Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

তথ্যপ্রযুক্তি খাতের স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের যাত্রা শুরু হোক

রাসেল টি আহমেদ
৬ জুন ২০২৪ ২১:০০

বেসিসের বাজেট প্রস্তাবনা মাথায় রেখে এবং স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ায় প্রত্যয়ে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের কর অব্যাহতির মেয়াদ তিন বছর বাড়ানোয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সমগ্র তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। পাশাপাশি স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে তথ্যপ্রযুক্তি খাত যে নিউক্লিয়াসের ভূমিকা পালন করবে, সে বিষয়টি উপলব্ধি করে এই খাতের কর অব্যাহতির মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব গ্রহণ করায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকেও (এনবিআর) ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই। তবে তিন বছর না হয়ে আমাদের দাবি অনুযায়ী ২০৩১ সাল, অর্থাৎ বাংলাদেশের উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়া পর্যন্ত বাড়ানো হলে তা তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে দেশীয় ও বিশ্ববাজারে সক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করবে।

বিজ্ঞাপন

এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, এই কর অব্যাহতি কেবল তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উন্নয়নে অবদান রাখবে, তা নয়। বরং স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে এটি শিক্ষা, স্বাস্থ্য সেবা, কৃষি, ব্যাংকিং ব্যবস্থা, রফতানিমুখী উৎপাদনশিল্পসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করবে, যা চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত এবং জ্ঞানভিত্তিক ক্যাশলেস অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এবং উদ্ভাবনের একটি নতুন জোয়ার তৈরি করবে বলে আমরা আশা করি। স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে এই প্রযুক্তিগত উন্নয়নগুলোর সম্মিলিত অবদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

বিজ্ঞাপন

সুতরাং এ বিষয়গুলো বিবেচনা করে খুব সহজভাবেই বলা যায়, যদি এ খাতের কর অব্যাহতির মেয়াদ বাড়ানো না হতো, তাহলে যেমনভাবে সব খাতের উন্নয়ন ব্যাহত হতো, ঠিক তেমনি প্রধানমন্ত্রীর ‘রূপকল্প ২০৪১’ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ বাস্তবায়নের অন্তরায় হয়ে দাঁড়াত। একইসঙ্গে আমরা মনে করি, প্রধামন্ত্রীর আজকের এই উদ্যোগের ফলে আমাদের দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে আমাদের দেশের সব ধরনের সফটওয়্যার ও তথ্যপ্রযুক্তি সেবার চাহিদার যেন পুরোটাই আমরাই মেটাতে পারি, বেসিসের এবং এর সদস্যের সেই অক্লান্ত যাত্রা আজ নতুন করে উজ্জীবিত হলো।

এখানে আমি উল্লেখ করতে চাই, তথ্যপ্রযুক্তি খাতের কর অব্যাহতির মেয়াদ বাড়াতে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে গণভবনে গত ২৫ মে ব্যবসায়ী নেতাদের প্রাক-বাজেট আলোচনায় আমি তথ্যপ্রযুক্তি খাতের প্রতিনিধি হিসেবে এই স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের কর অব্যাহিতর সময় বাড়ানোর গুরুত্বের বিষয়টি তুলে ধরি। পাশাপাশি আমরা বেসিসের পক্ষ থেকে বিষয়টি নিয়ে অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খান এবং ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান কাজী নাবিল আহমেদসহ খাতসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মানুষের সঙ্গে বৈঠক করি।

সর্বোপরি আমি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করতে চাই প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান ফজলুর রহমান এবং ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের প্রতি। তাদের সফটওয়্যার ও তথ্যপ্রযুক্তি পরিষেবার ওপর কর অব্যাহতির মেয়াদ বাড়ানোর জন্য ব্যক্তিগত ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টার প্রতিফলন আজ আমরা দেখতে পাচ্ছি।

তথ্যপ্রযুক্তি খাতে আমাদের স্বয়ংসম্পূর্ণতা হোক আমাদের আগামীর উদ্দেশ্য। আর সেই লক্ষ্য সামনে রেখে এবারের বাজেটকে আমরা আমাদের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের যাত্রা হিসেবে দেখতে চাই। তাই পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুলস যথাযথভাবে অনুসরণ করার মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিটি দফতরের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের কেনাকাটার ক্ষেত্রে দেশীয় তথ্যপ্রযুক্তি খাতকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়— সেটি নিশ্চিত করতে হবে। যদি কিছু ক্ষেত্রে এমন হয় যে দেশীয় তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা নেই, সে ক্ষেত্রে বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে যেন দেশীয় তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথ অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করে তারপর সরকারের টেন্ডারে অংশগ্রহণ করতে পারে— সরকারকে সেটির প্রতিপালনও নিশ্চিত করতে হবে।

আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, ২০২৬ সালে বাংলাদেশ যখন উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বিশ্বে আত্মপ্রকাশ করবে, স্বাভাবিকভাবেই অনেকগুলো প্রতিবন্ধকতা আমাদের সামনে আসবে। সেগুলোকে সুযোগে রূপান্তরের জন্য আমাদের এখনই প্রয়োজন ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি ভ্যালুয়েশনের জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা, যেন আমাদের উদ্যোক্তারা বাইরের বিনিয়োগ আকর্ষণ এবং দেশীয় ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে ঋণ ও বিনিয়োগ সহজেই সংগ্রহ করতে পারেন।

বর্তমানে আইসিটি খাত জাতীয় জিডিপিতে ১ দশমিক ২৫ শতাংশ অবদান রাখছে। ২০৪১ সাল নাগাদ দেশের ডিজিটাল অর্থনীতির আকার ৫০ বিলিয়ন ডলারে আমাদের অভীষ্ট লক্ষ অনুযায়ী পৌঁছাতে হলে আইসিটি খাতে কর অব্যাহতির মতো আরও কিছু উৎসাহব্যাঞ্জক নীতিসহায়তার প্রয়োজন রয়েছে। তাই কর অব্যাহতির আওতায় আগের মতো ক্লাউড সার্ভিস, সিস্টেম ইন্টিগ্রেশন, ওভারসিজ মেডিকেল ট্রান্সক্রিপশন, সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশান সার্ভিস, ওয়েবসাইট হোস্টিং, আইটি প্রসেস আউটসোর্সিং ও ন্যাশনওয়াইড টেলিকমিউনিকেশন ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক (এনটিটিএন) বাদ না দিয়ে অন্তর্ভুক্ত করা হোক।

প্রসঙ্গত, ব্যাক্তিগত উপাত্ত সুরক্ষা আইন (খসড়া) অনুযায়ী ক্লাসিফায়েড ডেটা লোকালাইজেশনের একটি বিষয় আছে। এ ক্ষেত্রে ওয়েব হোস্টিং ও ক্লাউড সার্ভিসেসের স্থানীয় বাজার যেভাবে বৃদ্ধি পেতে যাচ্ছে, তাতে বাংলাদেশি তথ্যপ্রযুক্তি ও পরিষেবা প্রতিষ্ঠানগুলোকে উদ্বুদ্ধ করতে এই দুটি খাতকে কর অব্যাহতির আওতায় অবশ্যই রাখা প্রয়োজন।

বর্তমানে দেশের ক্লাউড সার্ভিস ও ওয়েব হোস্টিংয়ের বাজার প্রায় ২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর মাত্র ১০ শতাংশ দেশীয় উদ্যোক্তারা ধরে রাখতে পেরেছেন। নতুন করে একে করের আওতায় আনা হলে তা বর্তমান দেশীয় উদ্যোক্তাদের এই ব্যবসা থেকে সরে আসতে বাধ্য করতে পারে এবং অন্যদিকে নতুন উদ্যোক্তাদের এই ব্যবসায় আসতে নিরুৎসাহিত করতে পারে। একইসঙ্গে ন্যাশনওয়াইড টেলিকমিউনিকেশন ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ককেও কর অব্যাহতির আওতায় রাখা যেতে পারে। তা না হলে ইন্টারনেটের দাম গ্রাহক পর্যায়ে বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

আমরা অবগত হয়েছি যে অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্কের বিনিয়োগকারীরা তাদের বর্তমান শুল্কমুক্ত সুবিধা হারিয়ে প্রায় সব ক্যাটাগরির মূলধনি যন্ত্রপাতির ওপর ১ শতাংশ আমদানি শুল্কের মুখোমুখি হতে পারেন। এটি পুনর্বিবেচনা করে হাইটেক পার্কের বিনিয়োগকারীদের জন্য বর্তমান শুল্কমুক্ত সুবিধা বহাল রাখার আহ্বান জানাচ্ছি। একইসঙ্গে এখানে বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য কর্মপরিকল্পনা পুনঃপ্রণয়নে প্রাইভেট সেক্টরের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে কাজ করার আহ্বান জানাচ্ছি, যেন আগামী কয়েক বছরে হাইটেক পার্কগুলোতে দৃশ্যত বৈদেশিক বিনিয়োগ বাড়ে।

আমরা আরও জানতে পেরেছি, মোবাইল ফোনের দামের ওপর ভিত্তি করে এর ওপর শুল্ক বসানোর প্রস্তাব করা হয়েছে এবারের বাজেটে। আমরা মনে করি, এটি পুনর্বিবেচনার সুযোগ রয়েছে। যেহেতু আমাদের যাত্রা এখন স্মার্ট বাংলাদেশের পথে, তাই মোবাইল ফোন, স্মার্টফোন, স্মার্ট ডিভাইস মানুষের হাতে হাতে পৌঁছে দেওয়া আমাদের অন্যতম লক্ষ্য হওয়া উচিত। তাই এই শুল্ক বসানোর প্রস্তাব পুরোপুরিভাবে উঠিয়ে দেওয়া প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি। না হলে তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নের কল্যাণ একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ে পৌঁছানো যাবে না।

সবশেষে আমি আরও একবার বলতে চাই, তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পেই গড়বে স্মার্ট বাংলাদেশ। তাই এই খাতকে করমুক্ত রাখার পাশাপাশি সরকারি নীতিগত সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে তথ্যপ্রযুক্তিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তোলা হোক।

লেখক: সভাপতি, বেসিস

সারাবাংলা/টিআর

কর অব্যাহতি তথ্যপ্রযুক্তি খাত বাজেট বাজেট ২০২৪-২৫

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর