ডিজিটাল রূপান্তর ও কর্মসংস্থান: কর্মক্ষেত্রে দক্ষতার পরিবর্তন ও সামাজিক বৈষম্যের চ্যালেঞ্জ
২৯ অক্টোবর ২০২৪ ১৫:৩১
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ডিজিটাল রূপান্তরের জোয়ার লক্ষ্য করা যাচ্ছে, যা শিক্ষাব্যবস্থা, ব্যাংকিং ও খুচরা বিক্রয় খাতসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনছে। ইন্টারনেট ও স্মার্টফোনের সহজলভ্যতা এই পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করেছে, যা দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোকেও নতুনভাবে গড়ে তুলছে।
তবে এই পরিবর্তন কর্মসংস্থান, দক্ষতার প্রয়োজনীয়তা এবং সামাজিক বৈষম্যের ক্ষেত্রেও ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। ডিজিটাল প্রযুক্তির উদ্ভাবন যেমন নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলেছে, তেমনি অনেক প্রশ্নও সামনে এসেছে—কেমন হবে ভবিষ্যতের কর্মক্ষেত্র, কী ধরনের দক্ষতার চাহিদা বাড়ছে, এবং কীভাবে নিশ্চিত করা যাবে যে সমাজের সকল অংশই এর সুফল পাবে।
শিক্ষাখাতে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের ব্যবহার বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে এক নতুন ধারায় নিয়ে গেছে, বিশেষ করে কোভিড-১৯ মহামারির পরে। ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্ম, অনলাইন কোর্স এবং ডিজিটাল পরীক্ষার ব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের কাছে সহজলভ্য হয়েছে, যার ফলে শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা উন্নত মানের শিক্ষা উপকরণে প্রবেশাধিকার পাচ্ছে। তবে এখানেও ডিজিটাল বিভাজন একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে।
ইন্টারনেট সংযোগের অপ্রতুলতা, ডিভাইসের অভাব, এবং ডিজিটাল দক্ষতার ঘাটতির কারণে শহুরে এবং উচ্চবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীরা গ্রামীণ ও নিম্নআয়ের শিক্ষার্থীদের চেয়ে অনেক বেশি সুবিধা পাচ্ছে। ফলে, ডিজিটাল শিক্ষা ব্যবস্থার ফলে শিক্ষাক্ষেত্রে সামাজিক বৈষম্য আরো প্রকট হয়ে উঠছে। এই পরিস্থিতিতে শিক্ষকদের ডিজিটাল দক্ষতার প্রয়োজনীয়তাও বাড়ছে এবং তাদের নতুন প্রযুক্তির সাথে মানিয়ে নেওয়ার চাপও বাড়ছে, যা শিক্ষাখাতে কর্মসংস্থানের চাহিদায় নতুন পরিবর্তন আনছে।
বাংলাদেশে ব্যাংকিং খাতেও ডিজিটাল রূপান্তর খুব দ্রুত ঘটছে। মোবাইল ব্যাংকিং, ডিজিটাল ওয়ালেট এবং ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ের বিস্তার ব্যাংকিং ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। বিকাশ, নগদ, ও রকেটের মতো মোবাইল আর্থিক সেবাগুলি জনসাধারণের জন্য আর্থিক লেনদেনকে সহজলভ্য করে তুলেছে, যা দেশের আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে বড় ভূমিকা রাখছে।
তবে ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের এই প্রসারের ফলে ঐতিহ্যবাহী ব্যাংক টেলার বা শাখা পর্যায়ে সেবার চাহিদা কমে যাচ্ছে, এবং গ্রাহকেরা ক্রমশ ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের প্রতি নির্ভরশীল হয়ে উঠছে। এর ফলে, ব্যাংকিং খাতে কর্মীদের জন্য সাইবার নিরাপত্তা, তথ্য বিশ্লেষণ এবং ডিজিটাল প্রযুক্তির ওপর দক্ষতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। ব্যাংকগুলো কর্মীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করছে, তবে যারা এই পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়াতে পারছেন না, তাদের জন্য কর্মসংস্থান ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ছে।
বাংলাদেশের খুচরা বাজারেও ডিজিটাল পরিবর্তনের প্রভাব স্পষ্ট। দারাজ, ইভ্যালি এবং প্রিয়শপের মতো ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মগুলির উত্থান ভোক্তাদের ক্রয়ের ধরন পরিবর্তন করেছে, এবং দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের নতুন বাজারে প্রবেশের সুযোগ করে দিয়েছে।
ই-কমার্সের ফলে লজিস্টিক্স, গ্রাহক সেবা এবং ডিজিটাল মার্কেটিংয়ে কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে। তবে ঐতিহ্যবাহী খুচরা দোকানদারদের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি হয়েছে, যাদের ভূমিকা ক্রমেই অটোমেশন এবং ডিজিটাল লেনদেন দ্বারা প্রতিস্থাপিত হচ্ছে।
প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে কর্মীদের ডিজিটাল স্কিল অর্জন করতে হবে, যা অনেক ছোট দোকানদার এবং কর্মীদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এই পরিস্থিতিতে ডিজিটাল দক্ষতা অর্জন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, যা নগর ও গ্রামাঞ্চলের মধ্যকার বৈষম্যকেও বাড়িয়ে দিচ্ছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতি ক্রমশ ডিজিটাল ভিত্তিক হয়ে উঠছে, যার ফলে কর্মসংস্থানে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটছে। ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার যেমন নতুন কর্মসংস্থান তৈরি করছে, তেমনি অনেক প্রচলিত কাজও বিলুপ্তির পথে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে তথ্য প্রযুক্তি, ডেটা বিশ্লেষণ এবং ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের মতো দক্ষতার চাহিদা বেড়েছে। এই পরিবর্তনের সাথে তাল মেলাতে কর্মীদের পুনঃপ্রশিক্ষণ এবং দক্ষতার উন্নয়ন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। তবে অনেকেই এই প্রশিক্ষণ বা ডিজিটাল শিক্ষা সুবিধা থেকে বঞ্চিত রয়েছেন, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের কম সুবিধাভোগী জনগোষ্ঠী। এই দক্ষতার অভাব একটি বড় বৈষম্যের সৃষ্টি করছে, যা ভবিষ্যতে কর্মসংস্থানের সুযোগ সীমিত করে তুলতে পারে।
ডিজিটাল রূপান্তরের ফলে তৈরি হওয়া এই বৈষম্য কমাতে সরকার এবং বেসরকারি খাত একত্রে কাজ করছে। ডিজিটাল সাক্ষরতা বৃদ্ধি, সাশ্রয়ী ইন্টারনেট ব্যবস্থা, এবং গ্রামীণ এলাকায় অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে এই বৈষম্য দূর করার প্রচেষ্টা চলছে। তবে, এই উদ্যোগগুলিকে আরো বিস্তৃত করতে হবে যাতে ডিজিটাল রূপান্তরের সুফল সমাজের সকল অংশের কাছে পৌঁছে যায় এবং সকলেই নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় অংশগ্রহণ করতে পারে।
সর্বোপরি, ডিজিটাল রূপান্তর বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র নতুনভাবে বিন্যস্ত করছে, যা অনেক সুযোগের দ্বার উন্মোচন করেছে, কিন্তু একই সঙ্গে অনেক চ্যালেঞ্জও নিয়ে এসেছে। শিক্ষা, ব্যাংকিং এবং খুচরা খাতে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার একদিকে দক্ষতার নতুন চাহিদা সৃষ্টি করেছে, অন্যদিকে ঐতিহ্যগত কর্মসংস্থান হ্রাস করেছে।
বাংলাদেশকে এই রূপান্তরকে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং টেকসই পথে পরিচালিত করতে হবে। দক্ষতা উন্নয়ন, সবার জন্য ইন্টারনেট সুবিধা নিশ্চিত করা এবং প্রযুক্তির সমতামূলক ব্যবহার নিশ্চিত করে দেশ একটি শক্তিশালী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ডিজিটাল কর্মক্ষেত্র তৈরি করতে পারে, যা দেশের সকল নাগরিকের জন্য নতুন সুযোগের দ্বার খুলে দেবে।
লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী
সারাবাংলা/এসবিডিই
ড. মতিউর রহমান ডিজিটাল রূপান্তর ও কর্মসংস্থান: কর্মক্ষেত্রে দক্ষতার পরিবর্তন ও সামাজিক বৈষম্যের চ্যালেঞ্জ মত-দ্বিমত