শারদীয় দুর্গোৎসব: ঐক্য ও সংহতির প্রতীক
১২ অক্টোবর ২০২৪ ১৮:১১
শারদীয় দুর্গোৎসবের ইতিহাস বহু প্রাচীন ও সমৃদ্ধ, যা হাজার বছরের পুরনো ঐতিহ্যের ধারক। এই উৎসবের উৎপত্তি ও বিকাশ মূলত প্রাচীন ভারতীয় ধর্ম, সমাজ এবং সংস্কৃতির সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। দেবী দুর্গাকে কেন্দ্র করে এই পূজা প্রাথমিকভাবে সনাতন ধর্মের এক গুরুত্বপূর্ণ আচার হলেও, কালের বিবর্তনে এটি বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে।
দুর্গাপূজার প্রথম লিখিত উল্লেখ পাওয়া যায় প্রাচীন ভারতীয় পুরাণ ও ধর্মগ্রন্থে। পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে, দেবী দুর্গা মহিষাসুর নামে এক অসুরকে বধ করে দেবতাদের রক্ষা করেন। এই দেবী দুর্গা হলেন শক্তির প্রতীক, যিনি শৃঙ্খলা ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা করেন। তার এই বিজয়কে কেন্দ্র করেই দুর্গাপূজার মূল ধারণা গড়ে ওঠে। দেবী দুর্গার এই রূপ বাঙালি হিন্দুদের কাছে মহাশক্তি ও মাতৃত্বের প্রতীক হিসেবে গৃহীত হয়।
দেবী দুর্গা কর্তৃক মহিষাসুরকে বধ করার ঘটনাটি হিন্দু পুরাণে এক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ উপাখ্যান হিসেবে বিবেচিত। দেবী দুর্গা এখানে শুদ্ধ শক্তির প্রতীক, আর মহিষাসুর হলেন অশুভ শক্তির প্রতীক। এই কাহিনী মূলত ন্যায় ও অন্যায়ের চিরন্তন লড়াইয়ের একটি মূর্ত প্রতীক, যেখানে দেবী দুর্গা অসুরের অত্যাচারের অবসান ঘটিয়ে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করেন।
পুরাণ অনুযায়ী, মহিষাসুর ছিল একজন অসুর, যার জন্ম অশুভ শক্তি থেকে। দীর্ঘ তপস্যার মাধ্যমে মহিষাসুর ব্রহ্মার কাছ থেকে একটি বিশেষ বর লাভ করে, যেখানে তাকে কোনো দেবতা বা মানুষ হত্যা করতে পারবে না। এই বর পাওয়ার পর মহিষাসুর পৃথিবী এবং স্বর্গে তার ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। সে দেবতাদের পরাজিত করে স্বর্গরাজ্য দখল করে নেয় এবং নিজেকে অপরাজেয় মনে করে।
মহিষাসুরের অত্যাচার এবং অহংকার যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায়, তখন দেবতারা ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং মহেশ্বরের কাছে সাহায্যের জন্য আবেদন করেন। দেবতারা মিলে একটি বিশেষ শক্তির সৃষ্টি করেন, যা দেবী দুর্গার রূপ ধারণ করে। দেবী দুর্গা হলেন সেই সংহত শক্তির প্রতীক, যিনি দেবতাদের শক্তিকে একত্র করে মহিষাসুরকে পরাজিত করার জন্য প্রেরিত হন।
দেবী দুর্গা মহিষাসুরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য সিংহে আরোহণ করে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হন। মহিষাসুর বিভিন্ন রূপ ধারণ করে দেবীকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে, কিন্তু দেবী তার প্রতিটি রূপকে পরাজিত করেন। অবশেষে মহিষাসুর মহিষের রূপ ধারণ করে দেবীর সঙ্গে চূড়ান্ত যুদ্ধে লিপ্ত হয়। দীর্ঘ যুদ্ধের পর দেবী দুর্গা মহিষাসুরকে বধ করেন এবং তার অশুভ শক্তির অবসান ঘটান।
মহিষাসুর বধের কাহিনী থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ নৈতিক শিক্ষা পাওয়া যায়। প্রথমত, এটি ন্যায় ও সত্যের বিজয়ের প্রতীক। মহিষাসুরের অহংকার এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে দেবী দুর্গা ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা করেন। দ্বিতীয়ত, এটি শক্তি এবং একাত্মতার উদাহরণ, যেখানে দেবতাদের সম্মিলিত শক্তি দেবী দুর্গার রূপে প্রকাশ পায় এবং অসুরের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জয়লাভ করে।
তৃতীয়ত, মহিষাসুরের বধ কেবল এক পাপিষ্ঠের পতন নয়, বরং তা অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে শুভ শক্তির চিরন্তন সংগ্রামের প্রতিফলন। এই কাহিনী মানুষের জীবনেও প্রযোজ্য, যেখানে অন্যায়, অত্যাচার এবং অহংকারের বিরুদ্ধে সঠিক পথে থেকে সংগ্রাম করা এবং জয়লাভ করা উচিত।
সুতরাং, দেবী দুর্গা কর্তৃক মহিষাসুর বধের মূল কারণ হলো ন্যায় প্রতিষ্ঠা, অশুভ শক্তির বিনাশ, এবং পৃথিবীতে শান্তি ও সুস্থিতি ফিরিয়ে আনা। এটি এমন একটি কাহিনী যা মানব সমাজে সত্য, ন্যায় এবং শুদ্ধতার গুরুত্বকে প্রাধান্য দেয়।
শারদীয় দুর্গাপূজার বিশেষ গুরুত্ব পাওয়ার পিছনে আছে শারদ ঋতুর বিশেষ প্রভাব। পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী, আদিতে দুর্গাপূজা বসন্তকালে করা হতো, যা “বসন্তি পূজা” নামে পরিচিত। কিন্তু রামায়ণে উল্লেখ আছে, শ্রীরামচন্দ্র শারদ ঋতুতে দুর্গাকে পূজা করে তার আশীর্বাদ প্রার্থনা করেন রাবণের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়লাভের জন্য। এই পূজাকেই “অকালবোধন” বলা হয়, যা পরে শারদীয় দুর্গোৎসব হিসেবে জনপ্রিয়তা লাভ করে।
ঐতিহাসিক দিক থেকে দেখা যায়, ১৬শ শতাব্দীতে বাংলার জমিদার ও রাজপরিবারগুলোর উদ্যোগে দুর্গাপূজা ধীরে ধীরে এক বিশাল আকার ধারণ করে। এ সময় বাংলার বিভিন্ন জমিদাররা তাদের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির প্রদর্শন করতে দুর্গাপূজার আয়োজন করতেন। বিশেষ করে নদীয়া, কৃষ্ণনগর, ও কাশিমবাজারের রাজপরিবারগুলো দুর্গাপূজাকে বর্ণাঢ্য ও রাজকীয় আকারে উদযাপন করত। এই সময় থেকেই দুর্গাপূজা সমাজের অভিজাত শ্রেণির উৎসব হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে।
১৮শ ও ১৯শ শতাব্দীতে ব্রিটিশ শাসনামলে কলকাতায় দুর্গাপূজা আরও ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হয়। সেই সময়ে বাঙালি ধনী ও শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজ দুর্গাপূজাকে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে শুরু করে। এই সময়ে শারদীয় দুর্গোৎসব শহরের সড়কে ও মহল্লায় মহাসমারোহে পালিত হতে শুরু করে। এটি ছিল নিত্যনতুন চিন্তাভাবনার উদ্ভব, যেখানে শিল্প, সংস্কৃতি, ও মানবতার সাথে মিলন ঘটেছিল।
আধুনিক যুগে, দুর্গাপূজার এই অনাবিল উৎসব বাঙালি সমাজের একটি অন্যতম সনাতন আচার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এটি বর্তমানে শুধু একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, বরং একটি সাংস্কৃতিক উৎসবও। এই উৎসবের মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন ভক্তরা দেবীর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন, তেমনই অন্যদিকে সমাজের সব শ্রেণীর মানুষ একত্রিত হয়ে উদযাপন করেন। এটি একটি সামাজিক সমাবেশ, যেখানে মানুষের মধ্যে সম্পর্ক ও বন্ধন তৈরি হয়।
শারদীয় দুর্গোৎসব বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এ উৎসবের মাধ্যমে কেবল ধর্মীয় ভাবনা প্রকাশ পায় না, বরং এটি একটি সাংস্কৃতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দুর্গাপূজার সময়, স্থানীয় জনগণের মধ্যে সংহতি ও সহযোগিতার মনোভাব তৈরি হয়। স্থানীয় সরকার, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, এবং সামাজিক সংগঠনগুলো এই সময় বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ করে, যাতে দুর্গাপূজা সুন্দরভাবে উদযাপিত হতে পারে।
দুর্গাপূজার প্রভাব শুধু ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়। এটি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও বিশেষ ভূমিকা পালন করে। প্রতিটি বছর দুর্গাপূজার সময় বাঙালি সমাজে বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পায়। পূজার আগে ও পরে মানুষ কেনাকাটা করে, যা স্থানীয় ব্যবসায়ীদের জন্য একটি বড় সুযোগ। ঢাকাসহ অন্যান্য বড় শহরে বিস্তৃত মণ্ডপ নির্মাণ ও সাজসজ্জার জন্য কাজের সুযোগ তৈরি হয়। এই কর্মসূচিগুলো স্থানীয় অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
একদিকে দুর্গাপূজা শারদীয় উৎসব হিসেবে একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান, অন্যদিকে এটি সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক সমাবেশের একটি প্ল্যাটফর্ম। পূজার সময় স্থানীয় জনগণ মণ্ডপে মিলিত হয়, যা তাদের মধ্যে একাত্মতার অনুভূতি জাগিয়ে তোলে। দুর্গাপূজা মানুষের জীবনে আনন্দের আবহ সৃষ্টি করে, যেখানে ধর্ম, সংস্কৃতি এবং সমাজের অবিচ্ছেদ্য সুত্রগুলি একত্রিত হয়।
শারদীয় দুর্গোৎসব মানুষের মধ্যে আনন্দ, শৃঙ্খলা, ও সম্পর্কের বন্ধন তৈরি করে, যা আমাদের সামগ্রিক জীবনে একটি ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। এই উৎসব শুধু একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, বরং মানবতার এক গুরুত্বপূর্ণ উদযাপন, যেখানে সমাজের সমস্ত শ্রেণী ও সম্প্রদায় একত্রিত হয়ে আনন্দের ভাগিদার হয়।
শারদীয় দুর্গোৎসবের এই জাঁকজমক, আনন্দ, ও আনন্দময়তা আমাদের জীবনে এক নতুন দিশার সূচনা করে। এটি আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও সামাজিক বন্ধনকে আরও শক্তিশালী করে। এটি কেবল আমাদের ধর্মীয় বিশ্বাসকে সেলিব্রেট করে না, বরং আমাদের মধ্যে সংহতির আবহ তৈরি করে, যা একটি শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ সমাজের জন্য অপরিহার্য।
দুর্গাপূজা শুধু ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, বরং এটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকেও একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎসব। এই উৎসব আমাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সুরক্ষা করে এবং সমাজের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি গড়ে তোলে। প্রতিটি বছর শারদীয় দুর্গোৎসবের সময় বাঙালি সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষ একত্রিত হয়ে এই উৎসব উদযাপন করে, যা আমাদের সমাজকে আরও উন্নত ও শক্তিশালী করে।
শারদীয় দুর্গোৎসবের মাধ্যমে আমরা যেন নিজেদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে আরো গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারি এবং আগামী প্রজন্মের কাছে তা সঠিকভাবে তুলে ধরতে পারি।
লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী
সারাবাংলা/এসবিডিই
ড. মতিউর রহমান মত-দ্বিমত শারদীয় দুর্গোৎসব: ঐক্য ও সংহতির প্রতীক