দুর্নীতির কালো ম্যাঁও ধরবে কে!
১২ জুন ২০২৪ ১৬:২৩
বছর তিনেক আগের একটা ঘটনা বলি। সবেমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে ঢাকায় আসলাম। চাকরি-বাকরি কিছু হচ্ছিল না। দিন-রাত এক করে চাকরি জন্য পড়ি। সন্ধ্যার পর দুইটা টিউশনি করাই। সামান্য যা কিছু সম্মানী পাই তা দিয়ে আধপেটা করে ঢাকায় একটা জীবন পাড় করছিলাম। শুরুর দিকে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল এন্ড কলেজের সামনের কলোনীতে পড়াতাম। তারপর গোলাপবাগ মাঠের কোনায় পুলিশ কোয়ার্টার রঙধনুতেও পড়ানো শুরু করি। আসা-যাওয়া মিলিয়ে ম্যালা ঝক্কি-ঝামেলা পোহাতে হতো। নিজের সুবিধার জন্য সিডিউলে পরিবর্তন আনলাম। প্রথমে রঙধনুতে পড়িয়ে, অতঃপর কলোনিতে। এভাবে নিয়মিত পড়াচ্ছি। একদিন যাওয়ার সময়, সন্ধ্যার ঠিক আগে আগে, সায়েদাবাদ টার্মিনালের ভেতরে ফ্লাইওভারের উত্তরের পয়েন্ট থেকে নেমে রঙধনুতে ঢুকবো, রঙধনু সামান্য আগে মাঠের কোনার পুলিশ চেকপোস্ট আমার পথ আটকে দিলো। আটকানোর কি কারণ জিগ্গাস করতেই বললো আমার সাথে সন্দেহজনক কিছু আছে, তাদের কাছে সোর্স থেকে আপডেট আছে। একজন ভদ্র আচরণ করা নাগরিকের সাথে পুলিশ কি রকমের বাজে আচরণ করতে পারে তার স্বাক্ষী হয়েছি নিমিষেই। ওরা আমার পকেটে হাত দিয়ে গোটা পাঁচেক ইয়াবা বের করে ফেললো!
আমার চোখ তো ততক্ষণে চড়কগাছ, ওরা কি যাদু জানে নাকি! শারীরিক গঠনে আমি হ্যাংলা-পাতলা, যারা না চিনে তারা মনে করতে পারে যে সারাদিন নেশাদ্রব্যে বুঁদ হয়ে থাকি। যাহোক সরাসরি কখনো এই জিনিস দেখি নাই, কি থেকে কি হচ্ছে বুঝতেও পারছিলাম না। চেকিং এর নামে ওরা হেনস্তা করছিলো। এর ভেতরে এসআই ধাঁচের একজন বললো ওর কাছে আরো আছে, মানিব্যাগেও দেখো, বলতে বলতেই কনস্টেবল ধরনের একজন আমার মানিব্যাগ বের করে ফেললো। তৎক্ষণাৎ তার হাত থেকে ওয়ারলেসওয়ালা লোকটা মানিব্যাগ নিয়ে দেখতেছিলো। মানিব্যাগ চেক করতে গিয়ে ওদের চেহারা আর চেহারা নাই, মুখগুলো পাংশু বর্ণের ধারণ করেছে। মনে হলো আচমকা ওরা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা এর ভেতরে চলে আসলো। মেজাজ বিগড়ায়ে একটা প্রশ্ন ওদেরকে করেছিলাম, যে ছেলের হাতে বই থাকে এবং পাশেই পুলিশ কোয়ার্টারে টিউশনি করতে যাচ্ছে, সে ইয়াবা নিয়ে স্টুডেন্টের সামনে যাচ্ছে এইটা আপনাদের মনে হয়? আর যাহোক কোন শিক্ষক তার স্টুডেন্টের সামনে আপনাদের মতো এতোটা নোংরা না! ঊর্ধ্বতন লোকটা পরিস্থিতি বুঝতে পেরে এবং আমার দিকে তাকিয়ে বললো, “সরি ভাই, মিস-আন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়েছে।” অন্য একজনকে নির্দেশনা দিয়ে বললো, “ভাই ভালো লোক। তাকে কোয়ার্টারে এগিয়ে দিয়ে আসো।” এই হলো নীতিবানদের নৈতিকতার বয়ান। শক্তের ভক্ত, নরমের যম!
ঘূর্ণিঝড় রিমাল যে দিন হচ্ছিলো তার পরদিনের কথা। মহাখালী বাসস্ট্যান্ডের উল্টো পাশে, এক্সপ্রেসওয়ের এক মাথা যেখানে নেমেছে ওখানে। বেলা সাড়ে নয়টার কাছাকাছি সময়। একটা বিআরটিসি বাস দাঁড় করিয়ে রাখা। বাসের ভেতরে চালকের আসনে বসা ব্যক্তি এবং দু’জন পুলিশ সদস্যের আলাপ দেখতে পেলাম। আমাদের গাড়ি কাছাকাছি এসে অতিক্রম করার সময়ে দেখলাম বিআরটিসি’র চালক পুলিশ একজনের হাতে পঞ্চাশ টাকার কয়েকটা নোট তুলে দিছেন। যাত্রীবাহী গাড়ি দাঁড়া করিয়ে কিসের টাকা নিচ্ছেন কারো না বুঝতে পারার কথা নয়। অথচ তার আগের দিন ঠিক ওখানেই রাস্তায় পূর্ব পাশে দেখলাম বৃষ্টিতে ভিজে কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে যানজট না লাগার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা। মনের ভিতরে একটা প্রশান্তির উৎফুল্লতায় ‘বাহ!’ শব্দটি উচ্চারণও করেছিলাম। এক দিনের ভেতরেই সেই প্রশান্তির আবছায়া উবে গেল তাদেরই আচরণে। বলছি না যে পুলিশের সকলেই খারাপ। বরং পরিচিত অনেক জন এখানে আছে যারা প্রবল মাত্রায় সৎ। অনেক ভালো লোকের ভেতরে হাতে গোনা মুষ্টিমেয় দু’এক জন খারাপ লোক থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু বাস্তবতায় এই দু’এক জনের জন্য সকলের প্রতি ঘৃণা চলে আসে। কেননা এক বালতি দুধের ভেতরে এক ফোটা চ্যানা পরাই যে অপবিত্র হওয়ার জন্য যথেষ্ট। সুতরাং এই দু’এক জনকে নিয়ন্ত্রণে নেওয়া ঊর্ধ্বতনের কর্তব্য।
পুলিশের সাবেক প্রধান বেনজির আহমেদ ইদানীং যুক্তরাষ্ট্র কতৃক নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে। আলোচনা-সমালোচনায় তাকে মুখোমুখি করা হয়েছে দুর্নীতির কাঠগড়ায়। ঢাকাসহ একাধিক জেলায় তার আছে ৬ শতাধিক ঊর্ধ্বে জমি, ৩৩টি ব্যাংক হিসাব, গুলশানের মতো ভিআইপি এরিয়াতে ৪টি ফ্ল্যাট, ১৯টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার মালিকানা, শেয়ার কেনা বেচার জন্য ৩টি বিও হিসাব, ৩০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র। ভাওয়ালের গড়ে বন দখল করে গড়ে তুলেছেন সাম্রাজ্য। দেশের বাইরে থাইল্যান্ড-মালয়শিয়ায় আছে জমি, দুবাইয়ে হোটেল আর সিঙ্গাপুরে সোনার ব্যবসা। একবার ভাবুন তো রাষ্ট্রীয় একজন কর্মচারী সামান্য কয় টাকা মায়না পেয়ে কিভাবে সম্পদের পাহাড় গড়তে পারে? বেনজির সাহেব কি এমন আলাদীনের চেরাগ পেয়েছিলেন যার জন্য কাড়ি কাড়ি টাকার সম্পত্তি হয়ে গেল! এই চেরাগের ইতিকথা সকলের অজ্ঞাত ছিল এমন কি? না, এরা সরকারের রাজনীতির চৌকাঠ ডিঙ্গিয়ে ক্ষমতার আসকারায় জনগণকে বাগিয়ে পেয়েছে। জনসাধারণের পকেট কেটে খালি করেছে। বেনজির আহমেদের সাথে নিষেধাজ্ঞায় পরেছেন সাবেক সেনা প্রধানও।
রাষ্ট্রীয় কর্মচারীদের ক্ষমতার বিরুদ্ধে কথা বলবে এমন কোন আইন আদালত এ দেশে ছিলো কিনা কে জানে! সময় ফুরিয়ে এখন এসে উচ্চ আদালত নির্দেশ দিয়েছে সমস্ত স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি জব্দ করার। খবর বেরিয়েছে জনাব বেনজির আদালতের নির্দেশের আগেই চম্পট। কথা হলো জনাব বেনজির কি আজকে থেকে এই দেশে ছিলো? কিংবা লুকিয়ে লুকিয়ে কিছু করেছে? করেনি। দিনের আলোয় সে তার ব্যক্তি সাম্রাজ্যবাদের বিস্তার ঘটিয়েছে। একটা বাহিনীর প্রধান ছিলো, জনগণের হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করেছে যাচ্ছেতাই। সবাই দেখেছে , জেনেছে, শুনেছে; অথচ কেউ কথা বলেনি, কারণ বললে তাদের ক্ষমতা হারানোর ভয়। কথা যা বলার প্রগতিশীল সমাজ বলেছে। যদিও তা মানুষের কর্ণকুহর ভেদ করে মস্তিষ্কে নাড়া দেয়নি। এখন বড় বড় খবরের কাগজে পাতা জুড়ে কভারেজ হচ্ছে, খবরের কাটতিও ভালো যাচ্ছে; অথচ যখন জনগণের পকেট কাটা হয়েছে কেউ উঁহু শব্দটি পর্যন্ত করেনি। কেন করেনি? করলে তাদের জাত যায়, আবার নানা কালাকানুনের কারনে পত্রিকার সম্পাদকদের দেখে নেওয়ার একটা প্রবণতা তো চালু হয়েছেই। যাহোক অঘটন ঘটার সময়ে যদি রয়ে সয়ে পত্রিকাগুলো সামান্যতম রিপোর্ট করতো রাষ্ট্রীয় পয়সার দুর্নীতির হরিলুট অন্তত থামানো যেত। নাকি এই বাংলাদেশে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকাদের দুর্নীতি থামানোর সক্ষমতা নেই? সক্ষমতা নাই এই শব্দটা অন্তত বিশ্বাস করি না। কেবল যদি সৎ-নিষ্ঠাবান-দায়িত্বশীলদের হাতে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়া যায়; বিশ্বাস রাখতে চাই যে এ দেশের নিরাপত্তার দায়িত্বে যারা আছে তারা চব্বিশ ঘন্টায় রাষ্ট্র মেরামত করে দিতে শতভাগ সক্ষম। সেই প্রযুক্তি, সেই অভিজ্ঞতা, আহরিত জ্ঞান, ধ্যান, স্মরণীয় কর্মযজ্ঞ তাদের আছে।
প্রবাদবাক্য হয়ে উঠেছে “মাছের রাজা ইলিশ, দেশের রাজা পুলিশ।” ভূমি অফিসগুলোর কর্মকর্তারা তো রেজিস্টি করতে জমির শতকরার হিসাব করে টেবিলের নিচ দিয়ে টাকা ব্যক্তি পকেটে টুকায়। তাদের এক একটা স্বাক্ষরেও নাকি খুব দাম! প্রতিবন্ধী-বৃদ্ধ কিংবা বিধবা ভাতা প্রদানে সমাজকল্যাণ অফিসারদের উপরি পাওনা না শোধরালে রাষ্ট্রের মানবিক পদক্ষেপটাও বাস্তবায়িত হয় না। এক কথায় দারিদ্র্য মানুষকে কৌশলে ফেলে ওরা ঘুষের টাকা আদায় করে। সর্বোপরি যেই দেশে চাকরি পেতে ঘুষ লাগে, মেধাবীরা অবহেলিত হয়; বিপরীতে একজন অফিস সহকারী নিজস্ব হেলিকপ্টারে কিংবা প্রাইভেট কারে করে এসে অফিস করার ক্ষমতা দেখায়, দিনের পর দিন ফাইল টেবিলের কোনায় ফেলে রাখে, সেখানে দুর্নীতি পাগলা ঘোড়া লাগাম ছাড়া হবে না তো হবে কি! দিন যতো গড়াচ্ছে, মানুষের আচরণে নীতি নৈতিকতা শিকেয় তুলছে। নীতি-নৈতিকতা,ধৈর্যশীলতা, মানবিকতা, মহানুভবতা কারো ধারে-পাশে নাই। দুর্নীতির প্রবণতা রন্ধ্রে রন্ধ্রে। পাঠকগণের বোঝার সুবিধার্ধে আরেকটু বিস্তারিত বলি— ধরুন একদিনের জন্য ঘোষণা দেওয়া হলো যে অমুক তারিখে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা বাহিনীগুলোর সকল সদস্য ছুটিতে থাকবে, দায়মুক্তি থাকবে সকল কর্মযজ্ঞের। তারপর দেখেন না কি হয়। যে যেভাবে পারবে তার ছড়ি ঘুরাবে। শহর থেকে গ্রামে এক দিনের লুটপাটের মহড়া চলবে। এখন সুযোগ পাচ্ছে না, তাই সকলেই সাধু। আগে ভিক্ষা দিতাম, কেউ বিপদে পরলে এগিয়ে যেতাম। এখন আর দেই না, ভিক্ষা এখন ব্যবসা, যে যতো পারে মানুষকে ব্লাকমেইল করে ভিক্ষা আদায় করে। কে যে আসল আর কে নকল বোঝা বড় দায়।
মাঝে মধ্যে ব্যবসায়িক নানা দ্বন্দ্বে দুর্নীতির তারকাদের কার্যকলাপ আয়নায় ভেসে ওঠে। দেশটা উচ্ছন্নে গেল। আমরা দর্শক মাত্র। হা-হুতাশ ছাড়া কিছুই করার থাকে না। কালো ম্যাঁও ধরা যাদের দায়িত্ব তারাই নখদন্তহীন বাঘে রূপান্তরিত, কারোর নৈতিকতার ঠিক নেই। শাসিতের নৈতিকতা হ-য-ব-র-ল হলে শাসকও তেমনই হয়। চারদিকে নামছে ঘোর অমানিশা। আমরা মুষ্টিমেয় নাচের পুতুল নেচে যাচ্ছি। আর পারছি না। আমাদের মুক্তি দাও।
লেখক: পরিবেশবাদী, মানবাধিকার কর্মী ও প্রাবন্ধিক
সারাবাংলা/এসবিডিই