Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ভূমি পুনরুদ্ধারে নাগরিক সংহতি

পাভেল পার্থ
৪ জুন ২০২৪ ২০:৫৩

ঘূর্ণিঝড় রিমালের কারণে সুন্দরবনে নিহত হয়েছে সহস্র বুনো প্রাণ। মাত্র কিছু গাছ, হরিণ ও বুনো শূকরের লাশ আমরা খুঁজে পেয়েছি। উদ্ভিদ, প্রাণী ও অণুজীবসহ কত প্রাণ যে ভেসে গেছে কে জানে? দুই দিন লবনপানির তলায় ডুবেছিল সুন্দরবন। এতে সুন্দরবনের ভূমি ও বাস্তুতন্ত্র বিনষ্ট হয়েছে। বনের ভেতর সকল মিঠাপানির পুকুর লবনজলে তলিয়ে গেছে। এই ভূমি কীভাবে পুনরুদ্ধার হবে? দেশে একটি বিস্তারিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা আছে। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় রিমালের মতো আপদ-বিপদ পরবর্তী সুন্দরবনের মতো ভূমি পুনরুদ্ধার প্রশ্নে আমাদের কোনো পরিকল্পনা নাই। তাহলে বিশ্বের বৃহত্তম এই বাদাবনের প্রাকৃতিক বিকাশ কীভাবে হবে? ইরাবতী ডলফিন বা বাংলা বাঘের মতো বিপন্ন প্রাণীর বাস আমাদের সুন্দরবন উপকূল। রিমালের ক্ষত নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এই বৃহত্তম বনভূমির বুনোপ্রাণের এখন কী হবে? প্রতিবছর ৫ জুন বিশ্বব্যাপি পালিত হয় পরিবেশ দিবস। ২০২৪ সনের বিশ্ব পরিবেশ দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারিত হয়েছে ‘ভূমি পুনরুদ্ধার’। ‘মরুময়তা রুখতে এবং খরা সহনশীলতা বৃদ্ধিতে ভূমি পুনরুদ্ধারের জরুরত এনবার পরিবেশ দিবসে আবার ঘোষিত হলো। এর আগে করোনা মহামারির সময় ২০২১ সনে পরিবেশ দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল ‘বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধার’। বারবার প্রমাণিত হচ্ছে ভূমি ও বাস্তুতন্ত্রের পুনরুদ্ধার ছাড়া কোনোভাবেই এই গ্রহে আমরা টিকে থাকতে পারবো না। তবে পুনরুদ্ধারের প্রশ্নটি কোনো একক নিরপেক্ষ তর্কহীন বিষয় নয়। সামাজিক, প্রাকৃতিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নানামুখী বাহাস জড়িয়ে আছে ভূমি পুনরুদ্ধারের সাথে। আজ আমরা দীর্ঘস্থায়ী খরা কিংবা তীব্র লবণাক্ততা থেকে মুক্তি চাই, কিন্তু নানাভাবে বন্দী করে রাখা ভূমিকে মুক্ত করতে না পারলে আমাদের টিকে থাকা প্রশ্নের মুখে পড়বে। ভূমি আমাদের জীবনযাপনের কেন্দ্রীয় ভিত। ভূমি আজ সর্বগ্রাসী উন্নয়ন আর নয়াউদারবাদী কর্তৃত্বের দখল ও দূষণে বন্দী। একইসাথে দু:সহ জলবায়ু যন্ত্রণা বাড়ছে। দীর্ঘ হচ্ছে খরাকাল। মরূময়তার বিস্তৃতি বাড়ছে বিশ্বময়। খরা মোকাবেলায় গ্রামীণ জনপদে বহু লোকায়ত অভিযোজন অনুশীলন ও সংগ্রাম আছে। এসব অনুশীলনের স্বীকৃতি ও মর্যাদা দিতে হবে।

বিজ্ঞাপন

প্রাকৃতিক বন, নদী, জলাভূমি, কৃষিজমিসহ প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্র হত্যা করার ফলে খরা ও মরুময়তা দীর্ঘতর হচ্ছে। জীবাশ্মজ্বালানি নির্ভর উন্নয়ন-বাণিজ্য প্রতিনিয়ত বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়াচ্ছে। বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে জলবায়ুর উল্টাপাল্টা আচরণ ক্রমাগতভাবে বৈশ্বিক মরুময়তা তৈরি করছে। তাহলে ভূমি পুনরুদ্ধার প্রশ্নে ভূমিকে দখল ও দূষণমুক্ত করা যেমন জরুরি, একইসাথে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় রাজনৈতিক অঙ্গীকার বাস্তবায়ন জরুরি।

বিজ্ঞাপন

লাউয়াছড়া বনের দেশের একমাত্র আফ্রিকান টিক ওক গাছটি মরে গেছে। চামচ ঠুঁটো বাটান পাখি, চামড়াঝোলা ব্যাঙ বা রক্তচোখা কালো ব্যাঙের বৃহৎ বিচরণ অঞ্চল এই দেশ। উষ্ণমন্ডলীয় মৌসুমী জলবায়ুর এ দেশে ষড়ঋতুর বিস্ময়কর সমাহার। কিন্তু দেশের এই বৈচিত্র্য, প্রতিবেশ ও বাস্তুতন্ত্র আজ দীর্ণ। অপরিকল্পিত উন্নয়ন, বনউজাড়, জলাভূমি ভরাট, বৃহৎ খনন, রাসায়নিক কৃষি নানাভাবে দেশের প্রাণ-প্রকৃতির বিকাশকে রুদ্ধ করছে। দেশের নদী, মাটি, পাহাড়, অরণ্য, পাখি, বন্যপ্রাণ, জলাভূমি, উদ্যান সবখানেতেই হাহাকার। জবরদস্ত মুনাফামুখী উন্নয়নের ক্ষত। এই ক্ষত মানুষকেই সারাতে হবে। নিজের বাঁচার প্রয়োজনে। পরিবেশ ও ভূমির পরিবেশগত অবদান এবং সেবা বন্ধ হয়ে গেলে মানুষ একা কোনোভাবেই বেঁচে থাকতে পারবে না। কেবল দেশ নয়, দুনিয়া জুড়ে ভূমি বাস্তুতন্ত্র আজ মুর্মূষু ও বিক্ষত। বাস্তুতন্ত্রের সুচিকিৎসা, সহ¯্র নিরাময়, সুরক্ষা, বিকাশসহ সামগ্রিক পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ায় আজ আমাদের সকলকেই অংশ নিতে হবে। সমতল থেকে পাহাড়, বিল থেকে বরেন্দ্র, অরণ্য থেকে হাওর, উপকূল থেকে চর, গ্রাম থেকে শহর সকল শ্রেণি-পেশা-বর্গের নাগরিকদের।

প্রকৃতিতে মানুষের সাথে অন্যান্য উপাদানের এই পরস্পরনির্ভরশীল সম্পর্কের ভেতর দিয়ে তৈরি হয় এক একটি স্বতন্ত্র বাস্তুতন্ত্র বা বাস্তুসংস্থান। মানুষ হিসেবে আমাদের ভাবা দরকার আমরা কোন ধরণের বাস্তুতন্ত্রের সাথে মিশে আছে, এই বাস্তুতন্ত্র কীভাবে কী প্রক্রিয়ায় সেবা দিয়ে আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। কিন্তু মানুষ প্রতিদিন নিজের ভোগ আর মুনাফার জন্য বাস্তুতন্ত্রের এই ছন্দময় ব্যাকরণ চুরমার করে ফেলছে। আর এর প্রভাবেই জলবায়ু পরিবর্তনজনিত নানা দুর্যোগ কী করোনার মতো ভয়াবহ মহামারি সামাল দিতে হচ্ছে মানুষকে। ভূমি বাস্তুতন্ত্রের সামগ্রিক সুরতহাল নিয়ে আজ আমাদের বসা দরকার। কে কীভাবে ভূমির ক্ষতি করছে এবং এর পুনরুদ্ধারে কে কীভাবে ভূমিকা রাখবে তা নির্ধারণ করাও জরুরি। শালবন উপড়ে ফেলে যখন আগ্রাসি একাশিয়া, ইউক্যালিপটাস ও ম্যাঞ্জিয়াম বাগান করা হলো তখন স্থানীয় আদিবাসী মান্দি, কোচ, হাজংরা প্রতিবাদ করেছিলেন। দেখা গেছে আগ্রাসী গাছ বাগানের ফলে স্থানীয় বাস্তুতন্ত্রে মরূময়তা তৈরি হয়েছে। দেশের বিস্তীর্ণ খরাপ্রবণ উত্তরাঞ্চলে আগ্রাসি ইউক্যালিপটাস গাছ লাগিয়ে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর আরো নিচে নামিয়ে দেয়া হয়েছে। তাহলে ভূমি পুনরুদ্ধার প্রশ্নে আমাদের প্রাকৃতিক বনভূমি সুরক্ষা করতে হবে এবং আগ্রাসী গাছের রোপণ নিষিদ্ধ করতে হবে।

অনাবৃষ্টি, খরা এবং মরূময়তা উৎপাদনসহ সামগ্রিক জনজীবন ও প্রাণপ্রকৃতিতে তীব্র বিশৃংখলা তৈরি করে। খরাপীড়িত বরেন্দ্র অঞ্চলে সেচের পানি না পেয়ে অভিনাথ মার্ডী ও রবি মার্ডী নামের দুই সাঁওতাল কৃষক বিষপানে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হন। একইসাথে খরা সামাজিক বৈষম্য ও জেন্ডারগত সহিংসতা বাড়াচ্ছে। কারণ দেশের বরেন্দ্র ও উপকূল অব্জল যেখানে পানির তীব্র সংকট সেখানে খাবার পানি আনতে গিয়ে নারী ও শিশুদের কয়েক মাইল হাঁটতে হয়। বাড়ছে বঞ্চনা ও নিপীড়ন। কৃষিজমি গুলি প্রশ্নহীনভাবে অকৃষিখাতে চলে যাচ্ছে। ঐতিহাসিক কৃষিজমি গুলো দখল করে বহুজাতিক কোম্পানিরা হাইব্রিড ভূট্টা ও তামাক আবাদ করছে। এসব ঘটনা স্থানীয় ভূমি বাস্তুতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য এবং আর্দ্রতা বিনষ্ট করছে। বাড়ছে খরা প্রবণতা ও মরূময়তা। বিশ্বব্যাপি ক্রমবর্ধমান মরুময়তার অন্যতম কারণ ভোগবিলাসী পুঁজিবাদী জীবনযাপন। খরা ও মরূময়তা রুখতে যদি ভূমি পুনরুদ্ধার করতে হয় তবে প্রশ্ন করতে হবে আমাদের প্রবল খাদ্যচিন্তাকে। খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থাকে। মাটির তলার পানি অবিরামভাবে টেনে তুলে এবং রাসায়নিকের মাধ্যমে ভূমিকে বিপর্যস্ত করে সবুজবিপ্লব প্রকল্প এই মরূময়তাকে চাঙ্গা রাখছে। স্থানীয় প্রাণসম্পদনির্ভর প্রাকৃতিক চাষপদ্ধতি এবং কৃষিপতিবেশচর্চা এক্ষেত্রে আমাদের মুক্তির উপায় হতে পারে। আমাদের চোখের সামনে আমাদের ভেতর দিয়েই বদলে যাচ্ছে, বিপন্ন হচ্ছে চারপাশের পরিবেশ, প্রতিবেশ। দেশের দুটি রামসার অঞ্চল সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর ও সুন্দরবন আজ বিপন্ন। উত্তর-পূর্ব ভারতের মেঘালয় পাহাড়ে উপুর্যপরি কর্পোরেট কয়লা, পাথর ও ইউরেনিয়াম খনির ফলে টাঙ্গুয়ার হাওর ক্রমান্বয়ে এক প্রত্নতাত্ত্বিক জলাভূমিতে পরিণত হতে চলেছে। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎপ্রকল্পসহ সুন্দরবনের চারধারে গড়ে ওঠেছে শিল্পাঞ্চল। লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে বহুজাতিক খননে বারবার বিপর্যস্ত হয়েছে। রাতারগুল কী চিম্বুক পাহাড় বিপন্ন পর্যটনের চাপে। মধুপুর জাতীয় উদ্যান আগ্রাসি বাগান কী ইকোপার্কের আঘাতে ক্ষয়িষ্ণু অংশ নিয়ে টিকে আছে। উজানে বাঁধ আর ভাটিতে দখল ও দূষণের মাধ্যমে আজ দেশের সব নদী আজ মরণ যন্ত্রণায় অস্থির। প্রতিবেশ, বাস্তুতন্ত্র ও বৈচিত্র্য সুরক্ষার কোনো কার্যকর রাজনৈতিক দায় ও দায়িত্ববোধ তৈরি হয়নি রাষ্ট্রে। পরিবেশ কিংবা প্রাকৃতিক সম্পদ আজ নয়াউদারবাদী ব্যবস্থার বাণিজ্যিক পণ্য। কিন্তু তারপরও গ্রাম থেকে শহর এখনো বহু মানুষ পরিবেশ রক্ষায় জানপ্রাণ দিয়ে লড়ছেন। গ্রাম ও শহরের প্ররিবেশগত সমস্যা কী বাস্তুতন্ত্রের সংকট এক নয়। গ্রামীণ পরিসরের বাইরে শহরের বৈচিত্র্য, প্রতিবেশ ও বাস্তুতন্ত্র আরো বেশি ক্ষতবিক্ষত এবং নিশ্চিহ্ন। নগরে এখন পাবলিক উদ্যান, হাঁটার পথ, খেলার মাঠ, জলাশয় কী উন্মুক্ত স্থান দিনে দিনে কমছে। শহরের চারধারে জমা হচ্ছে বিপদজনক বর্জ্যের স্তুপ। ঢাকাসহ বড় নগরগুলো গড়ে ওঠছে অপরিকল্পিতভাবে এবং এখানে প্রতিনিয়ত বায়ুদূষণ এবং অভ্যন্তরীণ উষ্ণতা বেড়েই চলছে। ঢাকায় চিল, ইঁদুর, চিকা, কাক, চড়ুই, বেজি, পালিত বানর আর কিছু পতঙ্গ ছাড়া কোনো বন্যপ্রাণী চোখে পড়ে না। উদ্ভিদের বৈচিত্র্যর একেবারেই নি:শেষ। বাস্তুতন্ত্রের সর্বনাশ করে গড়ে তোলা এই নগর তাহলে নতুন প্রজন্মের কাছে কেমন শহর উপহার রাখছে? ভবিষ্যতের জন্য প্রাকৃতিক, সাংস্কৃতিক, স্বাস্থ্যগত কিংবা মনোসামাজিকভাবে কী এই শহর সবার জন্য বাসযোগ্য থাকবে? বাস্তুতন্ত্রের এমন ক্ষত নিয়ে কী তা সম্ভব? এর ভেতর আবার নগরের দরিদ্র অঞ্চলে বসবাসকারী বস্তিবাসী নাগরিকদের সামাল দিতে হয় সকল মৌসুমি দুর্যোগ, জলাবদ্ধতা, ঝুঁকিপূর্ণ কারখানার রাসায়নিক দূষণ কিংবা বিশাল আবর্জনার স্তুপ। নগর কী গ্রাম পরিবেশ ব্যবস্থাপনা ও ভূমি পুনরুদ্ধারে তাই আমাদের ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রের দায়িত্ববোধকে চাঙ্গা করা জরুরি। ভূমি বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধারে আসুন গড়ে তুলি সক্রিয় নাগরিক সংহতি।

লেখক: গবেষক, প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ

সারাবাংলা/এসবিডিই

পাভেল পার্থ ভূমি পুনরুদ্ধারে নাগরিক সংহতি মত-দ্বিমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর