বিশ্বসম্প্রদায়ের দ্বিমুখী নীতি বন্ধ হোক
৩১ মে ২০২৪ ১৮:০৭
বিশ্ব যখন ফিলিস্তিনে ইসারইলি গণহত্যা বন্ধ করার আবেদন নিবেদন নিয়ে ব্যস্ত ঠিক তখনই বিশ্বের আর এক প্রান্তে আর একটি গণহত্যা চলমান আছে। সেই ২০১৭ সালের পর থেকে যা নিয়ে না জাতিসংঘ না বিশ্বের মোড়লরা কোনেরকমের কার্যকর ভূমিকা রাখছে। বলছিলাম মিয়ামারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উপর সেই দেশের সেনাবহিনীর চলামান গণহত্যার কথা। ফিলিস্তিনে একজন যুদ্ধপরাধী বিনাইয়ামিন নেতানিয়াহুর কথা বিশ্বের সকলে জানে কিন্তু মিয়ানমারে এই নেতানিয়াহুর সংখ্যা একাদিক। বিশ্বসম্প্রদায়ের এটি চরম ব্যর্থতা যে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের উপর এই চলমান গণহত্যা নিয়ে তারা এখন তেমন একটা উচ্চবাচ্চ করে না। প্রায় সকলের কাছে এটি একটি বিস্মৃত অধ্যায়।
২০১৭ সালে মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে যে গণগত্যার শুরু বর্তমানে তা এক ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। নির্ভরযোগ্য সূত্রে পাওয়া খবরে জানা গেছে, সেখানে এখন রোহিঙ্গাদের শিরোচ্ছেদ চলছে। একধা আর্থ-সামাজিক ভাবে উন্নত একটি দেশ এখন বর্বরতার ও ধ্বংসের চূড়ান্ত শিখরে পৌঁছেছে। জাতিসংঘ নামক একটি অকার্যকর বিশ্বসংস্থার অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে তাদের প্রয়োজনীয়তাও সম্ভবত ফুরিয়ে গেছে।
দেশে ও দেশের বাইরে যখন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অত্যন্ত সুপরিকল্পিত ভাবে নানা ধরণের অপপ্রচারের মাধ্যমে একটি সূক্ষ্মষড়যন্ত্র চলমান ঠিক তখনই জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের মূখপাত্র ভলকার তুর্ক কদিন আগে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশকে অনুরোধ করেছেন নতুন শরনার্থীদের নিজেদের দেশে ঠাঁই দিতে। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায় বর্তমানে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় আনুমানিক পঁয়তাল্লিশ হাজার শরানার্থী নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে জড়ো হয়েছে । জাতিসংঘের কাছ হতে এমন একটা অবিবেচক আহ্বান বাংলাদেশর জন্য সম্পূর্ণ অযৌক্তিক।
মিয়ানমার জাতিসংঘের একটি সদস্য রাষ্ট্র কিন্তু দেশটি শুধু জাতিসংঘের আইন কানুনকেই লঙ্ঘন করেনি, তারা দীর্ঘ প্রায় একদশক ধরে জাতিগত উচ্ছেদ কার্যক্রম ও গণহত্যা চালিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছে। বড় বড় পরাশক্তিগুলোর প্রশ্রয় পেয়ে তারা বর্তমানে আরো বেশী বেপরোওয়া হয়ে উঠেছে। মিয়ানমারে যখনই গণহত্যা বিষয়ক কোন প্রস্তাব জাতসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপিত হয়েছে অবধারিতভাবে তাতে কোন না কোন স্থায়ী সদস্য ভেটো দিয়েছে । মিয়ানমারে যে দীর্ঘ গণহত্যা চলছে তার জন্য প্রত্যক্ষভাবে এইসব পরাশক্তিগুলোও দায়ী । একই সাথে দায়ী শান্তিতে নোবেল পুরুষ্কার জয়ী মিয়ানমারের নেতা অং সান সুচি। এই সুচিইতো আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল আদালতে মিয়ানমারে চলমান গণহত্যার পক্ষে সাফাই গাইতে গিয়ে বলে এসেছিলেন এখানে কোন গণহত্যা হচ্ছে না। নিয়তির নির্মম পরিহাস সেই সুচি বর্তমানে নিজেই সামরিক জান্তার হেফাজতে।
২০১৭ সালে যখন মিয়ানমারের এক শ্রেণির বৌদ্ধ ভিক্ষুদের ভয়াবহ জাতিগত সন্ত্রাসের কারণে শত শত বছর ধরে মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে বসবাসরত রোহিংগা জনগোষ্ঠির উপর গণহত্যা শুরু হয়েছিল তখন মিয়ানমরের জান্তা সরকার তা বন্ধ করার কোন পদক্ষেপ গ্রহণতো করেইনি বরং সেই গণহত্যা কর্মসূচিতে সামিল হয়েছিল। তখন হাজার লক্ষ রোহিঙ্গা আরাকান রাজ্য হতে সহায়সম্বলহীন অবস্থায় বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিল। তখন বাংলাদেশ ছাড়া মিয়ানমার সংলগ্ন আর কোন দেশ এত উদার ভাবে তাদের সীমান্ত উস্মুক্ত করে দেয়নি। ছুটে গিয়েছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই ভাগ্যাহত মানুষদের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের শান্তনা দিয়ে বলেছিলেন, ‘এই দুর্যোগের সময় আমরা আপনাদের সাথে আছি’। পাঠকের নিশ্চয় মনে আছে সীমান্তে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আর বিডিআর জোয়ানরা তাদের কাঁধে করে সীমান্ত অতিক্রম করে আসা বয়স্ক শরনার্থীদের বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অস্থায়ী বে স্থাপিত শরনার্থী শিবিরে পৌঁছে দেয়ার দৃশ্য। কাতারভিত্তিক ‘আল জাজিরা’ নামক একটি মতলবি প্রচার মাধ্যম মাঝে মধ্যে বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী অসত্য সংবাদ প্রচার করে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে। সম্প্রতি তারা এমন এক প্রচারে বললো বাংলাদেশ সেনাবাহিনী নাকি মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত। কাতারভিত্তিক এই প্রচার মাধ্যমটির জন্ম ১৯৯৬ সালে মার্কিন সহায়তায় মার্কিনিদের ইরাক দখলের সময়। তার আগে সৌদি আরব ও কাতার তাদের দেশে বিবিসির সকল কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। এরপর এই ‘আল জাজিরা’ ঘণ্টায় ঘণ্টায় মার্কিন সেনাদের ইরাক দখল করে ‘গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার’ তাদের নাজায়েজ কর্মসূচির নির্লজ্জ প্রচারে ব্যাস্ত হয়ে পরে। তারা কখনো কিন্তু মিয়ানমারে চলমান গণহত্যার সংবাদ তেমন একটা প্রচার করেনি।
২০১৭ সালে আসা সেই রোহিঙ্গা শরনার্থীর সংখ্যা বর্তমানে প্রায় তের লাখে দাঁড়িয়েছে। জাতিসংঘের ১৯৩টি সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে কম করে হলেও চৌদ্দটি রাষ্ট্রে মোট তের লক্ষ জনসংখ্যা নেই । এর অর্থ বাংলাদেশের মতো একটি ছোট জনবহুল দেশ নিজ দেশের ভিতরে প্রায় চৌদ্দটি দেশের মানুষকে আশ্রয় দিয়েছে । একদেশের একটি ছোট অংশের ভিতর টোদ্দটি দেশ! ঘটনা যখন শুরু হয় তখন দেশ বিদেশের অনেক রাজা বাদশা রাজকন্যা রাজপূত্র হতে শুরু করে জাতিসংঘের শীর্ষ কর্মকর্তা, সরকার ও রাষ্ট্র প্রধানরা ছুটে আসেন বাংলাদেশে মিয়ানমার হতে বিতারিত ভাগ্য বিড়ম্বিত শরনার্থীদেও দেখতে। সকলে সেখানে গিয়ে আফসোস করে একটু ‘হায় হায়’ করে নিজ দেশে ফিরে যান। কক্সবাজারে প্রতিষ্ঠিত সেই শরনার্থী শিবিরগুলো রাতারাতি হয়ে উঠে এক আকর্ষনীয় পর্যটন কেন্দ্র। সকলে যাওয়ার সময় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর পিঠ চাপড়ে বলে যান, ‘বাহ আপনি চমৎকার কাজ করেছেন। আপনি মানবতার জননী’। একজনও বলেননি আমাদের দেশে আমরা কিছু শরনার্থী নিয়ে যাচ্ছি। আমাদেরও প্রচুর খালি জমি আছে, সেখানে তারা চাষাবাদ করে চলতে পারবে’। অথচ এই দেশগুলোর অনেকেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তাদের জ্ঞাতি ভাইদের হাতে ইউরোপে নির্যাতিত নিপিড়ীত ইহুদিদের জাহাজ ভর্তি করে নিয়ে এসে ফিলিস্তিনের আরব ভূমিতে স্থান্তর করে পুরো মধ্যপ্রাচ্যকে অশান্ত করে দিয়েছে। সেই অনৈতিক কাজের সহয়তাকারী ছিল জাতিসংঘ। আবার মিয়ানমারে সংগঠিত চলমান গণহত্যার পরোক্ষ মদদ দাতাও জাতিসংঘ । কক্সবাজারের টেকনাফ, কুতুপালং, উখিয়ার শরনার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়া কয়েক হাজার শরনার্থীকে ইতোমধ্যে বাংলাদেশ নৌবাহিনী ও সেনা বাহিনীর সহায়তায় নোয়াখালির ভাষানচরে আধুনিক সুযোগ সুবিধা সম্বলিত নির্মিত নতুন আশ্রয় কেন্দ্রে স্থান্তর করা হয়েছে । এই স্থানান্তর প্রকল্পরে প্রায় পূরো অর্থায়ন করা হয়েছে বাংলাদেশের নিজস্ব তহবিল হতে। এই কথা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মনে রাখে না। তারা শুধু বাংলাদেশকে আরো একটু মানবিক হওয়ার অযৌক্তিক অনুরোধ করে।
মিয়ানমার হতো আসা শরনার্থীদের পুঁজি করে লাভবান হচ্ছে দেশীয় ও আন্তজার্তিক কিছু এনজিও যাদের কাজই হচ্ছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে মানুষের দুর্দশার বেসাতি করে বিপুল পরিমানের অর্থ সংগ্রহ করে প্রথমে নিজেদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করা তারপর বাকি যা থাকে তা থেকে শরানার্থীদের কিছু বিলি বন্টন করা। কোন দেশে যুদ্ধ লাগলে যেমন করে পরশক্তিগুলোর লাভ কারণ তাদের অস্ত্র বিক্রি বৃদ্ধি পায় ঠিক একই ভাবে যখন কোন অঞ্চলে মানুষ কোন প্রকারের দুর্যোগের মূখোমূখি হয় তখন এই সব এনজিওর জন্য অর্থ কামানোর নতুন দরজা খুলে যায়। অবশ্য এর মধ্যে ব্যতিক্রম নেই তা বলা যাবে না। মাঝে মধ্যে যখনই রোহিঙ্গা শরনার্থীদের নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার সুযোগ এসেছে ঠিক তথনই জাতিসংঘ নিরাপত্তার অজুহাত তুলে তাদের নিষেধ করেছে তারা যেনো ফেরত না যায়। অথচ জাতিসংঘ যদি আন্তরিক হতো বলতে পারতো তারা আরাকান রাজ্যে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা বাহিনী মোতায়েন করে ফিরে যাওয়া শরনার্থীদের নিরাপত্ত নিশ্চিত করবে। তা না বলে তারা অনুরোধ করে বাংলাদেশ যেনো এই শরনার্থীদের জন্য তাদের দরজা বন্ধ না করে । তরা উপলব্দি করে না এখন এই শরনার্থীদের রক্ষণাবেক্ষনের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় হতে যে সহায়তা পাওয়া যেতো তা এখন অনেকটা কমে এসেছে।
এরই মধ্যে বিশ্বব্যাংক রোহিঙ্গাদের জন্য সাতশত মিলিয়ন ডলার ঋণ অনুমোদন করেছে। এই ঋণ কি জাতিসংঘ পরিষোধ করবে তা বাংলাদেশের জনগনের পকেট থেকে যাবে? এমন প্রশ্নের উত্তর কি জাতিসংঘ দেবে? ওই ঋণ বাংলাদেশের নিজস্ব প্রয়োজনে নেয়া অন্য আর একটি ঋণের শর্ত হিসেবে বাংলাদেশকে নিতে হচ্ছে। শরনার্থীরা বাংলাদেশ অবস্থান করলে লাভ অনেক পক্ষের। লোকসান শুধু বাংলাদেশের। গত কয়েক বছরে শরনার্থী শিবিরগুলো হয়ে উঠেছে অস্ত্র ও মাদক চোরাচালের অভ্যয়ারণ্য। মানবপাচার চলছে দীর্ঘদিন ধরে । শরনার্থী শিবিরগুলো হয়ে উঠেছে সকল ধরণের সন্ত্রাসীদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল। কয়েকশত একরের বন জঙ্গল উজার হয়েছে, বিপর্যস্থ হয়েছে পরিবেশ। এই শররার্থীদের দীর্ঘ উপস্থিতির কারণে দক্ষিণ চট্টগ্রামে দেখা দিয়েছে নানা ধরণের সামাজিক অস্থিরতা। যে দায় হওয়া উচিত ছিল সারা বিশ্বের সেই দায় বর্তমানে বাংলাদেশের মতো একটি ছোট দেশকে একা সামাল দিতে হচ্ছে। এই বিষয়ে গণতন্ত্র আর মানবাধিকারের ফেরিওয়ালারা কিন্তু একেবারেই নিশ্চুপ। এখন তারা ফিলিস্তিন নিয়ে ব্যাস্ত। এই ব্যাস্তাতার মাঝেও তারা ভুলে গিয়েছে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার মিয়ানমার নামক দেশটিতে দীর্ঘদিন ধরে আর একটি গণহত্যা চলমান আছে। বাংলাদেশের এখন উচিত স্পষ্ট ভাষায় জাতিসংঘ ও বিশ্বসম্প্রদায়কে জানিয়ে দেয়া বাংলাদেশ কোন অবস্থাতেই এই ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ে আর কোন ধরণের সহায়তা করতে অপারগ। এটি বাংলাদেশের একক কোন সমস্যা নয়। এই সমস্যা সমাধানের দায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের। বাংলাদেশে আর কোন দায় নিতে প্রস্তুত নয়। সকলের শুভবুদ্ধির উদয় হোক।
লেখক: বিশ্লেষক ও গবেষক
সারাবাংলা/এজেডএস