Sunday 08 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

পুলিশ- পুলিশ হত্যাকারী: উভয়ের অসহ্য সাংবাদিকতা

মোস্তফা কামাল
২৩ জুন ২০২৪ ১৩:৫৫

সাংবাদিকদের পেয়ে বসেছেন সবাই। দেশের সমান্তরালে তা প্রবাসেও। দেশে পুলিশের কাছে সাংবাদিকরা অসহ্য। আর প্রবাসে চক্ষুশূল পুলিশ হত্যার আসামীর কাছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতে প্রবাসী সাংবাদিকরা মার খেয়েছেন পুলিশ হত্যাসহ নানা অপকের্মর হোতা বহুল আলোচিত-বিতর্কিত আরাভ খান। শনিবার রাতে, বাংলা কার্নিভাল’ অনুষ্ঠানে আরাভ খান তার-২০২৫ জন সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে জোরপূর্বক ঢুকতে চাইলে বাধা দেয় নিরাপত্তাকর্মীরা। এ ঘটনার সংবাদ সংগ্রহ করতে যাওয়া সাংবাদিকদের উত্তম-মধ্যম দেয় দুবাইতে মোজমাস্তির জীবানিপাত করা আরাভ খানসহ তার সঙ্গীরা। সেখানে নিযুক্ত বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল বিএম জামাল হোসেন’সহ কমিউনিটি ব্যক্তিত্বরা তা চেয়ে চেয়ে দেখেছেন। পুলিশ হত্যা মামলার আসামী আরাভ খানের প্রবাসে সাংবাদিকদের ওপর তাফালিংয়ের সমান্তরাল সময়টাতে দেশে পুলিশও সাংবাদিকদের ওপর চরম বেরহম।

পুলিশ সার্ভিস এসোসিয়েশন চায় অধরা থাকতে। সাংবাদিকরা যেন তাদের দুর্নীতি এবং বিত্তবৈভব নিয়ে কোনো তথ্য না দেন। সাবেক আইজিপি বেনজীর, সাবেক ডিএমপি কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়া, ডিআইজি জামিল হাসানসহ কয়েক পুলিশ কর্মকর্তার আলাদীনের চেরাগ হয়ে ওঠার কাহিনী প্রকাশে তারা ক্ষুব্ধ সাংবাদিকদের ওপর। তা হজম করতে না পেরে বিবৃতিও দিয়ে বসেছে পুলিশ সার্ভিস এসোসিয়েশন। শাঁসিয়েছেও। বলেছে, যেন পুলিশের দুর্নীতি নিয়ে এমন তথ্য পরিবেশন না হয়। এ ব্যাপারে সরকারেরও সহায়তা চাওয়া হয়েছে। পুলিশ এসোসিয়েশনের এমন বিবৃতি ও মতিগতিতে গোস্যা করেছে সাংবাদিকদের এসোসিয়েশনও। জানিয়েছে গভীর উদ্বেগ। বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন-বিএফইউজে এবং ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন-ডিইউজের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে দেশের কিছু ক্ষমতাধর বর্তমান ও সাবেক সরকারি কর্মকর্তার বিপুল ও অস্বাভাবিক সম্পদের বিবরণী সংবাদ করা হয়নি। দায়িত্বশীল সাংবাদিকরা প্রাপ্ত তথ্য, দলিল যাচাই বাছাই করে, প্রমাণযোগ্য বিষয়গুলোই প্রকাশ করছেন। এ নিয়ে কারো কারো প্রতিক্রিয়ার ভাষা স্বাধীন সাংবাদিকতার প্রতি হুমকি।

বিবৃতিতে আরো বলা হয়, সাংবাদিকদের বড় কাজই হচ্ছে, প্রভাবশালীরা যে তথ্য গোপন রাখতে চান তা অনুসন্ধান করে বের করা এবং পেশাদারিত্বের সাথে জনগণকে বিস্তারিত জানানো। এ ক্ষেত্রে সরকার ও সংশ্লিষ্ট মহলের দায়িত্ব প্রকাশিত তথ্য নিয়ে তদন্ত করা, দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করা। এসকল বিষয় নিয়ে পারস্পরিক দোষারোপ শোভন কাজ নয় মন্তব্য করে এরপরও কেউ সংক্ষুব্ধ হলে প্রেস কাউন্সিলে যাওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে সাংবাদিক এসোসিয়েশনের বিবৃতিতে। পুলিশ এসোসিয়েশনের বিবৃতিতে পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্ত চাওয়া হলো না। বিচারও চাইলেন না বেনজীর-আসাদ সম্প্রদায়ের কর্মকর্তারা। উল্টো গণমাধ্যমকে ধমক দিলেন। এরইমাঝে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয় থেকেও একটা সাবধানতা দেয়া হয়েছে সাংবাদিকদের উদ্দেশ্য। বলা হয়েছে, পুলিশ বাহিনীর মর্যাদা নষ্ট হয়, এমন সংবাদ প্রকাশে সতর্ক হতে। লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে, গত ক’দিন প্রকাশিত সংবাদগুলোর কোনোটিই পুলিশ বাহিনী নিয়ে নয়। এগুলোতে কেবল পুলিশ কর্মকর্তাদের কাণ্ডকীর্তি। কিন্তু, পুলিশ এসোসিয়েশন ক্ষেপে গিয়ে প্রকারান্তরে দুর্নীতিবাজ পুলিশ কর্মকর্তাদের পক্ষ নিয়েছে। পুলিশ বাহিনী ও নিজেদেরও ঠাকুর ঘরে কে? কলা খাইনার-দশায় নিয়ে গেছে। কোন কর্মকর্তা দুর্নীতি করলে এটি তার বিষয়, কোন বাহিনীর বিষয় নয় মোটেই। কিন্তু, দুর্নীতিবাজ ও তাদের সাঙ্গাতরা চাতুর্যপূর্ণভাবে গোটা বাহিনীকে সামনে নিয়ে আসছেন। তারওপর সংবাদের ব্যাকরণ শেখানোর কাজে পা বাড়িয়েছেন। এভাবে এগোলে কবে-কখন কারওয়ানবাজার, ঠাটারি বাজারের আলু-পেঁয়াজের দাম ঠিক করা ব্যবসায়ীরাও সংবাদ ও সাংবাদিকের সীমা নির্ধারণ করে দেয়ার অভিযানে নেমে বসেন! অথবা দুর্নীতির কোনো সংবাদই দেয়া যাবে না- এমন আইন করার চিন্তা্ জাগার মগজও এদেশে আছে। যাদের মগজটাই এক একটা আলাদীনের চেরাগ। আর চেয়ারটা টাকার মেশিন।

এই শ্রণিটার জন্য দেশের –সমাজের অন্যতম নিরীহ জীব সাংবাদিকদের হয়রান-হুমকি, দরকার মনে করলে গায়ে হাত তোলাও কোনো বিষয় নয়। কবি সুকুমার রায়ের ছড়ার মতো, করে না কো ফোঁস-ফাঁস, মারে নাকো ঢুসঢাস’ অবস্থা এই বেচারাদের। তারওপর মরারে মারস ক্যান? –নড়েচড়ে তো, দশায় সাংবাদিকদের নিয়ে যাওয়ার একটি মানসিকতা অনেকেরই। তারা দুর্নীতিবাজ-লুটেরাদের কমন শত্রু। পুলিশ শত্রু ভাবে। যা ভাবে পুলিশ হত্যাকারীও। আরাভ খান আর পুলিশ এসোসিয়েশনের ভূমিকা এর টাটকা উদাহরণ মাত্র। আর সাংবাদিকরা কেবলই শিকার। দুর্নীতির বিরুদ্ধে বর্তমান লড়াইটা বলতে গেলে মিডিয়ার একার। দুর্বিনীত সময়ে এ লড়াইয়ে তার সঙ্গে লড়াইয়ের ময়দানে সশস্ত্র বা নিরস্ত্র কেউ নেই। জনগণ গ্যালারিতে, হাতে তালি এবং টমেটো নিয়ে। প্রতিপক্ষে প্রকাশ্যে অস্ত্রসজ্জিত বিপুল পদাতিক, আড়ালে কমব্যাট ড্রেসে স্ট্রাইকিং ফোর্স। আছে মিলিশিয়া, রিজার্ভ ফোর্স, অনতিদূরে পরাশক্তি। ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে তারা।

ন্যায়-অন্যায়ের যুদ্ধ বড়ো কঠিন। পুলিশ মানেই বেনজীর বা আসাদুজ্জামান মিয়া নন। কিন্তু, নানান আজেবাজে কাজে তারা পুলিশের প্রতীক হয়ে গেছে। গোটা বাহিনীটিকে অধঃপতনের শেষ পিলার থেকে ঘুড়ে দাঁড়াতেই হবে। এ কাজে বাহনীর বাদবাকি তথা সত্যিকারের সৎ-দক্ষদের করার অনেক কিছু আছে। তারা বে-নজির বা মিয়া নন, তা প্রমাণের অনেক সুযোগ তাদের অবশ্যই আছে। পুলিশের পেশাগত স্বার্থেই তাদের ভেতর থেকে ইমেজ উদ্ধারের তাগিদ না থাকলে সেটা হবে গোটা বাহিনীর জন্যই দুর্ভাগ্যের। কার কোন খাত থেকে কোন যাদুতে কিভাবে অবৈধ কতো উপার্জন আসে, কে কোথায় আলাদীনের চেরাগ ঘঁষে দেশ-বিদেশে বিত্ত গড়েন; সেসব ধরা তাদের জন্য মোটেই কঠিন কাজ নয়। নোংরা ঢেকে নয়, নোংরা সাফ করেই কর্মের ও পেশার মর্যাদা রক্ষা করতে হয়। দেশটিতে দুর্নীতি কেবল পুলিশই করে-এমন ভাবলে ভুল হবে। গোটা আবহটাই দুর্নীতির অনুকূলে। ঘুষ-নজরানায় যারা যারা কাজ করান তিনিও দুর্নীতিবাজ। নানান সুবিধা হাতান তিনিও। উভয়ই চোর। আর জগতের কোনো চোরই কখনো চুরির কথা স্বীকার করে না। সঙ্গী-সাথীর নামও বলে না। আবার ধরা পড়ে গেলে অবস্থা বেগতিক দেখলে কেউ কাউকে চেনেন না। বা একে অন্যের ঘাড়ে দায় চাপান, যা অনেকটা জাগতিক নিয়ম। ধর্মীয় নানা বর্ণণায় বলা আছে, পরকাল বা হাশরের ময়দানের চিত্রও এমন হবে।

গত ক’দিন গণমাধ্যমে নাম আসতে থাকা দুর্নীতিবাজ বেনজীর, আসাদ, মতিউরসহ বিভিন্ন মিয়ারা উচ্চশিক্ষিত । নামের সঙ্গে ডক্টরেটও আছে কারো কারো। দুর্নীতি প্রশ্নে এই হাইলি এডুকেটেডরা যাদুঘরে রাখার মতো আইটেম হলেও মোটেই আনবিক প্রাণী নন। উড়ালি প্রাণী। সংখ্যায় অনেক। দেশে থাকাকালীন এদের প্রভাব, বলয়ের ফলে এরা ধরা-ছোয়ার উর্ধ্বে থাকে। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তসহ সংবাদ প্রকাশিত হতে থাকলে এরা সপরিবারে উড়াল দেয়। এটাই স্বাভাবিক চিত্র হিসেবে মানুষ দেখতে পায়। যা সাধারণ মানুষকে কেবল বিনোদন নয়, ভাবায়ও। প্রশ্ন জাগায়- দুর্নীতিবাজ হতে কি উচ্চশিক্ষিত হওয়া লাগে? বা উচ্চশিক্ষিত হলেই কেউ দুর্নীতিবাজ হয়ে যায়? তাদের কাণ্ডকীর্তি ও সম্পদের বিবরণও পড়ে শেষ করা যায় না। নজির ভাই থেকে মিয়া ভাই কারও কাহিনীই ছোট গল্প নয়, বড় উপন্যাস। সাধারণত যেকোনো দেশে শিক্ষার হার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অপরাধের প্রবণতা কমে আসে। কিন্তু বাংলাদেশে শিক্ষার হার বাড়লেও বেশিরভাগ অপরাধ শিক্ষিতরাই করে চলছেন কেন?

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন

সারাবাংলা/এসবিডিই

পুলিশ- পুলিশ হত্যাকারী: উভয়েরই অসহ্য সাংবাদিক মত-দ্বিমত মোস্তফা কামাল


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর