Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

নির্জন কাঁটাতারে ঝুলে থাকা স্বপ্নের গল্প

আবু মকসুদ
১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৫:১৯

সদ্য ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেন একবার মন্তব্য করেছিলেন যে, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মতো। এমন মন্তব্যের জন্য সমালোচনার ঝড় উঠেছিল, কারণ এটি একটি অপ্রয়োজনীয় এবং ভুল উদাহরণ ছিল। দুই দেশের মধ্যে একটি পরিণত এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক থাকার কথা, যেখানে পারস্পরিক সম্মান ও সহযোগিতার উপর ভিত্তি করে নীতি নির্ধারণ হয়। কিন্তু মোমেনের মন্তব্য ছিল এ ধরনের সম্পর্কের সত্যিকারের চিত্রের সঙ্গে অপ্রাসঙ্গিক এবং স্থুল উদাহরণ। এরকম মন্তব্যে মনে হয়েছিল বাংলাদেশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিতান্তই মূর্খ। তার এ ধরনের মন্তব্যে বোঝা যায় যে, তিনি কূটনৈতিক সম্পর্ক এবং এর গুরুত্ব সম্পর্কে সঠিকভাবে অবগত নন। আওয়ামী লীগ সমর্থকেরা যখন এ ধরনের মন্তব্যের সমালোচনা এড়াতে ব্যক্তিগত আক্রমণের দিকে যেতে চান, তখন তারা আসলে সমস্যা থেকে দৃষ্টি সরাতে চান। প্রশ্ন হলো, এ ধরনের অযৌক্তিক উদাহরণ ব্যবহার করা একজন রাজনৈতিক নেতার পরিপক্কতার অভাবের প্রকাশ কিনা, এবং তা থেকে সাধারণ মানুষ কি বার্তা পায়। একজন দায়িত্বশীল নেতার বক্তব্য অবশ্যই তার অবস্থানের গুরুত্বের সঙ্গে মানানসই হতে হবে, যা এই ক্ষেত্রে হয়নি।

বিজ্ঞাপন

ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক স্বামী-স্ত্রীর নয়, বরং অধিকাংশের মতে মুনিব-ভৃত্যের সম্পর্ক। এ সম্পর্কের প্রকৃত চিত্র বোঝার জন্য সাধারণ কোনো উদাহরণের প্রয়োজন নেই, সীমান্ত হত্যাকান্ডের বাস্তবতাই যথেষ্ট। ২০০৯ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত বিএসএফের হাতে ৫২২ জন বাংলাদেশি নিহত হয়েছে, যা একটি অসামঞ্জস্যপূর্ণ ও শোষণমূলক সম্পর্কের ইঙ্গিত দেয়। শুধু ২০২৩ সালে বিএসএফের গুলিতে ৩১ জন বাংলাদেশি প্রাণ হারিয়েছেন। এসব হত্যাকান্ডে কোনো ভারতীয় নাগরিকের প্রাণহানি ঘটেনি, যা দুই দেশের সম্পর্কের ভারসাম্যহীনতাকে উজ্জ্বল করে। এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্ন জাগে, কী ধরনের সম্পর্ক হলে এক দেশের নিরাপত্তা বাহিনী আরেক দেশের নিরীহ নাগরিকদের এভাবে হত্যা করতে পারে এবং তা চলতে থাকে।

বিজ্ঞাপন

যদি দুই দেশের সম্পর্ককে সাংসারিক বলে ধরে নেওয়া হয়, তাহলে কেউ কি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবে যে সংসারে একপক্ষ একতরফা হত্যা চালিয়ে যাচ্ছে? সাধারণ সাংসারিক জীবনে ঝগড়া, মনোমালিন্য হয়, কিন্তু সেখানে কোনো পক্ষ একতরফা হত্যাকান্ড চালায় না। আমার ব্যক্তিগত ২৮ বছরের বৈবাহিক জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, সেখানে তর্ক-বিতর্ক, পরাজয়-জয় থাকলেও কোনো পক্ষ কখনো নিরঙ্কুশভাবে অপর পক্ষকে শাসন করে না। কিন্তু বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে এমনটি ঘটছে, যেখানে ভারত তার প্রভাবশালী অবস্থানকে অপব্যবহার করছে এবং বাংলাদেশের নাগরিকদের জীবন ঝুঁকির মুখে ফেলে দিচ্ছে।

২০১১ সালে কুড়িগ্রাম সীমান্তে কিশোরী ফেলানি খাতুনের নির্মম হত্যাকাণ্ড আমাদের সবাইকে একটি বড় প্রশ্নের সম্মুখীন করে: আমাদের সরকার কি আদৌ এই হত্যার সুবিচার নিশ্চিত করতে পেরেছে? ফেলানি কাঁটাতারে ঝুলে থাকা অবস্থায় তার লাশের ছবি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছিল, কিন্তু সেই হৃদয়বিদারক ঘটনার জন্য বিএসএফের কোন সদস্যের শাস্তি হয়নি। প্রথমে যে ব্যক্তি তাকে গুলি করেছিল, তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হলেও পরে ভারতের আদালতে তাকে নির্দোষ ঘোষণা করা হয়। এরপর ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টে মামলা চললেও আজও কোনো চূড়ান্ত রায় হয়নি। এটি ভারতীয় গণতন্ত্রের এক ধরনের ব্যর্থতার ইঙ্গিত দেয়, যেখানে একটি নির্দোষ কিশোরীর মৃত্যু দীর্ঘ ১৩ বছর পরেও ন্যায়বিচার পায়নি। ফেলানি হত্যা নিয়ে বাংলাদেশের লেখকরা অনেক লিখেছেন। কেউ কেউ বইও প্রকাশ করেছেন।

স্বর্ণা দাসের ঘটনাটি আরও একবার প্রমাণ করে যে, বিএসএফ বাংলাদেশের সাধারণ মানুষকে যেকোনো অজুহাতে হত্যা করতে পিছুপা হয় না। ২০২৪ সালে কুলাউড়ার লালার চক সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে স্বর্ণা দাসের মৃত্যু হয়, যাকে তারা অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে অভিহিত করেছিল। অবৈধ শব্দটি বিএসএফের জন্য এক ধরনের হত্যার বৈধতা হিসেবে কাজ করছে। যেকোনো সীমান্তে অনুপ্রবেশের অভিযোগে বাংলাদেশিদের হত্যা করা কোনোভাবেই যুক্তিযুক্ত নয়। এটি একটি মানবাধিকার লঙ্ঘন, যেখানে একটি দেশ তার প্রতিবেশী দেশের নাগরিকদের নির্বিচারে হত্যা করতে সক্ষম হচ্ছে, এবং বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে কার্যকর প্রতিরোধের কোনো লক্ষণ দেখা যায় না।

তাহলে এখন প্রশ্ন ওঠে, যদি সত্যিই ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে কোনো সাংসারিক সম্পর্ক থাকত, তাহলে কি এ ধরনের একতরফা হত্যাকান্ড ঘটত? একটি সম্মানজনক সম্পর্কের প্রধান শর্ত হলো পারস্পরিক শ্রদ্ধা। কিন্তু এখানে ভারতের পক্ষে কোনো ধরনের শ্রদ্ধা প্রদর্শন লক্ষ্য করা যায় না। তাই বাংলাদেশের উচিত এই কথিত সাংসারিক সম্পর্কের অবসান ঘটিয়ে ভারতের কাছ থেকে “তালাক” দাবি করা। আমরা আর ভারতকে এই সম্পর্কের মুনিব হতে দিতে পারি না, যেখানে আমাদের নাগরিকরা প্রাণ হারায় এবং আমরা প্রতিক্রিয়া দেখাতে ব্যর্থ হই। আমাদের মর্যাদা পুনরুদ্ধার করতে হলে এই অবমাননাকর সম্পর্কের অবসান ঘটাতে হবে এবং একটি সম্মানজনক স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের অবস্থান শক্ত করতে হবে।

শেষ পর্যন্ত, বিএসএফ যদি একজন বাংলাদেশিকে হত্যা করে, তবে আমাদের উচিত এর প্রতিক্রিয়ায় উপযুক্ত জবাব দেওয়া, হয় তা প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হোক বা কূটনৈতিক চাপের মাধ্যমে। বর্তমান সরকারকে অবশ্যই প্রমাণ করতে হবে যে তারা আগের সরকারের তুলনায় আরও সাহসী এবং দেশের নিরাপত্তা ও সম্মান রক্ষায় অঙ্গীকারবদ্ধ। আমরা দেখতে চাই, বর্তমান সরকার শুধুমাত্র রাজনৈতিক স্লোগান বা বক্তৃতার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে, বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করবে যা ভারতের চোখ রাঙানির মুখে শক্ত প্রতিক্রিয়া দেখাতে সক্ষম। এটি শুধু সামরিক বা প্রতিরক্ষামূলক পদক্ষেপ নয়, বরং কূটনৈতিকভাবে ভারতের সঙ্গে শক্তিশালী অবস্থান গ্রহণ করা দরকার। আন্তর্জাতিক মঞ্চে, বিশেষ করে জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলির সামনে সীমান্ত হত্যাকাণ্ডের ইস্যুতে জোরালোভাবে কথা বলা উচিত।

বাংলাদেশের উচিত ভারতের সঙ্গে সম্পর্ককে শুধু কূটনৈতিক বন্ধুত্বের মোড়কে না রেখে, যেখানে দরকার শক্ত অবস্থান গ্রহণ করা। কূটনৈতিক সমঝোতা এক জিনিস, কিন্তু যখন একজন রাষ্ট্রের নাগরিকদের জীবন ঝুঁকিতে পড়ে এবং ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়, তখন সেই সম্পর্ককে পুনর্বিবেচনা করা অত্যন্ত জরুরি। আমরা দেখতে চাই, বর্তমান সরকার নিজেদের আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং ভারতীয় দম্ভের সামনে নিজেদের দৃঢ়ভাবে দাঁড় করাতে সক্ষম হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বকে রক্ষা করার জন্য সাহসী নেতৃত্বের প্রয়োজন, এবং এই সরকারকে সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে হবে।

লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী, ছোটকাগজ ‘শব্দপাঠ’ সম্পাদক

আবু মকসুদ নির্জন কাঁটাতারে ঝুলে থাকা স্বপ্নের গল্প মত-দ্বিমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর