ইরান চুক্তি বাতিল: যেসব কারণে ইউরোপের বিরুদ্ধে ট্রাম্প
৩১ মে ২০১৮ ১২:৫৫
যুক্তরাষ্ট্রকে ইরান চুক্তিতে ধরে রাখতে চেষ্টা চালিয়েছে ফ্রান্স, জার্মানি ও যুক্তরাজ্য। কিন্তু কারো কথায় কর্ণপাত করেননি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি শুনলেন ইসরায়েল ও সৌদি আরবের কথা। ইরানকে ঠেকানোর কথা বলে মধ্যপ্রাচ্যে নতুন খেলায় নেমে গেলেন। ইরানের সঙ্গে হওয়া ছয় জাতির পরমাণু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বের করে আনার ঘোষণা দেয়ার পাশাপাশি দেশটির ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞাও আরোপ করেছেন ট্রাম্প। যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপের ফল কী হবে, না হবে সেসব প্রসঙ্গ বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ রয়েছে। আপাতত কেবল এই প্রশ্নটার উত্তর খোঁজা যাক যে, কেন এতদিনের মিত্রদের অবজ্ঞা করল যুক্তরাষ্ট্র? ট্রাম্প-ইউরোপ দ্বন্দ্বের মূলসূত্র কোথায়? কেন যুক্তরাষ্ট্রের এই বিধ্বংসী মনোভাব?
১. যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি ও রাজনীতির ওপর যে চাপ ঘনীভূত হয়েছে, ইউরোপ থেকে সে পরিমাণে সহযোগিতা পাচ্ছে না তারা। উল্টো ইউরোপের দেশগুলোতে যখন ট্রাম্পের নেতৃত্ব নিয়ে নানামুখী সমালোচনা হয়েছে, সেসব দেশে যখন ট্রাম্পের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হয়েছে, তখন সৌদি আর ইসরায়েল তার প্রতি সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে বিনিয়োগ ও সহায়তার ক্ষেত্রেও দেশ দুটি কোথাও কোনো কার্পণ্য করেনি। ফলে ডোনাল্ড ট্রাম্প, যিনি আমেরিকা ফাস্ট বলতে পছন্দ করেন এবং কূটনীতিতে যার তেমন কোনো আস্থা নেই, তার কাছে ইউরোপের দেশগুলোকে খুব বেশি প্রয়োজনীয় বলে মনে হয়নি।
২. ট্রাম্প বরাবরই ইউরোপকে তার দেশের অর্থ ব্যয়ের কারণ মনে করেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব-প্রতিপত্তির পেছনে এসব দেশের সহায়ক ভূমিকাকে তিনি গুরুত্ব দেন না। তিনি মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র না থাকলে এসব দেশের নিরাপত্তা ভেঙে পড়ত। অথচ এই ব্যয়টা শুধু তার দেশকেই বইতে হয়। পরিসংখ্যানও যুক্তরাষ্ট্রের বিশাল ব্যয়ের চিত্রই তুলে ধরে। গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ব্যয় ছিল ৬১ হাজার কোটি মার্কিন ডলার। ফ্রান্স এ খাতে ব্যয় করেছে মাত্র ৫ হাজার ৭৮০ কোটি মার্কিন ডলার। যুক্তরাজ্য করেছে আরও কম, মাত্র ৪ হাজার ৭৭২ কোটি মার্কিন ডলার। সেই তুলনায় সৌদির ব্যয় অনেক বেশি। গত বছর দেশটি অস্ত্র কিনতে ব্যয় করেছে ৬ হাজার ৯৪০ কোটি মার্কিন ডলার। ইউরোপের দেশগুলোর সামরিক ব্যয় নিজেদের সমরাস্ত্র নির্মাণে, আর সৌদির ব্যয়টা হয় যুক্তরাষ্ট্র থেকে অস্ত্র ক্রয়ে। এই হিসাবটাকেই আমলে নিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান নীতি নির্ধারকরা।
৩. ২০১৫ সাল থেকে নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার পর তেল বিক্রির ক্ষেত্রে ডলারের পরিবর্তে বিকল্প মুদ্রাকে সমর্থন করছে ইরান। গত ১৮ এপ্রিল ২০১৮ দেশটি ঘোষণা দিয়ে বসে যে, এখন থেকে তারা বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ ডলারের পরিবর্তে ইউরোতে গড়ে তুলবে। বিশ্বের পঞ্চম প্রধান তেল উত্তোলনকারী দেশ হিসেবে ইরান যখন বিশ্বের এক নম্বর তেল আমদানিকারক দেশ চীনের সঙ্গে ডলারের বিপরীতে চীনা মুদ্রা ইউয়ান বা অন্য দেশগুলোর সঙ্গে ইউরো লেনদেন করে, সেটা যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির ওপর বিরাট চাপ সৃষ্টি করে। এমনকি এক নম্বর তেল উত্তোলনকারী দেশ রাশিয়া ও শীর্ষ দশে থাকা ভেনেজুয়েলাও একই পথ অনুসরণ করছে। বিপরীতে কেবল সৌদি আরবই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এমন চুক্তিতে আবদ্ধ যে, তারা তেলের তাবৎ লেনদেন ডলারে করতে বাধ্য। ফলে ডলার এখন ইউয়ান ও ইউরোর চ্যালেঞ্জের মুখে।
৪. ডলারের এই বিপদের দিনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ইউরোপ কোনো সহযোগিতার হাত বাড়ায়নি। বরং যুক্তরাষ্ট্র যে ডলারের বিপরীতে স্বর্ণ জমা রাখে না- যা ব্যাংকিং-এর প্রধান শর্ত, ১৯৭১ সালে প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের করা এক আইনের বলে দেশটি যে যখন তখন যত খুশি ডলার ছাপাতে পারে- এটা বিশ্ব অর্থনীতির জন্য ভারসাম্যপূর্ণ নয় বলে মনে করে ইউরোপের অনেক দেশ। ফলে তারা ইউরোপের মধ্যে ইউরোর যে বাজার গড়ে তুলেছে, সেটাই বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে লেনদেনের মুদ্রায় পরিণত করতে চাইছে। ইউরোর বাজারের এই সম্প্রসারণ যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি ও ডলারের জন্য ভয়ঙ্কর এক আঘাত। এরকম পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি স্বাভাবিকভাবেই শত্রু-মিত্রের তালিকা পুনঃনবায়ন করে পথ চলার নীতি গ্রহণ করেছে।
৫. রাজনীতিটাও এর সঙ্গে যুক্ত। যুক্তরাষ্ট্র রাজনৈতিক দিক থেকেও গোটা বিশ্ব থেকে বিরাট চাপ অনুভব করছে। বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যের সিরিয়ায় তারা যেন এক কথায় পরাস্ত হয়েছে। রাশিয়াকে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দিয়ে কিছুটা দাবিয়ে রাখা গেলেও পরমাণু চুক্তির কারণে ইরানের ওপর বাড়তি নিষেধাজ্ঞা আরোপের পথ বন্ধ ছিল। এই সুযোগে ইরান ক্রমশ মধ্যপ্রাচ্যে তার শক্তি বিস্তৃত করছে, গড়ে তুলছে অস্ত্রভাণ্ডার। এর বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্র কার্যকর কোনো উপায় বের করতে পারেনি। শুরতে যে যুক্তরাষ্ট্র রাজনৈতিক সমাধানের কোনো চেষ্টা চালায়নি, ব্যাপারটা তেমন নয়। অব্যাহতভাবে তারা ইরানের উত্থানকে কেন্দ্র করে মিত্রদের মধ্যে প্রচার চালায় এবং নিজ স্বার্থের অনুকূলে এই সংকট সমাধানের প্রস্তাবও দেয়। কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই ইরান সেসব প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। ইউরোপীয় সহযোগীরাও এক্ষেত্রে শক্তভাবে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে দাঁড়ায়নি।
৬. যুক্তরাষ্ট্রের আনীত অভিযোগগুলো হলো- ক) পরমাণু চুক্তি সত্ত্বেও ইরান আন্তর্জাতিক তদন্ত দলকে ফাঁকি দিয়ে গোপনে পরমাণু অস্ত্র উন্নয়ন কর্মসূচি চালু রেখেছে। যদিও এই অভিযোগের সপক্ষে কোনো অকাট্য প্রমাণ পেশ করা হয়নি। খ) চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে ইরান আবার আগের পথে ফিরে যেতে পারে, এটা ঠেকানোর কোনো শর্ত না থাকাটা বিপজ্জনক। গ) কোনো রাখঢাক না করে ইরান দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে। ঘ) ইরাক, সিরিয়া, লেবানন, ইয়েমেনের মতো দেশে নানাভাবে প্রভাব বিস্তার করে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বিপন্ন করছে ইরান। এসব অভিযোগের বিপরীতে ট্রাম্প প্রশাসন প্রস্তাব দিয়েছিল পরমাণু সমঝোতায় ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি এবং মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের তৎপরতার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করার। কিন্তু ইউরোপীয় মিত্ররা শেষোক্ত দুই যুক্তি মেনে নিলেও পরমাণু চুক্তির সাফল্য থেকে সরে আসতে অস্বীকৃতি জানায়। তারা বরং বাড়তি পদক্ষেপের মাধ্যমে ইরানের প্রভাব-প্রতিপত্তি খর্ব করার প্রচেষ্টা চালিয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের দুশ্চিন্তা দূর করার আশ্বাস দেয়। কিন্তু ইরানের সঙ্গে আপস হলে যুক্তরাষ্ট্রের সমস্যা সমাধান হয় না, ফলে তাদের বিকল্প ভাবতে হয়।
৭. যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ সংশ্লিষ্টরা দেখেছেন, তাদের নিজেদের ও সৌদি ও ইসরায়েলের নানা পরিকল্পনা মধ্যপ্রাচ্যে বিরাট চাপের মুখে রয়েছে। ফলে নিজের ভাবমূর্তি উদ্ধার এবং মিত্রদের স্বার্থ রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্রকে মধ্যপ্রাচ্যে নতুন কিছু করতেই হতো। রাশিয়ার মতো দানবকে টার্গেট করা সেখানে কোনো কাজের কথা নয়, বরং ইরানই সহজ টার্গেট। ডোনাল্ড ট্রাম্প এই সম্ভাবনা কাজে লাগানোর চেষ্টা করছেন। তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্পের নীতির প্রধান বিরোধীপক্ষ ডেমোক্র্যাটরাও ইরান প্রশ্নে অনমনীয়। ২০০৮ সালে বার্তা সংস্থা এবিসিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিলারি বলেছিলেন, ‘আমি ইরানিদের এটা বলতে চাই, আমি প্রেসিডেন্ট হলে ইরানে আক্রমণ চালাব। আমরা তাদের ধ্বংস করে দেয়ার সক্ষমতা রাখি।’ ফলে ইরানে যেকোনো গোলযোগ সৃষ্টির ক্ষেত্রে বিরোধীরা অন্তত বিপক্ষে যাবে না এবং যুক্তরাষ্ট্রে জনগণের যুদ্ধবিরোধী অবস্থান থাকলেও বিরোধীদের সমর্থন নিয়ে সেই সংকট মোকাবিলা করা যাবে- এমন পরিস্থতিও ট্রাম্পকে ইরান চুক্তি বাতিল করে ওই অঞ্চলে নতুন করে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির পক্ষে অবস্থান নিতে উদ্বুদ্ধ করেছে বলে ধারণা করা যায়।
পরিশেষে বলা যায়, ট্রাম্পের ইরান চুক্তি বাতিলে ইউরোপের সব চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পেছনে অর্থনীতি ও রাজনীতির এসব হিসাবই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ট্রাম্প একজন ‘খারাপ লোক’ হিসেবে এসব কিছু করছেন না। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি ও রাজনীতির সংকটই তার মতো কট্টরপন্থীকে ক্ষমতায় এনেছে এবং এসব পদক্ষেপের দিকে চালিত করছে। ট্রাম্প না হয়ে অন্য কেউ ক্ষমতায় থাকলে তারা হয়তো যোগ্যতার সঙ্গে আরো মসৃণ উপায়ে এসব কাজই করত। কিন্তু এর খুব বিপরীত পথে এগুনো তাদের পক্ষে সম্ভব হতো না। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের একচেটিয়া পুঁজির প্রতিনিধি হিসেবেই রিপাবলিকান বা ডেমোক্র্যাটরা ক্ষমতায় আসে। ওই পুঁজির নিরাপত্তা বিধান ও স্বীয় পুঁজিপতিশ্রেণীর স্বার্থ রক্ষাই তাদের মূল কর্তব্য। এই কর্তব্য পালন করতে গিয়েই যুক্তরাষ্ট্রের ইতোপূর্বেকার সরকারগুলো দেশে দেশে যুদ্ধ করেছে, মিত্র গড়েছে এবং প্রয়োজনে সেই মিত্রদের ছুড়েও ফেলেছে। ইউরোপের সঙ্গে বর্তমান দ্বন্দ্বও সেই সূত্র থেকেই উদ্ভূত। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, যুক্তরাষ্ট্র-ইউরোপের সব সম্পর্ক শেষ হয়ে গেছে। তারা আপস-মীমাংসার সব চেষ্টাই চালাবে, সেটাও অর্থনীতির প্রয়োজনেই। কিন্তু ইউরো যেভাবে তার সীমা সম্প্রসারিত করছে, ডলারের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠছে, তাতে করে দ্বন্দ্ব তীব্র হওয়াটাই এখনকার প্রধান প্রবণতা।
সারাবাংলা/এমএম