Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

তিস্তা নদীর ওপর গজলডোবা বাঁধ: আমাদের মরণফাঁদ

মীর্জা মো. নাসির উদ্দিন
৭ অক্টোবর ২০২৪ ১৩:৩৫

বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক দেশ। নদীর গর্ভেই জন্ম বলে এ দেশের মানুষ গাছ পালা, পশুপাখি, লতাপাতা, বাস্তুতন্ত্র সবকিছুর সাথে নদী ও পানির যোগাযোগ অত্যন্ত সুগভীর। নদীর উৎপত্তিগত দিক বিবেচনায় ভৌগোলিকভাবে আমাদের পরিচিতি ভাটির দেশ হিসেবে। আমাদের উজানে রয়েছে ভারত, নেপাল, ভুটান ইত্যাদি দেশ। আমাদের ভাটিতে কোন দেশ নেই, আছে বঙ্গোপসাগর। নদীগুলো থেকে পর্যাপ্ত পানি না পেলে ভাটি থেকে বঙ্গোপসাগরের লোনা পানি দেশের মূল ভূখন্ডের প্রবেশ করে জীব বৈচিত্র ও পরিবেশ তন্ত্রের ব্যাপক ক্ষতি সাধনের আশংকা থেকে মুক্ত হতে পারেনি এ দেশের মানুষ। উজান থেকে আসা কম-বেশি সকল নদীতে সেচ প্রকল্প, জল বিদ্যুৎ প্রকল্পের অজুহাতে ভারত বাঁধ নির্মাণ করেছে। উত্তর বঙ্গের প্রাণ প্রবাহ তিস্তার বুকে ভারত নির্মাণ করেছে বাঁধ।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশের ৪র্থ বৃহত্তম নদী তিস্তা। সিকিম হিমালয়ের ৭২০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত চিতামু হ্রদ থেকে তিস্তা নদী সৃষ্টি হয়েছে। প্রায় ২৫০ বছর বয়সী তিস্তা দার্জিলিংয়ের শিভক গোলা গিরিসংকটের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে প্রথমে প্রবাহটি দার্জিলিং সমভূমিতে নেমে আসে এবং পরে পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ির সমভূমিতে প্রবেশ করে। তিস্তা নীলফামারী জেলার কালীগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এ নদীকে সিকিম ও উত্তরবঙ্গের জীবনরেখাও বলা হয়।তিস্তা নদী হিমালয় পর্বতের হিমবাহ (গ্লেসিয়ার) থেকে উৎপত্তি হলেও তিস্তার পানির মূল উৎস বৃষ্টিপাত। পানির সামান্য অংশ আসে সিকিমের বিভিন্ন হিমবাহ থেকে। অধিকাংশ বৃষ্টিপাত হয় বর্ষা মৌসুমে জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে। নদীর গড় গভীরতা ২৮২ ফুট এবং সর্বোচ্চ গভীরতা ৫৫০ ফুট (বাংলাপিডিয়া ২০১৫). তিস্তার দৈর্ঘ্য ৩১৫ কিলোমিটার, যার মধ্যে ১১৫ কিলোমিটার পড়েছে বাংলাদেশ অংশে। বাংলাদেশ ও ভারতের ৩ কোটি মানুষের জীবন ও জীবিকা তিস্তা নদীর সাথে সম্পৃক্ত। তন্মধ্যে বাংলাদেশের ২ কোটি, ভারতের পশ্চিম বঙ্গের ৫০ লাখ এবং সিকিম অববাহিকার ৫০ লাখ লোকের জীবন ও জীবিকা অন্তর্ভূক্ত।তিস্তার প্লাবনভূমি ২ হাজার ৭৫০ বর্গকিলোমিটার জুড়ে বিস্তীর্ণ। লাখো মানুষ কৃষি, খাদ্য উৎপাদন, মাছ ধরা এবং গৃহস্থালি দৈনন্দিন পানির চাহিদা ও জীবিকা নির্বাহের জন্য তিস্তা নদীর ওপর নির্ভরশীল।

বিজ্ঞাপন

লালমনিরহাট জেলার হাতীবান্ধা উপজেলার দোয়ানী নামক স্থানে তিস্তা নদীর ওপর তিস্তা ব্যারেজ নির্মিত হয়। স্থানটি নীলফামারি জেলার ডিমলা উপজেলা থেকে ১ কিলোমিটার দুরে অবস্থিত । অত্র অঞ্চলের ফসল উৎপাদন বাড়ানো লক্ষ্যে বৃটিশ আমল থেকেই এরুপ একটি সেচ প্রকল্প প্রতিষ্ঠার কথা ভাবা হয়।১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দে এই ব্যারেজ নির্মাণ কার্যক্রম শুরু হয়।১৯৯০-এ মূল বাঁধ নির্মাণ কার্যক্রম শেষ হয়, অন্যান্য কাজ বাকী থাকে। ব্যারেজের দৈর্ঘ্য ৬১৫ মিটার , গেট ৪৪টি। ক্যানেল হেড ১১০ মিটার দীর্ঘ, গেট ৮টি । সর্বমোট গেট ৫২টি। ১৯৯৮ সালে প্রকল্পের ১ম পর্যায়ের কাজ শেষ হয়।এই বাধেঁর উদ্দেশ্য ছিল ৬ লাখ কিউসেক পরিমাণ পানি শুষ্ক মৌসুমে সেচের জন্য বিভিন্নখাতে প্রবাহিত করা।

১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দে তিস্তা নদীর বাংলাদেশ সীমান্তের ৬০ কিলোমিটার উজানে ভারত সরকার গজলডোবা বাঁধ নির্মাণ করে। এই বাঁধের (ব্যারাজ) মাধ্যমে তিস্তা নদীর নিয়ন্ত্রণ ভারতের হাতে চলে যায়। এই বাঁধে ফটক রয়েছে ৫৪টি যা বন্ধ করে তিস্তার মূল প্রবাহ থেকে পানি বিভিন্ন খাতে পুনর্বাহিত করা হয়। প্রধানত তিস্তার পানি তিস্তা-মহানন্দা খালে পুনার্বাহিত করার উদ্দেশ্য নিয়েই এই বাঁধ স্থাপন করা হয়। ২ হাজার ৯১৮ কিলোমিটার দীর্ঘ তিস্তা-মহানন্দা খালের মাধ্যমে জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং, উত্তর দিনাজপুর, দক্ষিণ দিনাজপুর, কোচবিহার ও মালদহ জেলায় সেচের পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। কার্যত তিস্তার নদীর পানি গজলডোবা বাঁধের মাধ্যমে বিহারের মেচী নদীর দিকে প্রবাহিত করা হচ্ছে। গজলডোবা ব্যারাজ নির্মাণের আগে বাংলাদেশের ডালিয়া সীমান্তে তিস্তার গড় বার্ষিক পানির প্রবাহ ছিল ৬ হাজার ৭১০ কিউসেক (ঘনফুট প্রতি সেকেন্ড)। গজলডোবা ব্যারাজ চালু হওয়ার পর তা কমে ২ হাজার কিউসেকে দাঁড়ায়। শুষ্ক মৌসুমে সর্বনিম্ন প্রবাহ ১ হাজার ৫০০ কিউসেক থেকে ২০০-৩০০ কিউসেকে নেমে আসে। এটা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। ভূপৃষ্ঠের পানির প্রবাহ হ্রাস এবং সেচের জন্য ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার বৃদ্ধির কারণে তিস্তা অববাহিকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর গত এক দশকে প্রায় ১০ মিটার নিচে নেমে গেছে।

গঙ্গার মতো তিস্তা নিয়েও চুক্তির পরিকল্পনা করা হয়। ১৯৮৩ সালে তিস্তার পানির ৩৯ শতাংশ ভারত, বাংলাদেশ ৩৬ শতাংশ আর ২৫ শতাংশ নদীর জন্য বিবেচনায় নিয়ে খসড়া চুক্তি প্রস্তাব করা হয়। ২০১১ সালে ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ ভারত, বাংলাদেশ ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ আর ২০ শতাংশ পানি নদীর বাস্তুতন্ত্র রক্ষার জন্য বিবেচনায় নিয়ে নতুন প্রস্তাব আসে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের আপত্তির কারণে তিস্তা চুক্তিতে স্বাক্ষরের বিষয়টি ঝুলে গিয়েছে।

তিস্তার পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় পরিবেশের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে থাকে। শুধু পরিবেশন নয় এর সুদুর প্রসারি ক্ষতিকর অর্থনৈতিক প্রভাবের বিষময় যাতনাও সইতে হয় তিস্তা অববাহিকার মানুষকে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণা পত্র Environmental Impact of Teesta Barrage on the Command Area in Bangladesh-এ দেখানো হয়েছে তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্প চালুর এক দশক(১৯৮৩-১৯৯৩) আগে ২.৩৭ মিটার গভীরতায় পানির স্তর পাওয়া যেত এবং প্রকল্প চালুর এক দশক পরে পানির স্তর উপরে ওঠে আসায় মাত্র ১.৬১ মিটার গভীরতায় পানির স্তর পাওয়া যায় যা প্রকল্প এলাকার জন্য ছিল একটি ইতিবাচক দিক। কিন্তু বর্তমানে ভূপৃষ্ঠের পানির প্রবাহ হ্রাস এবং সেচের জন্য ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার বৃদ্ধির কারণে তিস্তা অববাহিকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর গত এক দশকে প্রায় ১০ মিটার নিচে নেমে গেছে। ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় দেখা যায়, তিস্তার পানির ঘাটতির কারণে প্রতিবছর প্রায় ১৫ লাখ টন বোরো ধান উৎপাদনের ক্ষতি হয়েছে। এটা দেশের মোট ধান উৎপাদনের প্রায় ৯ শতাংশের সমান। এই গবেষণায় আরও ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে, যদি পানি সমস্যার সমাধান করা না হয়, তাহলে তিস্তায় পানির ঘাটতির কারণে ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের চাল উৎপাদন প্রায় ৮ শতাংশ এবং ২০৫০ সালের মধ্যে প্রায় ১৪ শতাংশ হ্রাস পেতে পারে। তিস্তা সেচ প্রকল্পের আওতায় বছরে তিন মৌসুমে (আউশ, আমন, বোরো) একরপ্রতি জমির সেচ খরচ দিতে হয় ৪৮০ টাকা। সে হিসেবে শুধু বোরো মৌসুমে এক একর জমিতে সেচ দিতে হয় মাত্র ১৬০ টাকা। তিস্তার সেচের বাইরে অগভীর বা গভীল নলকুপ দিয়ে সেচ দিতে গুনতে হয় সাড়ে চার হাজার থেকে ছয় হাজার টাকা।

সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণা পত্র Assesment of Fish Biodiversity in the Teesta River of Bangladesh এর তথ্য মতে তিস্তা নদীতে মোট মাছ প্রজাতির সংখ্যা ৪৫ টি তন্মধ্যে ১২ প্রজাতির মাছ সহজ লভ্য, ১০ প্রজাতির মাছ সচারচর পাওয়া যায় না এবং ১২ প্রজাতির মাছ অনেকটা দূর্লভ যা বিলুপ্তির পথে।বৈরালি মাছের প্রধান উৎস হলো পাহাড়ি নদী তিস্তা। অর্থাৎ পাহাড় বেয়ে নেমে আসা নদী তিস্তা দিয়ে এই মাছ বহমান। তিস্তার ধারা নামায় ব্রহ্মপুত্র হয়ে যমুনা নদীতেও এই মাছ মেলে। ফলে তিস্তা নদীর অববাহিকার জেলা নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, রংপুর ও গাইবান্ধায় পাওয়া যায় এ মাছ।এই মাছটির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অনেকটা ইলিশ মাছের মতোই। তীব্র স্রোতে উজান থেকে ভাটির দিকে ছুটে চলে।বৈরালি মাছ গ্রীষ্মকালে বংশ বিস্তার করে থাকে। এ ছাড়াও তিস্তায় এক সময় পাওয়া যেত বোয়াল, আইড়, গুলশা, টেংরা, কালিবাউশ, পুঁটি, টাকিসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ।বিশেষজ্ঞদের মতে, তিস্তা নদীর উজানে ভারত বাঁধ নির্মাণ করে সেচ কাজের জন্য এক তরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করে নেওয়ায় ভাটিতে তথা বাংলাদেশ অংশে তিস্তায় প্রকট আকারে পানি সংকট সৃষ্টি হয়েছে। তিস্তায় আগে বহু প্রজাতির মাছ ছিল। এখন মাছের প্রজাতি কমে এসেছে। অনেক রকম ছোট-বড় কীটপতঙ্গ ছিল, এখন আর সেসব নেই। অতীতে নদীতে প্রচুর পরিমাণে শৈবাল দেখা যেত। এখন আর তা নেই। কচ্ছপ, শুশুক ছিল। এখন বর্ষা মৌসুমে কদাচিৎ শুশুক দেখা গেলেও কচ্ছপ আর নেই। এ নদীতে আগে শীত মৌসুমে প্রচুর পাখি আসত। এখন আর আগের মতো পাখিও আসে না।

তিস্তার ভাঙ্গনে সর্বশান্ত হচ্ছে নদী অববাহিকার বাসিন্দারা। তিস্তার উজানে বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ১৩২৮ মিমি এবং মধ্যাঞ্চলে ২৬১৯ মিমি। বার্ষিক বৃষ্টিপাতের ৭৭-৮৪% বৃষ্টি সংগঠিত হয় জুন-সেপ্টেম্বর মাসে।এই স্বল্প সময়ে অতিবৃষ্টির কারণে অববাহিকা অঞ্চলের মাটি নরম হয়ে ফাটলের সৃষ্টি করে ভূমিধ্বসের উপযোগী করে তোলো। তিস্তা অববাহিকার উভয় পার্শ্বে বন ধ্বংসের কারণে অতিসহজে বৃষ্টির পানি গড়িয়ে নিচু অংশের দিকে ধাবিত হয় এবং ভূমিধ্বসের কারণ হয়ে ওঠে । কিন্তু বনভূমি ঘন থাকলে এই পানি গড়িয়ে না পড়ে মাটিতে অনুপ্রবিষ্ট হতো এবং গ্রাউন্ড ওয়াটার লেবেলকে সমৃদ্ধ করতো।উদাহরণস্বরুপ বলা যায় ১৯৯৩ সালের ২০ জুলাই নেপালের কাঠমান্ডুতে ২৪ ঘন্টায় ৫৪০ মিমি বৃষ্টিপাতে ভূমিধ্বসে ও ভাঙ্গনে ৫ মিলিয়ন কিউবিক মিটার সেডিমেন্ট নদীগর্ভে বয়ে আনে। এরুপ অতিরিক্ত পলি ও কাদা মাটি জমে ড্যামের গেটের প্লেট ভেঙ্গে ফেলতে পারে আশংকায় সকল গেট খুলে দেয়া হয় ফলে সকল সেডিমেন্ট বা ভাটির অঞ্চল বাংলাদেশে এসে জমা হয়। এভাবে বাংলাদেশের ১৫১ কিমি অংশে প্রতিবছর ২ কোটি টন পলি ও কাদা তিস্তার বুকে জমা হয়ে নদী গর্ভ ভরাট হয়ে যায়। ৪০ বছর আগেও নদীটি বাংলাদেশ অংশে বর্ষা মৌসুমে প্রস্থে ছিল ২ কিলোমিটার, শুষ্ক মৌসুমে ১ কিলোমিটার।তিস্তা যখন প্রস্থে ১ থেকে ২ কিলোমিটার ছিল, তখন পানির বেগ ছিল প্রচুর। সেই বেগে নদীর তলদেশ গভীর হতো। কৃত্রিমভাবে তিস্তার তলদেশ খনন করে অতীতে এর গভীরতা বৃদ্ধি করা হয়নি, গভীর হয়েছিল প্রাকৃতিকভাবেই। অপরিকল্পিতভাবে নদী রক্ষা বাঁধ এবং ব্যারাজ নির্মাণের ফলে নদীটি এখন কোথাও কোথাও প্রস্থে প্রায় ১০ কিলোমিটার হয়েছে। নদীটি তার গভীরতা হারিয়েছে। কিন্তু বর্ষাকালের প্রশস্ততায় প্রতিবছর দুই পাড়ে যে হাজার হাজার হেক্টর জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়, তা দিয়ে নদীর তলদেশ ভরাট হচ্ছে। উজান থেকে প্রচুর পরিমাণ বালু এসেও নদীর তলদেশ ক্রমেই স্ফীত হয়ে উঠছে। এখন কোথাও কোথাও নদীর তলদেশ সমতল ভূমির চেয়ে অনেক উঁচু।তিস্তা নদীর সঠিক ব্যবস্থাপনা না থাকায় বছরে যে পরিমাণ ক্ষতি হয়, এর আর্থিক মূল্য এক লাখ কোটি টাকার কম হবে বলে মনে হয় না। প্রতিবছর পানি আটকে রেখে হঠাৎ ছেড়ে দেওয়ার কারণে বাংলাদেশে বড় বড় আকস্মিক বন্যা হয়। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের এই অমানবিক আচরণের কোনো প্রতিবাদও আমরা দেখতে বা শুনতে পাই না। রংপুর অঞ্চলের প্রায় দুই কোটি মানুষ তিস্তার ওপর প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল। তারা অপেক্ষা করে আছে একদিন তিস্তা চুক্তি হবে, তিস্তা নদী সুরক্ষায় কার্যকর পরিচর্যা হবে। নদীপারের ক্ষতিগ্রস্ত এবং আতঙ্কগ্রস্ত মানুষ নদীর ভাঙন আর বন্যা থেকে মুক্তি চায়। নদীবিজ্ঞান, নদী প্রযুক্তি, নদী রাজনীতি, ভূরাজনৈতিক বিষয়—এসব বিশেষ কিছুই বোঝেন না নদীপারের সাধারণ মানুষ। তারা চায় তাদের বাড়ি যেন ভেঙে না যায়।

বাংলাদেশে সবচেয়ে গরিব ১০টি জেলার ৫টি রংপুর বিভাগে। এর মধ্যে চারটি তিস্তাপারের। এর প্রধান কারণ, তিস্তা নদীর সর্বগ্রাসী রূপ। তিস্তা নদীর বিজ্ঞানসম্মত পরিচর্যা সম্ভব হলে ভাঙন ও বন্যা রোধে অনেকখানি কাজ করা সম্ভব হবে। তখন কৃষিনির্ভর তিস্তাপারের কোটি মানুষে তিস্তার অভিশাপ থেকে রক্ষা পাবে। একবারের ভাঙন-বন্যার ক্ষতি পুষিয়ে ওঠার আগেই আরেক দুর্যোগ দেখা দেয়। গরিবানা অবস্থা থেকে এই অঞ্চলকে মুক্ত করতে হলে তিস্তা নদীর ব্যবস্থাপনার কোনো বিকল্প নেই।

২০১০ সাল থেকে নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপল তিস্তা নদীর পানির ন্যায্য হিস্যার দাবিতে আন্দোলন করে আসছে। তিস্তা নদী সুরক্ষায় আরও সংগঠন কাজ করছে। বর্তমানে তিস্তা নিয়ে আন্দোলন করা সবচেয়ে বড় সংগঠনের নাম তিস্তা বাঁচাও, নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদ। তিস্তা যখন প্রস্থে ১ থেকে ২ কিলোমিটার ছিল, তখন পানির বেগ ছিল প্রচুর। সেই বেগে নদীর তলদেশ গভীর হতো। কৃত্রিমভাবে তিস্তার তলদেশ খনন করে অতীতে এর গভীরতা বৃদ্ধি করা হয়নি, গভীর হয়েছিল প্রাকৃতিকভাবেই। নদী রক্ষা বাঁধের নামে উৎসমুখ বন্ধ করে ঘাঘট-মানাস-বাইশাডারার মতো শাখা নদীগুলোকে তিস্তা থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছে।তিস্তায় আগে বহু প্রজাতির মাছ ছিল। এখন মাছের প্রজাতি কমে এসেছে। অনেক রকম ছোট-বড় কীটপতঙ্গ ছিল, এখন আর সেসব নেই। অতীতে নদীতে প্রচুর পরিমাণে শৈবাল দেখা যেত। এখন আর তা নেই। কচ্ছপ, শুশুক ছিল। এখন বর্ষা মৌসুমে কদাচিৎ শুশুক দেখা গেলেও কচ্ছপ আর নেই। এ নদীতে আগে শীত মৌসুমে প্রচুর পাখি আসত।

তিস্তার পানি সমস্যা একটি মানবিক সমস্যা। এর সমাধান হলে কেবল পানি সমস্যার সমাধানই যে হবে তা নয়, এটি দুই দেশের জনগণের মধ্যে বিশ্বাস, আস্থা, সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য বৃদ্ধির সহায়ক হবে।মানবসভ্যতার বিকাশ, সমৃদ্ধি ও বিবর্তনে পানি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। পানির একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, পানি নিচের দিকে গড়ায় এবং দেশের রাষ্ট্রীয় বা প্রশাসনিক সীমানা মানে না, এক দেশ থেকে আরেক দেশে চলে যায়।

বাংলাদেশের মানুষ ভারতের নতুন সরকারের সঙ্গে তিস্তার পানিব্যবহার নিয়ে কোনো ‘লোক দেখানো চুক্তি’ চায় না। তারা চায়, ভারত ও বাংলাদেশ পানি চুক্তি সম্পাদনকালে জাতিসংঘের ১৯৯৭ সালের নদী কনভেনশনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবে।ভারত বাংলাদেশকে তার ন্যায্য পানি দিতে কুন্ঠিত থাকলেও বিগত সময়ে দেশটি পাকিস্তানের সাথে সিন্ধু নদী নিয়ে ১৯৬০ সালে এবং নেপালের সাথে মহাকালি ও কোশি নদী নিয়ে ১৯৯৬ সালে সন্তোষজনক চুক্তিতে উপনীত হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে বিশ্ব ব্যাংকও ক্ষেত্র বিশেষে কারিগরি সহায়তা দিয়েছে। নেপালে বুড়ি গন্ধকী হাইড্রো-ইলেকট্রিক প্রকল্পেও ভারত গভীরভাবে সম্পৃক্ত। প্রায় ৮৩ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সুযোগ তৈরী করে নিয়েছে ভারত নেপালের নদীগুলোতে।

বর্তমানে বিশ্বে আনুমানিক ২৬০টি আন্তর্জাতিক নদী রয়েছে। বিশ্বের প্রায় ৪০ ভাগ লোক এই আন্তর্জাতিক নদীগুলোর অববাহিকায় বসবাস করে।তিস্তা একটি আন্তর্জাতিক নদী। বিশ্বের অভিন্ন নদীগুলোর মধ্যে ইউরোপের ১১টি দেশ দানিউব নদীর পানি বণ্টন নিয়ে সমঝোতায় পৌঁছেছে। এশিয়ার মেকং নদীর পানি বণ্টনে ভিয়েতনাম, লাওস, কাম্পুচিয়া, থাইল্যান্ড প্রভৃতি দেশকে সহযোগিতা করেছে জাতিসংঘ। এভাবে যুক্তরাষ্ট্র ও মেক্সিকো, ভারত ও পাকিস্তান প্রভৃতি দেশের মধ্যে অভিন্ন নদীর পানির পরস্পর ন্যায্য হিস্যা প্রাপ্তিতে একমত হতে পেরেছে। কিন্তু বাংলাদেশের বেলায় তার ব্যতিক্রম হচ্ছে কেন- তা বোধগম্য নয়।

বিশ্বের অধিকাংশ সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল কোনো প্রবাহমান নদীর পাশেই। আবার পানি প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করে বিশেষ ভূখন্ডকে শাসনাধীনে রাখারও অনেক নজির রয়েছে। পানির সাথে বোঝাপড়া করে আন্ত:সীমানা নদীর অববাহিকার রাষ্ট্রগুলো যতটা অগ্রগতি দেখিয়েছে সেঅঞ্চলে ততটাই আঞ্চলিক শান্তি শৃঙ্খলা ও সমৃদ্ধি ঘটেছে বিশ্বে এমন দৃষ্টান্তও আছে অনেক। যৌথ নদী প্রবাহ সংশ্লিষ্ট সবদেশের সরকার ও জনগনের সাথে সমতা ও যৌক্তিক বিবেচনার আলোকে পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে অন্যের ন্যায় সঙ্গত অধিকারকে সম্মান ও শ্রদ্ধা জানানো আন্তর্জাতিক শান্তিপূর্ণ সম্পর্কের ভিত্তি। কোনো দেশের নিজ রাষ্ট্রীয় সীমানায় নদীতে বাঁধ, ব্যারাজ নির্মাণের সাবভৌম অধিকার থাকলেও তা অসীম নয়। উজানের দেশ এমনভাবে পানি ব্যবহার করবে যা ভাটির দেশের মানুষের ও প্রকৃতি-পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হবে না। পানি শাস্ত্রে এরুপ দৃষ্টি ভঙ্গিকে Riparian Water Rights বা অববাহিকার পানি অধিকার বলা হয়। বর্তমানে আমাদের দেশে তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যার দাবিতে যে আন্দোলন গড়ে উঠেছে তার আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায় এখন আমাদের অধিকার হিসেবে অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।

সারাবাংলা/এসবিডিই

তিস্তা নদীর ওপর গজলডোবা বাঁধ আমাদের জন্য মরণ ফাঁদ প্রফেসর মীর্জা মো. নাসির উদ্দিন মত-দ্বিমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর