বাজেটে কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগ কতটা গুরুত্ব পেয়েছে?
১১ জুন ২০২৪ ১৬:৪৮
বাজেট হচ্ছে একটি দেশের সম্ভাব্য আয়-ব্যয়ের হিসাব। সরকারকে দেশ চালাতে হয়, সরকারের হয়ে যারা কাজ করেন, তাদের বেতন দিতে হয়, আবার নাগরিকদের উন্নয়নের জন্য রাস্তাঘাট বানানোসহ নানা ধরনের উদ্যোগ নিতে হয়। একটি নির্দিষ্ট অর্থবছরে কোথায় কত ব্যয় হবে, সেই পরিকল্পনার নামই বাজেট।
বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে অর্থ মন্ত্রণালয় এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। সাধারণত একজন মানুষকেও কিন্তু আয় ও ব্যয়ের হিসাব করে জীবন জীবিকা চালাতে হয়। তবে ব্যক্তির সঙ্গে রাষ্ট্রের বাজেটের একটি মৌলিক পার্থক্য আছে। সাধারণত ব্যক্তি আগে আয় কত হবে, সেটি ঠিক করেন, তারপর ব্যয়ের খাতগুলো নির্ধারণ করেন।
অন্যদিকে, রাষ্ট্রের নীতি উল্টো। রাষ্ট্র আগে ব্যয়ের খাতগুলো নির্ধারণ করে তার কোন কোন খাত থেকে আয় করা যায় সেটি ঠিক করে থাকে।
দুঃখজনক হলেও সত্য তা হলো, মানুষের চাহিদাগুলো যদি জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে ফুটে উঠতো তাহলে তাদের চাহিদাগুলোর প্রতিফলন ঘটতো। কিন্তু আমাদের দেশে আমলা আর প্রভাবশালী গোষ্ঠীগুলোই বাজেটে প্রভাব রাখে, সাধারণ জনগণের কোনো প্রভাব নেই ।
বর্তমানে অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক—উভয় দিকেই এক বৈরী পরিবেশ মোকাবিলা করে চলেছে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি। এমন এক পরিস্থিতিতে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবনা উপস্থাপন ছিল অনেকটাই চ্যালেঞ্জের। যে কারণে অন্যান্য বারের মতো বাজেটের আকার খুব বেশি না বাড়িয়ে বরং আয়ের দিকেই বেশি নজর দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। কিন্তু অর্থনীতির মূল চ্যালেঞ্জগুলো কাটিয়ে ওঠার পদক্ষেপ মজবুত ভিত পায়নি। এ কথাও সত্য যে, প্রভাবক অনেক কিছুই এখন আর নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নেই। বিশ্ববাজার-ব্যবস্থাকে আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। অস্থিরতা যখন দেশে-বিদেশে, তখন প্রক্ষেপিত উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোতে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়বেই।
বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ডলার-সংকট, মূল্যস্ফীতির কাছে ক্রমশই পরাজিত হয়ে যাচ্ছে। পণ্যমূল্য বৃদ্ধির যে ট্রেন্ড এখানে চালু হয়েছে, তা থামানোর সবগুলো পদক্ষেপই কার্যত ফলপ্রসূ হয়নি। মূল্যস্ফীতি থামানোর যে পদক্ষেপের কথা প্রস্তাবিত বাজেটে বলা হয়েছে, তা আসলে গতানুগতিক প্রক্রিয়া। কিন্তু এই প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে গিয়ে গোটা অর্থবছরকেই এক ধরনের সম্ভাব্য স্থবিরতার শঙ্কায় ফেলে দেওয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এর কিছুটা চাপ ছিল। সে কারণে সংকোচনমুখী পদক্ষেপ নিতে গিয়ে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগপ্রবাহ কমিয়ে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। বেসরকারি বিনিয়োগপ্রবাহ কমে গেলে শিল্পায়ন হবে না। কর্মসংস্থান হবে না। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও প্রত্যাশিত হারে আগানো সম্ভব না। কাজের সুযোগ করে দিতে যদিও অর্থমন্ত্রী বলেছেন, সরকারি ব্যয়ের পরিমাণ কিছুটা বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে। যদি সেটি করাও হয়, তার গুণমান নিয়ে বরাবরই প্রশ্ন রয়েছে এবং যতটুকুই টাকার সরবরাহ বাজারে যাবে, সেই হারে মূল্যস্ফীতিও ঊর্ধ্বমুখী হবে।
বাজেটে সাধারণের প্রত্যাশা ছিল পণ্যমূল্য ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আসবে। জনসাধারণের আয়ের তুলনায় জীবনযাত্রার ব্যয়টা অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন বেশি। অনেক দিন ধরেই ডলার-সংকটের কারণে আমদানি ঋণপত্র (এলসি) খোলার হার কমেছে। ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে আমদানিকৃত পণ্যের দামও বেড়েছে। অনেকগুলো সেবার বিনিময়েও প্রদত্ত ডলারের দাম বেশি হওয়ায় সেই সব সেবা পেতেও জনগণকে বাড়তি ব্যয় করতে হচ্ছে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা প্রস্তাবিত বাজেটে প্রতিফলিত হয়নি। উপরন্তু, দরিদ্র ও বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে দেওয়া ভাতা সুবিধাদিও আগের হারেই রয়েছে। উপকারভোগীর সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে মাত্র। ফলে, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী এ অর্থবছরে বেশি সুসংহত হওয়ার দিকে ধাবিত হবে না।
এ ধরনের পরিস্থিতিতে অভ্যন্তরীণভাবে সম্পদের কার্যকর ব্যয় নিশ্চিত করা জরুরি ছিল। যেমন—বেসরকারি উদ্যোগগুলোকে প্রসারিত করতে সহায়ক পদক্ষেপের কথা অগ্রাধিকার তালিকায় রাখা। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের প্রসারে পদক্ষেপ নেওয়া। শ্রমঘন শিল্পে বেশি সুবিধাদি দিয়ে কর্মসংস্থান ও বেসরকারি সঞ্চয় ও বিনিয়োগে উত্সাহিত করার ভীষণ দরকার ছিল। কিন্তু সরকার নিজেই ব্যাংক থেকে ঋণ না নিয়ে চলতে পারবে না। বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে কর্জ করার বাইরেও সরকারের একটা বড় সাপোর্ট দেশীয় ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ নেওয়া। এটি সহজ হওয়ায় সেদিকে নজর বেশি দেওয়া হয়েছে। তাতে বেসরকারি খাতে ঋণের চাহিদা পূরণ করা যাবে না। বেসরকারি উদ্যোগগুলো তৈরি করা এবং প্রসারে অর্থায়ন না করলে অর্থনীতিতে শক্ত ভিত তৈরি হবে না।
এই মুহূর্তে ব্যাংকগুলো হাত গুটিয়ে বসে আছে। কিছু বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া ঋণ প্রদান অনেকটাই বন্ধ। সিংগেল ডিজিট সুদ হার থেকে বেরিয়ে আসাও শিল্পের জন্য নেতিবাচক হয়েছে। এর মধ্যে অর্থায়নে সংকোচন নীতি গ্রহণ করা মানে আগামী বছরেও এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের খুব একটা লক্ষণ নেই। তবে অর্থনীতিকে প্রবৃদ্ধির পথে হাঁটানো কীভাবে সম্ভব ?
প্রস্তাবিত বাজেটে অধিক হারে রাজস্ব আদায়ে জোর দেওয়া হয়েছে। আদায় করতে হলে অন্যকে আয়ের সুযোগ দিতে হবে। সেই সুযোগগুলো সীমিত, স্তিমিত করে দিয়ে অধিক আদায়ের প্রক্ষেপণ বাস্তবমুখী হয়নি। মোট ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের প্রক্ষেপণে আয়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা। রাজস্ব বোর্ড নিয়ন্ত্রিত আয়ের মধ্যে মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট থেকে আয় হবে ১ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকার বেশি। আয় বাড়ানোর জন্য ঢালাও ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভ্যাটের হার ১০ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। একইভাবে আমদানি শুল্ক ও সম্পূরক শুল্ক হার রয়েছে আদায়ের অন্যতম খাত হিসেবে। ডলার-সংকটে যেখানে এলসি খোলা যাচ্ছে না, সেখানে আমদানি শুল্ক আয়ের জন্য ডলার-সংকট ও বেসরকারি খাতের সুবিধা বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা উপেক্ষিত হয়েছে। শুধু সম্পূরক শুল্প আরোপের মাধ্যমে ৬৫ হাজার কোটি টাকার বেশি আয়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। বছর শেষে ঘাটতির আগাম পূর্বাভাস স্পষ্ট।
বাজেটে নেওয়া পদক্ষেপের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও জনজীবনে স্বস্তি প্রদান গুরুত্বপূর্ণ। সে দিকগুলো নিয়ে সংশয় তো থাকছেই। উপরন্তু, অপ্রদর্শিত অর্থে কম কর ধার্য করার বিপরীতে আয়ের ওপর সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ কর নির্ধারণ যৌক্তিক হয়নি। আয়করের সর্বনিম্ন স্তরেও পরিবর্তন করা দরকার ছিল। বর্তমান মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় করমুক্ত আয়সীমা আরো বাড়ানো যেত। তবে পুরো বাজেট প্রস্তাব জুড়ে মূল্যস্ফীতির বিষয়টি গুরুত্ব পেলেও পদক্ষেপগুলো মূল্যস্ফীতি রুখতে সঠিক ও যথোপযুক্ত হয়নি বলে মনে করি ।
সারাবাংলা/এসবিডিই
অমিত বণিক বাজেটে কর্মসংস্থান ও বিনিযোগ কতটা গুরুত্ব পেয়েছে? মত-দ্বিমত