Sunday 24 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বিচারকও ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে নিভৃতে কাঁদে

মাহমুদা খাতুন
২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৮:৫৫

যখন বিচারক ও বিচার বিভাগের সঠিক মূল্যায়ন হচ্ছে না, ন্যায়বিচার প্রদান করার ক্ষেত্রে বিচারকগণ বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছেন-ঠিক তেমনি এক ক্রান্তিলগ্নে মাননীয় প্রধান বিচারপতি আপনি বিচারবিভাগের হাল ধরেছেন। তাই আমরা আশাবাদী। প্রধান বিচারপতির বলিষ্ঠ নেতৃতে বিচার বিভাগ এগিয়ে যাবে। বিচারকদের তাদের সঠিক মূল্যায়ন পাবে, সম্মান পাবে বিচারপ্রার্থী জনগন ন্যায় বিচার পাবে। সর্বোপরি বিচার বিভাগের সম্মান পুনরুদ্ধার হবে। এক বৈষম্যবিরোধী বিচার বিভাগ গড়ে উঠবে।

বিজ্ঞাপন

আমরা আজীবন পড়েছি এবং জেনেছি বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে কিন্তু কেউ হয়তো জানে না যে শুধু বিচারের বানী নয় বরং ‘বিচারক’ও অনেক সময় ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে নিভৃতে কাঁদে। কারণ বিচারকের বলার জায়গা এবং সুযোগ কোনটাই থাকে না। ধারণা করা হয়, বিচারকের মুখ বন্ধ থাকবে, কান দিয়ে শুনবে এবং হাত দিয়ে লিখবে। আমাদের অভিভাবক প্রধান বিচারপতিকে জানাতে চাই বিচারকরাও অবিচারের শিকার হয়।

হয়তো মনে হবে আজ আমরা শুধু দাবির ঝুলি নিয়ে এসেছি কিন্তু অভিভাবকের কাছে ছাড়া আমাদের তো বলার কোন জায়গা নাই। এমন অবস্থা আমাদের যে, সুনির্দিষ্ট বদলির নীতিমালার অভাবে আমাদের অনেক বিচারক দিনের পর দিন বাড়ি থেকে শত কিলোমিটার দূরে কখনো বা দূর্গম জায়গায় মনের কষ্ট নিয়ে বিচারের মতো স্বর্গীয় কাজ করে চলেছেন। এজন্যই হয়তো কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন-অলৌকিক আনন্দের ভার, বিধাতা যাহারে দেন, তার বক্ষে বেদনা অপার। বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতির নিকট একটি সুনির্দিষ্ট মানদন্ডের ওপর ভিত্তি করে বিচারকদের বদলির ব্যবস্থা গ্রহণের বিনীত নিবেদন জানাচ্ছি।

অনেক বিচারক এমন জায়গায় এজলাস চেম্বার করেন যে, ভয় হয় যে কোন মুহূর্তে ভেঙে পড়ে কোন সংবাদ শিরোনামের কারণ না হয়। এজলাস দিয়ে পানি পড়ে, টিনসেডের এজলাসে গ্রীষ্মের ভয়াবহ তাপদাহের সময় অসুস্থ হয়ে পড়তে হয়। আবার কোথাও কোথাও দুই তিন জন মিলে ছোট্ট একটা চেম্বারে বসে এবং একজন এজলাস শেষ করলে আরেকজন এজলাসে উঠে। কখনো এমন হয় যে বিচারকের চেম্বার এক জায়গায় এবং এজলাস অপর এক জায়গায়। বিচারকদের এজলাস ও চেম্বারের অবকাঠামোগত উন্নয়ন এখন সময়ের দাবি। একইসাথে প্রয়োজন মহানগর দায়রা জজ, সিএমএম ও সিজিএম এর সরকারি বাসভবনে। মহানগর দায়রা জজ, সিএমএম এবং সিজিএম এর নিজস্ব বাংলো না থাকায় যেখানে কোয়ার্টার নেই সেখানে তারা ব্যক্তি মালিকানাধীন ভবনে থাকতে বাধ্য হয়। যা তাদের জন্য বিব্রতকর এবং অনেক সময় নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ।

বিজ্ঞাপন

বিচারকদের অংশগ্রহণে আজকের এই আয়োজন, এই মিলনমেলা আমাদের জন্য অক্সিজেন স্বরূপ। এমন আয়োজনে আপনার সুচিন্তিত দিক নির্দেশনার পাশাপাশি আমাদের নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার সুবর্ণ সুযোগ সৃষ্টি করে। কিন্তু আমরা যারা মফস্বলে থাকি, এদের জন্য ঢাকায় কোন প্রোগ্রাম হলে যেকথা প্রথমেই ভাবতে হয়- কোথায় থাকবো? এ এই চিন্তা হয় যখন নতুন কেউ বদলি হয় বা সাক্ষী দিতে ভিন্ন কোন জেলায় যেতে হয়। এর একমাত্র সমাধান আমাদের আলাদা রেস্ট হাউজ নির্মাণ। সেই সাথে প্রয়োজন পর্যাপ্ত বাজেট এবং বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা। যার জন্য সুপ্রিম কোর্টের অধীনে আলাদা সচিবালয় খুবই প্রয়োজন। তা না হলে সরকারি হস্তক্ষেপ মুক্ত স্বাধীন বিচার বিভাগ কখনোই সম্ভব না।

আদালতগুলোতে প্রয়োজনের তুলনায় জনবল অত্যন্ত কম। নতুন করে অনেক আদালত এবং ট্রাইব্যুনালের সৃজন হলেও অনেকক্ষেত্রে কোন সহায়ক কর্মচারীর পদ সৃজন হয়নি। যার ফলে বিদ্যমান অপ্রতুল জনবলের অর্গানোগ্রাম থেকে সেই সকল আদালত ও ট্রাইব্যুনালে ডেপুটেশনে কর্মচারীদের নিযুক্ত করতে হয়, এতে দেশের সকল আদালতে সব সময় কর্মচারীদের ঘাটতি থাকে। এ ছাড়া প্রতি বছর উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সহায়ক কর্মচারী অবসরে চলে যাচ্ছেন, তাদের শূন্য পদে নিয়োগ প্রদান করা প্রতিষ্ঠান প্রধান বা নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের জন্য পুলসিরাত পার হওয়ার মতো। বিগত বছরগুলোতে এই শূন্য পদে নিয়োগ দিতে যেয়ে প্রতিষ্ঠান প্রধান বিচারকগণ বিপুল চাপের সম্মুখীন হয়েছেন, কেউ সুপারিশ অনুসারে কাঙ্খিতভাবে কাজ করতে না পারা। বিভিন্ন অপবাদে অপদস্ত হয়ে বদলি হয়ে অপেক্ষকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ পদ পদায়িত হয়েছেন।

অধঃস্তন আদালতে সহায়ক কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের স্বাধীনতা চাই। আমরা জানি আমাদের বাংলাদেশ নতুন করে স্বাধীনতা লাভ করেছে তার পেছনে মূল কারণ ছিলো, মেধার লড়াই। আমরা বিচার বিভাগেও মেধার জয় দেখতে চাই, কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধাভিত্তিক নিয়োগের স্বাধীনতা চাই।

ফৌজদারী বিচারে বিলম্বের এবং সাজার হার কম হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হলো- ত্রুটিপূর্ণ তদন্ত প্রক্রিয়া। অন্য আরেকটা কারণ হলো দুর্বল প্রসিকিউশন। ফৌজদারী বিচার প্রক্রিয়া ত্বরিত করার জন্য এবং ন্যায় বিচার নিশ্চিতে বিচার বিভাগের অধীনে ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি এবং প্রসিকিউশন বিভাগ থাকা অতি জরুরি। তা না হলে অন্যের দ্বায়ভার বিচার বিভাগকে গ্রহণ করে কলঙ্কিত হতে হয়।

তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে এখনো অনেক বিচারককে হাতে রায় এবং আদেশ লিখতে হয়। কারণ পর্যাপ্ত কম্পিউটার, প্রিন্টারের অপর্যাপ্ততা এবং এই খাতে পর্যাপ্ত বাজেট না থাকা। যে বাজেট পাওয়া যায় তাতে কম্পিউটার কিনতে কম্পিউটারের কালি কেনার টাকা কিংবা মেরামতের টাকা থাকে না। আদালতগুলো পর্যাপ্ত লজিস্টিক সাপোর্ট নাই। শুধু কম্পিউটার ক্রয়ের ক্ষেত্রেই নয়, আদালতে বিচার বিভাগের বাজেট অত্যন্ত সীমিত। বিচার বিভাগের বাজেট বৃদ্ধির জোর দাবি জানাই।

আগেই বলেছি বিচারকরা অত্যন্ত অবিচারের শিকার হয় তার অন্যতম উদাহরণ হলো অনেক সময় সেনসিটিভ মামলার বিচার কার্য কর বিচারককে পায়ে হেঁটে কিংবা রিক্সায় করে ঘরে ফিরতে হয়। বাংলাদেশের অনেক সার্ভিসে গাড়ি সুবিধা পেলেও বিচারকের জন্য সেই দ্বার অবরুদ্ধ। বিচারকের সম্মান রক্ষার্থে, গণপরিবহনে ক্ষেত্রবিশেষে বাধ্য হয়ে মোকদ্দমার পক্ষদের সাথে যাতায়াত করার মতো বিব্রতকর অবস্থা থেকে পরিত্রাণ এবং নিরাপত্তা রক্ষার্থে বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের জন্য গাড়ি নগদায়ন সুবিধার দাবি করছি।

বিভিন্ন সময়ে আদালত চত্ত্বরে অস্থিরতা, বিচারকদের ওপর চাপ প্রয়োগ এবং শান্তি-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিপর্যয়ের অপচেষ্টা পরিলক্ষিত হয়। দেশের উন্নয়নে ও অগ্রগতির স্বার্থে এজলাসে বিচারকের স্বাধীনভাবে কাজ করার নিশ্চয়তা চাই। একইসাথে আদালত চত্ত্বরে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিতের জন্য অনুরোধ করছি। বিচারকদের যে কোন সমস্যায় যোগাযোগ রক্ষার্থে সুপ্রিম কোর্টে আলাদা ডেস্ক করার অনুরোধ জানাচ্ছি। বিচার বিভাগের বিরুদ্ধে মিডিয়া ট্রায়াল রুখতে আলাদা মিডিয়া উইং করার জোর দাবি জানাচ্ছি।

বিচার বিভাগে নারী বিচারকদের পদচারণা দিন দিন বাড়ছে যা দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের প্রতিচ্ছবি। কিন্তু নারী বিচারকরা একটি বিষয় নিয়ে মানসিক অশান্তিতে থাকেন। তা হলো দুগ্ধ পাষ্য শিশুকে কোথায় রাখবেন। এক প্রকার বাধ্য হয়ে শিশুকে বাসায় রাখতে হয়, হেল্পিং হ্যান্ডের হাতে ছেড়ে দিতে হয়। দীর্ঘ ৮/৯ ঘন্টা শিশু মায়ের সাহচার্য বঞ্চিত থাকে। মানসিক অস্বস্তি এবং অশান্তিতে থাকেন বিচারক মা। এই সমস্যার সমাধানে বাংলারেশের প্রতিটি আদালতে শিশুদের জন্য ডে কেয়ারের ব্যবস্থা এবং উক্ত ডে কেয়ারে। জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা সম্পন্ন স্টাফ নিয়োগের দাবি জানাচ্ছি।

বিচার বিভাগের একজন সদস্য হিসেবে দীপ্তকণ্ঠে জানাই আমরা জনগনের সেবায়, ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় সর্বদা সচেষ্ট এবং দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠায় আমাদের এই ছোট ছোট দাবিসমূহ পূরণ করা হলে আমরা শতভাগ প্রচেষ্টা দ্বারা বিচার বিভাগের মর্যাদা সমুন্নত রাখবো। ইনশাল্লাহ।

শেষ করবো পোপ ৬ষ্ঠ পলের একটি উক্তি দিয়ে-“If you want peace, you must work for justice”.

[বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতির অভিভাষণ প্রদান অনুষ্ঠানে খুলনার জেলা ও দায়রা জজের বক্তব্য।]

লেখক: জেলা ও দায়রা জজ খুলনা

সারাবাংলা/এজেডএস

বিচারকও অনেক সময় ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে নিভৃতে কাঁদে মাহমুদা খাতুন