শূন্যের উপর ভাসে
১০ অক্টোবর ২০২৪ ১৫:৪৮
চোখ বন্ধ করে রূপ দেখার ধারণা একটি গভীর চিন্তা, বিশেষত আধ্যাত্মিক অনুসন্ধানে। হাসান বা লালন যেমন আমাদের বলেন, তারা কিছু দেখেন, যা আমরা চোখ বন্ধ করলেই বুঝতে পারি না। হাসান বলেন, চোখ বন্ধ করলেই রূপ দেখা যায়, কিন্তু বাস্তবে, চোখ বন্ধ করলে দেখা যায় শুধুই অন্ধকার। এই অবস্থার ভেতর দিয়ে যে বিভ্রান্তি আসে, তা লালনের গানের মধ্যেও প্রতিফলিত হয়। তার গান “বাড়ির কাছে আরশিনগর” আমাদের বিভ্রান্তির গভীরে ঠেলে দেয়।
লালন এক ‘পড়শি’-র কথা বলেন, যাকে তিনি একদিনও দেখেননি। আর এই পড়শি নিয়ে আমার চিন্তাভাবনার কোনো শেষ নেই। এক পড়শি, যার হস্তপদ, স্কন্ধমাথা কিছুই নেই, তাকে কিভাবে চেনা যায়? হাত-পা-মাথা ছাড়া কেউ থাকে নাকি? আমাদের যুক্তি আর বাস্তবতার চিরাচরিত ধারণায় এ ধরনের কিছু কল্পনা করাও কঠিন। তাহলে লালনের এই পড়শি কি সত্যিই বাস্তব? নাকি এটি শুধুই একটি আধ্যাত্মিক প্রতীক?
এই গানে লালন যে ‘পড়শি’-র কথা বলেন, তা কি আদৌ কোনো মানুষ? নাকি এটি এমন কিছু, যা আমরা বোঝার চেষ্টা করলেও বুঝতে পারি না? ‘পড়শি’ বলতে লালন এমন এক সত্তার কথা বলেছেন, যার অস্তিত্ব আমরা অনুভব করতে পারি, কিন্তু দেখতে পারি না। এই সত্তা শরীরী নয়—এর হস্তপদ, মাথা বা স্কন্ধ নেই। ফলে তাকে চেনার একমাত্র উপায় হলো আধ্যাত্মিক জ্ঞান বা অনুভূতি।
কিন্তু লালনের বিভ্রান্তি এখানেই শেষ নয়। এই পড়শি আবার শূন্যের উপর ভাসে, কখনো পানির উপর ভাসে। আচ্ছা বলুন তো, এ আবার কেমন কথা? কেউ কি শূন্যের উপর ভাসে? আমাদের বাস্তব দুনিয়ায় শূন্যে ভাসার কোনো সম্ভাবনা নেই। তাহলে লালন এখানে কি বলতে চেয়েছেন?
লালনের এই পড়শি আসলে আমাদের মন, মনের গভীরতায় লুকিয়ে থাকা এক রহস্য। শূন্যের উপর ভাসা বলতে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, পড়শি হলো এমন এক সত্তা যা ধরা-ছোঁয়া যায় না। কখনও মনে হয় আমরা তাকে বুঝতে পেরেছি, কিন্তু পরমুহূর্তেই সে আবার অদৃশ্য হয়ে যায়।
সবচেয়ে বিভ্রান্তিকর ব্যাপার হলো, লালন বলেন, তিনি এবং পড়শি একসঙ্গে আছেন, অথচ তাদের মধ্যে লক্ষ যোজন দূরত্ব। এখানেই আসে মানুষের জীবনের চরম সত্য—আমরা আসলে সেই ‘পড়শি’-র কাছাকাছি আছি, কিন্তু তাকে উপলব্ধি করতে পারি না। এটা আমাদের আত্মার কথা, যা আমাদের ভিতরেই আছে, কিন্তু আমরা সেই সত্যকে কখনো পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পারি না। এই দূরত্ব আসলে আমাদের অজ্ঞতা, আমাদের বিভ্রান্তি।
এখন কথা হচ্ছে, এই বিভ্রান্তি নিয়ে আমরা কোথায় যাব? সত্যি বলতে, লালনের এই গানে বিভ্রান্তির একটা সীমা নেই। আমাদের স্বাভাবিক যুক্তি আর বাস্তবতার জগতে এই পড়শি, এই শূন্যের উপর ভাসা, এই লক্ষ যোজন দূরত্ব—সবই যেন ধাঁধা। কিন্তু ফকির লালন তো সেসব ধাঁধার মধ্যেই জীবনের আসল সত্য খুঁজে পাওয়ার কথা বলেন। তিনি আমাদের শেখান, কখনো কখনো বিভ্রান্তির ভেতর দিয়েই সেই সত্যের সন্ধান করতে হয়।
এই যে লালন আমাদেরকে বিভ্রান্তির মধ্যে রেখে পরীক্ষা করলেন, এতে তার ফায়দাটা কী হলো? তিনি হয়তো আধ্যাত্মিকতায় উতরে গেলেন, কিন্তু আমাদের বিভ্রান্তি তো একই জায়গায় রয়ে গেল।
শরীরের ভেতরে যাত্রা। তা কি আসলেই শরীরের ভেতরে? অর্থাৎ, তার অস্তিত্ব কি কেউ কোনোদিন নিশ্চিত হতে পেরেছে? লালন কি হাসন কি আত্মা সম্বন্ধে নিশ্চিত ছিলেন? এই যে লালনের আরশিনগর অর্থাৎ হৃদয়, আত্মা। এই যে লালন সত্যানুসন্ধানের কথা বলেন, এই সত্যকে উপলব্ধির প্রক্রিয়াটা কী? কীভাবে আমরা নিজের আত্মার কাছে যেতে পারি? আমরা আত্মাকে দেখিনা, কিন্তু তাকে নিয়েই বসবাস করি। সত্যকে আমরা দেখতে পাই না, কিন্তু সত্য আমাদের মাঝে বিরাজিত। তিনি যখন বলেন, শূন্যের উপর ভাসে, তখন আরও বেশি বিভ্রান্তি জেঁকে বসে। কারণ আমরা যদি ধরে নেই যে তিনি ইনার সোল বা শরীরের ভেতরে হৃদয়ের কথা বলছেন, আত্মার কথা বলছেন, তাহলে তো শূন্যে কিভাবে ভাসবে? শূন্যে ভাসতে হলে পুরো শরীরকে উড়তে হবে। তা কিভাবে সম্ভব? আত্মা অনুসন্ধানে মৃত্যুভয় তিরোহিত হয়, কিন্তু এই অনুসন্ধান প্রক্রিয়াটা সম্পর্কে লালন কিছু বলেন না। যা বলেন, তাও বিভ্রান্তিতে ভরপুর। অন্তত সাধারণ মানুষের পক্ষে এই বিভ্রান্তি কাটিয়ে উঠা সম্ভব না।
এখানে মূল সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় আধ্যাত্মিক ধ্যানের সঙ্গে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সংযোগ। হাসন এবং লালন মানুষকে ধ্যানে বসাতে চান। আমরাও চাই কিছুক্ষণ ধ্যানে বসে থাকি। কিন্তু একজন ছিলেন জমিদার, তাকে সংসারের চিন্তা তেমন করতে হতো না। বাজারে যেতে হতো না, ছেলের জন্য হরলিক্স কিনে আনতে হতো না। অন্যজন সব মোহ ত্যাগ করে ফকির সেজে ছিলেন, তার খাবারের হাপিত্যেশ ছিল না। যা জুটত, তাতেই সন্তুষ্ট ছিলেন। কিন্তু আমরা জমিদার নই, ফকিরও নই। আমরা সংসারী। স্ত্রীর শাড়ি, ছেলের খাতা, মেয়ের চুলের রিবন—সবকিছুর খেয়াল আমাদের রাখতে হয়। আমাদের মাথায় প্রতিদিনকার জীবনের নানা চাহিদা, চাপ, দায়িত্ব, এবং দুশ্চিন্তা। আমরা কিভাবে ধ্যানে বসে যাব? কীভাবে পড়শির অনুসন্ধান করব?
লালনের এই আধ্যাত্মিকতা হয়তো তার জীবনধারার সঙ্গে মানানসই ছিল। কিন্তু আমাদের বাস্তব জীবনে, যেখানে প্রতিনিয়ত টিকে থাকার লড়াই চলে, সেখানে পড়শি বা আত্মার সন্ধান এক ধরনের বিলাসিতা হয়ে দাঁড়ায়। সাধারণ মানুষের সমস্যাগুলো আরও জটিল। প্রতিদিনকার খাদ্যসংস্থান, জীবিকার তাগিদ, সন্তানের ভবিষ্যৎ—এসব চিন্তা আমাদের ধ্যানের পথকে বারবার বাধা দেয়। বস্তুত, আমাদের বাস্তবতার জগতে আত্মা বা পড়শি খোঁজার মতো সময়, ধৈর্য, কিংবা অবসর কোথায়?
এই জটিলতার মধ্যে লালনের আদর্শকে গ্রহণ করা মানে নিজেকে এক নতুন ধরনের বিভ্রান্তিতে ফেলে দেওয়া। আমাদের প্রশ্ন করতে হয়, এই বিভ্রান্তি কাটিয়ে উঠার উপায় কী? লালন নিজে হয়তো আধ্যাত্মিকতার শীর্ষে পৌঁছেছিলেন, কিন্তু সাধারণ মানুষ সেই পথ কোথায় পাবে? এ ধরনের উচ্চতর চিন্তা-ভাবনা সাধারণ মানুষের মনোজগতে কতটুকু প্রভাব ফেলতে পারে, তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। একদিকে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের বাস্তবতা, অন্যদিকে লালনের আধ্যাত্মিকতার গভীরতা—এ দুটি সেতুতে কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় না।
এখানেই লালনের মূল বার্তা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। তিনি আমাদের শিখিয়েছেন যে, আমরা নিজের ভেতরে সত্যের সন্ধান করতে পারি। কিন্তু আমাদের ভেতরের বিভ্রান্তি, দায়িত্বের চাপে ডুবে থাকা মন—এগুলো আমাদের সেই সত্য থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। তাই, লালনের মতো গভীর আধ্যাত্মিক অনুসন্ধান করা হয়তো সবার পক্ষে সম্ভব নয়।
তবুও, লালনের এই বিভ্রান্তির মধ্যেও একটা নিরন্তর আকর্ষণ থেকে যায়। এই আকর্ষণ মূলত আমাদের ভেতরের শান্তি খোঁজার তাড়না। আমরা জানি, জীবনের প্রতিটি ধাপে আমরা কোনো না কোনো বিভ্রান্তির মুখোমুখি হবো। কিন্তু সেই বিভ্রান্তি থেকে শিক্ষা নিয়ে, আমাদের নিজেদের ভেতরের সত্যের দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাওয়া—সেটাই হয়তো লালনের আসল বার্তা।
লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী, ছোটকাগজ ‘শব্দপাঠ’ সম্পাদক
সারাবাংলা/এসবিডিই