ধানের দেশে ভাতের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন
১৬ নভেম্বর ২০২৪ ১৩:১৮
বাংলার জানা ইতিহাসে ধানের সঙ্গে মানুষের বসবাস আড়াই হাজার বছরের। এ সময়ের মধ্যে ধানের সংস্থানে নির্ভর করে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ঘটনা ঘটেছে বহুবার। কিন্তু আজ পর্যন্ত ধানের দেশে মানুষের ভাতের সংস্থান নিয়ে সেভাবে চিন্তা হয়নি। বাংলাকে বলা হত স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামীণ অর্থনীতির অঞ্চল। প্রত্যেকটা গ্রাম কাজ করেছে স্বতন্ত্র ইউনিট আকারে। সে গ্রামের ভেতরের সব অর্থনৈতিক কাজকর্মের কেন্দ্রে ছিল কৃষি। ভূমি মালিক ধান চাষের জন্য ভূমি বর্গা দিয়েছেন, ভূমিহীন কৃষক তা আবাদ করেছেন। বেনিয়ারা যখন নানা পণ্য বিক্রি করতে আসতেন, তাদের মূল্যও পরিশোধ করা হয়েছে ধানের মাধ্যমে। এভাবে ধানের ওপর একচ্ছত্র নির্ভরতার জন্য জনগোষ্ঠীর এ ফ্রন্ট ছিল অপেক্ষাকৃত সংবেদনশীল। ইতিহাসের ঠিক যখনই বাংলায় ধান উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যাহত হয়েছে, তখনই খাদ্য সংকটে পড়েছে মানুষ। বিগত জুলাই-আগস্টে গণ-অভ্যুত্থানের পর দেশের রাজনৈতিক পটভূমি নতুনভাবে বিন্যস্ত হয়েছে। সামনে আসছে নতুন অনেক ইশতেহার ও সংস্কার প্রস্তাব। নতুন পরিস্থিতিতে দেখা দিয়েছে খাদ্যনিরাপত্তার চিরকালীন প্রসঙ্গ। একটা জনপদের অগ্রগতি ও প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক শর্ত খাদ্যনিরাপত্তার প্রশ্ন সমাধান। ধানের দেশ বাংলার সমৃদ্ধি ও সংকটের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ধান চাষের সাফল্য ও ব্যর্থতা।
২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম (ডব্লিউএফপি) প্রকাশিত প্রতিবেদন তার বড় প্রমাণ। জরিপ বলছে, বাংলাদেশে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে ২০ শতাংশ মানুষ। সিলেট ও বরিশাল অঞ্চলে এ হার সবচেয়ে বেশি, ২৪ শতাংশ। এমনকি দেশের রাজধানী ঢাকায় খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার হার ১৭ শতাংশ। প্রতিবেদনের দাবি, দেশের সাম্প্রতিক বন্যায় কৃষি ও সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর চাপ তৈরি হয়েছে। এর প্রভাবে প্রয়োজনীয় খাদ্যসংস্থান করতে পারছে না প্রতি ১০ জনের তিনজন বা ৩০ শতাংশ। নিম্নআয়ের মানুষের ক্ষেত্রে এ হার প্রায় ৩৬ শতাংশ। খাদ্যব্যয় সংকোচনমূলক ব্যবস্থার মাধ্যমে বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে ২৯ শতাংশ মানুষ। আর সার্বিক জীবন-জীবিকায় ব্যয় সমন্বয়ের মাধ্যমে পরিস্থিতি মোকাবেলা করছে ৭১ শতাংশ মানুষ। নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে প্রয়োজনের চেয়ে কম খাদ্য গ্রহণ করছে দেশের ৩০ শতাংশ মানুষ। খাদ্যের এ নিরাপত্তার প্রশ্নটি দিন শেষে ভাতের নিরাপত্তার প্রশ্ন। কারণ দেশের যে অংশটি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে, তাদের প্রধান খাদ্যই ভাত। দেশের আট বিভাগের ১ হাজার ২০০ মানুষের ওপর পরিচালিত জরিপের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে ডব্লিউএফপি। তাতে যেন বঙ্গীয় জনপদের ইতিহাসে চিরকাল ধরে থাকা সংকটটিই আরেকবার চিহ্নিত হয়েছে।
গত ৪০ বছর খাদ্য উৎপাদনে অভাবনীয় সাফল্য অর্জিত হলেও চরম জলবায়ু ঝুঁকিতে থাকা দেশটির আগামীর খাদ্য নিরাপত্তা অনেক চ্যালেঞ্জের মুখে। বর্তমান ফসলি জমি ৭ দশমিক ২৯ মিলিয়ন হেক্টর হলেও খাদ্য নিরাপত্তার পরিকল্পনা করতে হবে ৬ দশমিক ৫ মিলিয়ন হেক্টর জমি নিয়ে। আগামীর খাদ্য নিরাপত্তায় ‘রাইস সিকিউরিটি’ ইস্যুটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। ২০৫০ সালে বাংলাদেশে ৪৫ মিলিয়ন টন চাল উৎপাদন করতে হবে। তাই খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে সংশয় সভ্যতার শুরু থেকেই। এত জমি, এত পানি, এত প্রযুক্তির পরও ক্ষুধা ও দারিদ্র্য বিশ্বে এখনও বড় সমস্যা। পরিবর্তিত বিশ্বপরিস্থিতি, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা, বিশ্বায়ন, পুঁজিবাদের সর্বব্যাপী প্রভাব আর বৈশ্বিক বাণিজ্য নৈরাজ্য খাদ্য নিরাপত্তাকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করছে। বিশ্বায়ন ও পুঁজিবাদের বর্ণিল হাতছানিতে মানুষ যখন শুধুই মুনাফা খোঁজে, তখনও লাভ-লোকসানের হিসাব না করে কৃষক উন্নয়নের মহাকাব্য রচনা করে যায় তার ঘাম-শ্রম ঢেলে দিয়ে। ছোট্ট এক টুকরো জমি থেকে অধিক ফসল ফলাতে ওরা ঢেলে দেয় জীবনের নির্যাস, শরীরের নোনাজল, ভক্তি আর ভালোবাসা।
বিভিন্ন গবেষণা পেপার, মডেল ও বিশ্লেষণ ধান চাষের আওতায় জমি ও মোট উৎপাদন কমে যাওয়ার পূর্বাভাস দিচ্ছে। এ ছাড়া গত দুই দশক ধান চাষির সীমাহীন বঞ্চনার কারণে তারা বেরিয়ে আসছেন ধান চাষ থেকে। শুকনো মৌসুমে নদীর পানি প্রবাহ হ্রাস, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়া, উপকূলে লবণাক্ততা, হাওরে আকস্মিক বন্যা ও উত্তরে খরার কারণে চালের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হতে পারে। ডাল, তৈলবীজ ফসল, ভুট্টা, আলু, শাকসবজি, ফল-ফুল ও মসলা জাতীয় ফসলের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটানোও বড় চ্যালেঞ্জ। উপাত্ত বলছে ১৯৭২-৭৩ সালে দেশে মোট খাদ্যশস্যের উৎপাদন ছিল ১ কোটি ১০ লাখ টন যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪ কোটি ৬৫ লাখ টনে। এ সময় খাদ্যশস্যের উৎপাদনে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে প্রায় ৩ শতাংশ হারে, এতে উদ্বৃত্ত থাকার কথা অনেক খাদ্যশস্যের। কিন্তু প্রকৃত অবস্থা অন্যরকম। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্যানুসারে পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ বছরে গড়ে ১৪৯.৮ কেজি খাদ্যশস্য গ্রহণ করে থাকে এবং বাংলাদেশে যদি তার পরিমাণ ১৮২.৫ কেজি ধরা হয় এবং শতকরা ২৫ ভাগ বীজ, পশুখাদ্য ও অপচয় ধরা হয়, তাহলে মোট খাদ্য চাহিদা দাঁড়ায় সর্বোচ্চ ৩ কোটি ৬০ লাখ টন। এর চেয়ে অনেক বেশি চাল ও মোট খাদ্যশস্য প্রতিবছর আমরা উৎপাদন করছি, তার পরও কমবেশি প্রায় ১ কোটি টন চাল, গম ও ভুট্টা প্রতিবছর আমদানি করতে হচ্ছে যা ক্রমাগতই বেড়ে যাচ্ছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে চাল ও গম আমদানি হয়েছে ৬৭.০২ লাখ মেট্টিক টন আর ভুট্ট ২৪ লাখ মেট্টিক টন। এখানে উল্লেখ্য যে, গত ১৩ বছরে কৃষি খাতে উৎপাদন বেড়েছে গড়ে প্রায় ৪ শতাংশ হারে তা সত্ত্বেও কৃষিপণ্যের আমদানি হ্রাস হয়নি। চাল আমদানিতে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে দ্বিতীয়, আমদানিতে ৫০ শতাংশ, তেলের প্রায় ৯০ শতাংশ, চিনির ক্ষেত্রে প্রায় পুরোটাই আমদানি নির্ভর। আমাদের কৃষিজাত নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি নির্ভরতা যখন এত বেশি, তখন বৈশ্বিক মূল্য অস্থিরতা ও ঘাটতি অভ্যন্তরীণ বাজারে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। পর্যাপ্ত উৎপাদন বৃদ্ধি এবং অভ্যন্তরীণ স্বয়ম্ভরতা অর্জন করা ছাড়া এ সংকট এড়ানোর কোনও বিকল্প নেই।
খাদ্যের লভ্যতা খাদ্যনিরাপত্তার জন্য যথেষ্ট নয়, দরকার খাদ্য কেনার সামর্থ্য। প্রায় দুই বছর ধরে করোনা মহামারীর কারণে গরিবমানুষের সংখ্যা বেড়েছে। কারণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়, দেশে কর্মসংস্থানে মূল ভূমিকা পালনকারী বেসরকারি খাতে চাকরিচ্যুতি, বেতন বা মজুরি হ্রাস, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারনে মূল্যস্ফীতি এবং অন্যান্য কারণে মানুষের আয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস পেয়েছে। আবার আভাস পাওয়া যাচ্ছে সামনের বছর গুলোতে বৈশ্বীক খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে যা বাংলাদেশ সরকার অবগত আছেন বিশেষ করে চাল ও আটার দাম বাড়ায় সাধারণ মানুষের কষ্ট সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। এ অবস্থায় কৃষি উৎপাদন বাড়াতে সর্বোচ্চ জোর দিয়েছে সরকার। এরই মধ্যে সরকার কৃষি উৎপাদন বাড়িয়ে খাদ্য নিরাপত্তা জোরদার ও শক্তিশালী করার উদ্যোগ নিয়েছে। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য মানুষের মৌলিক চাহিদা। এর মধ্যে খাদ্য একটি প্রধান ও অন্যতম মৌলিক চাহিদা। জীবনধারণের জন্য খাদ্যের কোনও বিকল্প নেই। সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রত্যেকটি মানুষের প্রয়োজন বিশুদ্ধ ও পুষ্টিকর খাদ্য। আর এ বিশুদ্ধ খাদ্যই যদি অখাদ্যে রূপান্তরিত হয়, তা গ্রহণের পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ।
২০১৫ সালে গঠন করা হয়েছে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ। কৃষকরা এত বেশি খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় কেন ভুগছেন, এ প্রশ্নে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অর্থনীতি ও গ্রামীণ সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন কৃষি অর্থনীতি বিভাগের প্রফেসর ড. মো. তাজ উদ্দিন বলেন কৃষকরা খাদ্য সরবরাহ করেন। বিশেষ করে এখন যে উচ্চমূল্যের কৃষিপণ্য এসেছে তারা সেগুলো উৎপাদন করে বিক্রি করে ফেলেন। তারা নিজের খাবারের জন্য যা রাখেন সেগুলো খুবই সামান্য, অপুষ্টিকর। কাজেই খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা তাদেরই বেশি হবে। যেমন তারা দুধ বিক্রি করে ফেলেন, নিজের জন্য রাখেন না। দুধ পুষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় খাবার হওয়া সত্ত্বেও নিজের জন্য রাখেন না। তারা দুধ বিক্রি করে খাদ্য, কাপড়সহ অন্য কিছু কেনেন। তিনি বলেন, কৃষির ওপর নির্ভরশীল মানুষের আয় কম। সে হিসেবে তারা মাছ-মাংস কিনে খেতে পারেন না। তারা যেসব শাকসবজি খায় সেগুলো একেবারেই নিম্নমানের, সব বিক্রি করার পর যা থাকে। এটি তো স্বাস্থের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। তারা খাদ্য সরবরাহ করলেও পুষ্টি নিয়ে তাদের শিক্ষা কম। সেজন্য তাদের খাদ্য নিরপত্তাহীনতা বেশি।
কৃষকদের খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা মোট কৃষি উৎপাদনের ওপর প্রভাব ফেলবে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এর প্রভাব কৃষকদের একটি অংশের ওপর তো পড়বেই। এজন্য তাদের খাদ্য নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে। দেশের কৃষি উৎপাদন বাড়লেও কৃষকরা খুব কমই উপকৃত হচ্ছেন। জাতিসংঘের এসডিজি লক্ষ্যগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল ২০৩০ সালের মধ্যে ক্ষুধামুক্ত পৃথিবী। ২০১৫ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচক স্কোর কমেছে ৭ দশমিক ২ পয়েন্ট (২৬ দশমিক ২ থেকে ১৯)। বাংলাদেশের অবস্থান ১২৫টি দেশের মধ্যে ৮১তম। বাংলাদেশ এখন মধ্যম স্কোরের দেশ। ভারত (২৮ দশমিক ৭), পাকিস্তান (২৬ দশমিক ৬) ও আফগানিস্তানের (৩০ দশমিক ৬) চেয়ে বাংলাদেশের অগ্রগতি ভালো। বাংলাদেশের নিম্ন স্কোরের (৯ দশমিক ৯) দেশ হতে হলে এখনও ১০ পয়েন্ট স্কোর কমাতে হবে। জলবায়ু ঝুঁকি ও ক্রমহ্রাসমান আবাদি জমির মতো বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে ২০৩০ সালের মধ্যে এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সহজ নয়।
লেখক: গবেষক ও অর্থনীতিবিদ
সারাবাংলা/এসবিডিই