প্রেমের তুষের আগুন
১৯ অক্টোবর ২০২৪ ১৫:১৫
রাধারমণ দত্ত তার জীবনের এক পর্যায়ে মৌলভীবাজারে অবস্থান করেন। মৌলভীবাজার শহর থেকে তিন কিলোমিটার দূরে ঢেউপাশা গ্রাম অবস্থিত, যা এখনো তার ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। তখন গ্রামে আধুনিকতার ছোঁয়া না লাগলেও শিক্ষার জন্য একটি বিদ্যালয় ছিল, যা গ্রামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থান। গ্রামের জীবনের মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল মনু নদী। নদী পাড়ি দিয়ে গ্রামে যেতে হত, কারণ কোনো পাকা সেতু ছিল না। তখন খেয়া নৌকাই একমাত্র ভরসা। যদিও এখন সেই নৌকাগুলো অতীতের ধূলিসাৎ স্মৃতি হয়ে গেছে, এবং দানবীয় ট্রাকগুলো গ্রামের মধ্যে দাপিয়ে বেড়ায়।
এই গ্রামেই বসবাস করতেন রাধারমণের আধ্যাত্মিক গুরু, যাদের সবাই ‘গোস্বামী’ বা ‘গোঁসাই’ নামে চিনতেন। এই গোঁসাইদের কাছ থেকেই রাধারমণ দীক্ষা গ্রহণ করেন এবং বেশ কিছু সময় ঢেউপাশা গ্রামে কাটান। তার জীবনের সেই সময়টা কেবল আধ্যাত্মিক শিক্ষা নয়, বরং তার সঙ্গীত ও কাব্য প্রতিভার বিকাশের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যদিও ইতিহাসবিদেরা এর কোনো সুনির্দিষ্ট বিবরণ রাখেননি, তবু মনে করা হয়, রাধারমণের কৃষ্ণ-বিরহের শৈল্পিক প্রতিভা এখানে থেকেই গভীর ভাবে প্রভাবিত হয়েছিল। কৃষ্ণের প্রতি তার যে গভীর অনুরাগ, তার গানে যে বিরহের ব্যাকুলতা ফুটে উঠেছে, তার বীজ বপন সম্ভবত এখানেই হয়েছিল।
আমার আদি নিবাসও ঢেউপাশায়, এবং আমাদের বাড়ি মাস্টার বাড়ি নামে পরিচিত। আমার দাদা ছিলেন ব্রিটিশ আমলের একজন মাস্টার, যিনি নিজেও লেখালেখির প্রতি অনুরাগী ছিলেন। আমরা তার একটি পুরোনো খাতা পেয়েছি, যেখানে ১৯০১ সাল থেকে ১৯২১ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন বাণী ও কবিতা লিপিবদ্ধ করা আছে। দাদার সাথে রাধারমণের দেখা হয়েছে কিনা জানা নেই, কিন্তু ঢেউপাশা যেহেতু ছোট্ট একটি গ্রাম ছিল, তাই দেখা হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। সম্ভবত ভোরের কোনো এক নিস্তব্ধ সকালে তারা একে অপরের মুখোমুখি হয়েছিলেন।
রাধারমণের জীবনের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ছিল তার শ্বশুরবাড়ির সাথে মৌলভীবাজারের যোগ। তার স্ত্রী মৌলভীবাজারের মেয়ে ছিলেন, যা তার ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্গে এই অঞ্চলের গভীর সংযোগ তৈরি করে। পরে, রাধারমণ সংসার ত্যাগ করে বৈরাগ্য গ্রহণ করেন এবং সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরে নলুয়ার হাওরের পাশে একটি আশ্রম গড়ে তোলেন। সেখানেই তিনি তার জীবনদর্শনকে পূর্ণতা দেন এবং শেষ বয়সে সাধনায় লিপ্ত থেকে সেখানেই প্রয়াত হন।
কৃষ্ণ-বিরহের উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে রাধারমণের অবদান অনন্য। তার আদি নাম ছিল রাধারমণ দত্ত পুরকায়স্থ, কিন্তু তিনি নিজেকে রাধারূপে অনুভব করতেন, কৃষ্ণের জন্য তার গানে যে ব্যাকুলতা ফুটে উঠেছে, তা রাধার বিরহী মনকে প্রতিফলিত করে। রাধারমণের গানগুলো শুধুমাত্র কৃষ্ণ-বিরহেই সীমাবদ্ধ নয়; ভক্তিমূলক গান ছাড়াও তিনি দেহতত্ত্ব, অনুরাগ, প্রেম, ভজন এবং ধামাইলের মতো বিভিন্ন ধরনের গান রচনা করেছেন।
ধামাইল গানের প্রবর্তক হিসেবে রাধারমণের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই গানগুলো মূলত বিবাহের আসরে গাওয়া হত, এবং এখনো ধামাইল গান ছাড়া কোনও বিবাহ অনুষ্ঠান সম্পূর্ণ হয় না। তার গাওয়া এবং লেখা ধামাইল গান এখন সারা বাংলার ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে।
রাধারমণের কৃষ্ণ বিরহ সংগীত ‘কারে দেখাবো মনের দুঃখ গো’ আমি বেছে নিয়েছি; রাধারমণের এই গানটিতে প্রেমে বিচ্ছেদ এবং মানসিক যন্ত্রণা অত্যন্ত গভীরভাবে ফুটে উঠেছে। রাধার আকুতি কৃষ্ণের প্রতি, যার প্রতিশ্রুতি ভেঙে গেছে এবং তাকে একাকী রেখে চলে গেছে। ‘কারে দেখাবো মনের দুঃখ’—এই পংক্তির মাধ্যমে বোঝা যায়, অন্তরের দুঃখ প্রকাশের মতো কাউকে খুঁজে না পাওয়ার বেদনা। গানের প্রতিটি পংক্তি প্রিয়জনকে হারানোর বেদনা, সম্পর্কের ভাঙন, এবং ভেতরের দগদগে কষ্টের প্রতিফলন। রাধারমণের সুর ও বাণীতে যে শূন্যতা ও তুষের আগুনের মতো জমে থাকা দুঃখ ফুটে উঠেছে, তা আমাদের মনকেও গভীরভাবে স্পর্শ করে।
রাধারমণের এই গানটি এক অন্তর্গত যন্ত্রণা এবং শূন্যতার প্রতিধ্বনি বহন করে। এটি শুধু একক মানুষের দুঃখ বা ব্যথার কথা নয়, বরং জীবনের অস্পষ্ট আকাঙ্ক্ষাগুলো ও ভাঙনের বেদনার প্রতীক। ‘কারে দেখাবো মনের দুঃখ গো আমি বুক চিরিয়া’—এই লাইনটি যেন রাধার অসহায়তার প্রতিফলন। রাধার কৃষ্ণকে উদ্দেশ্য করে এই আকুতি, এই দুঃখের বহিঃপ্রকাশ আমাদের মনে গভীর এক বেদনার অনুভূতি জাগিয়ে তোলে। কৃষ্ণের অনুপস্থিতিতে রাধার এই বেদনা যেন বহন করছে তুষের আগুন, যা ধিকিধিকি জ্বলছে, কিন্তু কখনো নিভছে না।
এই গানের প্রতিটি স্তবক যেন রাধার অন্তরাত্মার গভীরতম যন্ত্রণার প্রতিফলন। ‘কথা ছিল সঙ্গে নিব, সঙ্গে আমায় নাহি নিলো গো’—এই লাইনটি যেমন প্রতিশ্রুতির ভাঙনের কথা বলে, তেমনই কৃষ্ণের প্রতি রাধার একান্ত ভালোবাসা এবং তার অনুপস্থিতির শূন্যতা তুলে ধরে। কৃষ্ণের কাছ থেকে যে প্রতিশ্রুতি ছিল, তা পূরণ হয়নি। কৃষ্ণ তাকে ছেড়ে চলে গেছেন, কিন্তু রেখে গেছেন সেই শূন্যতা, সেই বেদনাময় একাকীত্ব, যা রাধার মনকে নিঃশেষ করে দিচ্ছে।
রাধা এবং কৃষ্ণের প্রেম কেবল দেহের বন্ধন নয়, এটি এক আধ্যাত্মিক সংযোগ, যা শরীরের বাইরে এক ভিন্ন মাত্রায় অবস্থান করে। কিন্তু কৃষ্ণের চলে যাওয়া রাধার এই আধ্যাত্মিক সংযোগেও শূন্যতা সৃষ্টি করেছে। ‘অন্তরে তুষেরই আগুন জ্বলে রইয়া রইয়া’—এই লাইনগুলোর মাধ্যমে বোঝা যায়, রাধা শুধু শারীরিকভাবে নয়, মানসিক ও আত্মিকভাবে ভেতরে ভেতরে পুড়ে যাচ্ছেন। এই অগ্নি নেভানোর কেউ নেই, এই ব্যথা বুঝবে এমন কেউ নেই।
গানটির প্রতিটি লাইন যেন আমাদের নিজেদের জীবনের দুঃখের প্রতিফলন। জীবনে আমরা অনেক সময় প্রিয়জনের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি পাই, কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি যখন ভেঙে যায়, তখন সেই ভাঙনের শূন্যতাই আমাদের সবচেয়ে বেশি কষ্ট দেয়। রাধারমনের এই গানে সেই ভাঙনের বেদনা অত্যন্ত মর্মস্পর্শীভাবে ফুটে উঠেছে। ‘ভাঙিলো আদরের জোড়া’—এই লাইনটিতে যেন রাধার একান্ত আপন সম্পর্কের ভাঙন প্রকাশ পেয়েছে। কৃষ্ণের সাথে তার যে সম্পর্ক ছিল, তা ভেঙে যাওয়ায় রাধা আর কোথাও স্থিতি পাচ্ছেন না। সেই সম্পর্কের ভাঙন তাকে ধীরে ধীরে ভেতর থেকে পোড়াচ্ছে, আর তার সেই অন্তর্গত ব্যথার কথা কাকে বলবেন, তা খুঁজে পাচ্ছেন না।
রাধারমণের এই গানটি রাধার আত্মিক যাত্রার প্রতীকও বলা চলে। কৃষ্ণের প্রতি তার আকুতি, তার অপেক্ষা, এবং সেই অপেক্ষার পরিণতিতে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে, তা আমাদের জীবনের গভীরতম অনুভূতির সাথে মিল রেখে চলে। ‘কথা ছিল সঙ্গে নিব’—এই লাইনটি যেন সেই প্রতিশ্রুতির কথা বলে, যা কোনো এক সুন্দর ভবিষ্যতের দিকে ইঙ্গিত করেছিল। কিন্তু সেই ভবিষ্যৎ আর বাস্তবায়িত হয়নি। কৃষ্ণ তাকে সঙ্গে নেননি, তাকে একা রেখে গেছেন, আর সেই একাকীত্বের বেদনা যেন অসীম।
এখানে রাধার আকুতি, তার হৃদয়ের গভীরতম জ্বালা, এবং কৃষ্ণের অনুপস্থিতিতে তার প্রতিটি অনুভূতি এমনভাবে ফুটে উঠেছে, যা আমাদেরও মনকে ব্যথিত করে তোলে। আমরা সবাই জীবনে কোনো না কোনো সময় এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হই, যখন আমরা আমাদের মনের গভীর দুঃখ আর কষ্টকে প্রকাশ করতে পারি না। রাধারমনের এই গান আমাদের সেই অভিজ্ঞতার প্রতিফলন।
‘ও ঘর বাধিবো সখীর সনে, কত আশা ছিল মনে গো’—এই লাইনগুলোতে রাধার আশা এবং সেই আশার ভাঙনের কথা বলা হয়েছে। তার সাথে কৃষ্ণের যে সম্পর্ক ছিল, তা ছিল তার জীবনের সবচেয়ে বড় আশা। কৃষ্ণের সাথে একসাথে থাকার যে স্বপ্ন, তা যেন রাধার জীবনের সবকিছু। কিন্তু সেই স্বপ্ন ভেঙে গেছে, সেই আশার ঘর আর তৈরি হয়নি।
রাধা কৃষ্ণকে শুধু একজন প্রেমিক হিসেবেই দেখেননি, তিনি কৃষ্ণকে তার জীবন, তার আত্মার অংশ হিসেবে দেখেছেন। কৃষ্ণের অনুপস্থিতি রাধার জীবনে এক গভীর শূন্যতা সৃষ্টি করেছে। সেই শূন্যতাই এই গানের প্রতিটি পংক্তিতে স্পষ্ট। ‘অন্তরে তুষেরই আগুন জ্বলে রইয়া রইয়া’—এই লাইনের মাধ্যমে বোঝা যায় যে রাধার ভেতরের দুঃখের আগুন ক্রমাগত জ্বলছে, কিন্তু তা বাইরে থেকে কেউ দেখতে পাচ্ছে না। এই দুঃখ, এই কষ্ট যেন রাধার অন্তরের গভীরে জমে থাকা এক নিষ্ফল আগুন, যা তার পুরো অস্তিত্বকে নিঃশেষ করে দিচ্ছে।
রাধার এই আকুতি, তার এই অব্যক্ত যন্ত্রণা, রাধারমনের গানে যে গভীর বেদনার প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে, তা আমাদেরকেও গভীরভাবে স্পর্শ করে।
কারে দেখাবো মনের দুঃখ গো আমি বুক চিরিয়া
অন্তরে তুষেরই আগুন জ্বলে রইয়া রইয়া।
কারে দেখাবো মনের দুঃখ গো আমি বুক চিরিয়া
অন্তরে তুষেরই আগুন জ্বলে রইয়া রইয়া।
কথা ছিল সঙ্গে নিব
সঙ্গে আমায় নাহি নিলো গো।।
কথা ছিল সঙ্গে নিব
সঙ্গে আমায় নাহি নিলো গো
আমারে একলা থুইয়া,
আমারে একলা থুইয়া
রইলো কোথায় গিয়া জ্বলে রইয়া রইয়া।
কারে দেখাবো মনের দুঃখ গো আমি বুক চিরিয়া
অন্তরে তুষেরই আগুন জ্বলে রইয়া রইয়া।
ও ঘর বাধিবো সখীর সনে
কত আশা ছিল মনে গো।
ঘর বাধিবো সখীর সনে
কত আশা ছিল মনে গো।
ভাঙিলো আদরের জোড়া,
ভাঙিলো আদরের জোড়া
কি যে গেলো হইয়া
জ্বলে রইয়া রইয়া।
কারে দেখাবো মনের দুঃখ গো আমি বুক চিরিয়া
অন্তরে তুষেরই আগুন জ্বলে রইয়া রইয়া।
কারে দেখাবো মনের দুঃখ গো আমি বুক চিরিয়া
অন্তরে তুষেরই আগুন জ্বলে রইয়া রইয়া।
অন্তরে তুষেরই আগুন জ্বলে রইয়া রইয়া।
লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী, ছোটকাগজ ‘শব্দপাঠ’ সম্পাদক
সারাবাংলা/এসবিডিই