার কোটি টাকা। কিন্তু যে পরিমাণ অর্থের শুল্ক দেওয়া হচ্ছে সেটা হয়তো মাত্র তিন থেকে চার কোটি টাকার। তাহলে বাকি টাকাটা কোথায় গেল? অবৈধভাবে সেই অর্থটা কোথাও পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। কর্তৃপক্ষের কাছে গোপন রেখে এভাবে বহু অর্থ বিভিন্ন দেশে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে।

পাচার ও ক্রয়যাত্রার এ ধারা অব্যাহত থাকলে আল্লাহ চাহেতো এক সময় সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, জার্মানসহ শক্তিমান আরো অনেক দেশেও বিনাযুদ্ধে বাংলাদেশের দখল কায়েম হবে। আমাদের এখন টাকার অভাব নেই। তাই কামান-গোলাবারুদ নয় মাথাপিছু এভারেজ আয়-উন্নতির সঙ্গে উন্নয়ন, দালালি, কমিশন, লুটপাট, হরিলুটের অগুণতি টাকায় দালালির টাকায়ই সেটা সম্ভব হয়ে চলছে। ওইসব দেশের কেউ কেউ নাকি এখন আমাদের সলিড কাস্টমার ভাবে। বাংলাদেশ থেকে টাকা নিয়ে কে আসছে, কে পাইপ লাইনে আছে?- এ অপেক্ষায় থাকে তারা। বিচ্ছিন্নভাবে আমজনতাও বাংলাদেশের এ ক্রয়যাত্রার টুকটাক খবর পায়। এতে তারা নাখোশ হয় না। বরং এ বিদেশ জয়ীদের সমীহ করে। খুশিমনে আদব-সালাম একটু বেশিই দেয়।
বিত্তের গুণে দেশের মতো তারা বিদেশে-প্রবাসে, সেকেন্ড হোমে বেশ মর্যাদাবান। ফার্স্ট হোম একঘেয়ে লাগলে তারা মাঝেমধ্যে সেকেন্ড হোমে বাড়তি আয়েশ করে আসেন। আমেরিকায় জ্যাকসন হাইটস কিংবা কানাডায় বেগমপাড়ায় বাংলাদেশের সেই মান্যবরদের রাজনীতিক, শিল্পপতি, সাবেক সামরিক-বেসামরিক আমলাদের লাইফস্টাইলই অন্যরকম। যার ছিটাফোটা খবর যে দেশে আসছে না-এমনও নয়। জীবনের একটা সময়ে তাদের কেউ কেউ অনেক কষ্ট করলেও শেষ জীবনে সেটি পুষিয়ে নিচ্ছেন। নিশ্চিৎ করছেন ছেলেমেয়েদের নিরাপদ শান্তিময় ভবিষ্যৎ। ঘোষণা দিয়ে না বললেও বলার অপেক্ষা রাখে না, যে দেশটিতে জন্ম নিয়েছেন, বড় হয়েছেন, সেই দেশটিকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য তারা নিরাপদ মনে করেন না। সেইসঙ্গে দখল না হলেও বিনাযুদ্ধে বিদেশ কেনার হিম্মত আয়ত্ব হচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

[এই কলামে তুলে ধরা সকল মতামত লেখকের নিজস্ব]

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর