দেশীয় উদ্যোক্তাদের সামাজিক ব্যবসা আইএসপি
১৭ নভেম্বর ২০২৪ ১৫:০২
২০১১ সালের ৩ জুন। ইন্টারনেটকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয় জাতিসংঘের হিউম্যান রাইটস কাউন্সিল। অবশ্য এই ঘোষণার আগেই এস্তোনিয়া, ফ্রান্স, ফিনল্যান্ড আর কোস্টারিকা ইন্টারনেট ব্যবহারকে মৌলিক অধিকার ঘোষণা করে নিজেদের সংসদে আইনও পাস করে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশেও ইন্টারনেটকে মৌলিক অধিকার স্বীকৃতির পক্ষে জোরালো দাবি উঠেছে। পতিত সরকারের মন্ত্রী থেকে বর্তমান উপদেষ্টাদের কণ্ঠেও মানুষের সেই দাবি আমরা প্রতিধ্বনিত হতে শুনছি।
যদিও চলতি বছরের ১৮–২৮ জুলাই নজির বিহীন ইন্টারনেট ব্লাকআউটের ফ্যাসিবাদি অভিজ্ঞতা মৌলক অধিকার লঙ্ঘনের সব সীমাকে ছাড়িয়ে যায়। এরপর অন্তবর্তীকালীন সরকারের সময়ে আলোচনার কেন্দ্রভাগেই বিষয়টি লাল তালিকায় জায়গা পায়। ইন্টারনেট যেনো কোনো অবস্থাতেই বিচ্ছিন্ন না হয় এবং সবার হাতের নাগালে থাকে সেজন্য আইন করার প্রস্তাবও এসেছে ইতিমধ্যে।
এমন পরিস্থিতিতে দেশের ইন্টারনেট সেবা খাতটি জাতীয় কবির ‘ফল বহিয়াছ, পাওনিক রস, হায় রে ফলের ঝুড়ি, লক্ষ বছর ঝর্ণায় ডুবে রস পায় নাকো নুড়ি।’ লাইনের মতোই লাইন অব ফায়ারে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। কেননা, মৌলিক এই সেবা খাতটি ‘দেশীয় উদ্যোক্তাদের সামাজিক ব্যবসায়’ হয়েও ক্ষতিকর তামাকজাত পণ্যের বিবেচনার পথে চলতে শুরু করেছে। ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার্স বা আইএসপি প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর চেপে বসছে ‘লাইসেন্স আপগ্রেডেশন বন্ধ’ রাখার যাঁতাকল এবং ‘রেভিনিউ শেয়ার’ও অতিরিক্ত ‘এসওএফ’ ।
যেভাবে সামাজিক ব্যবসায় মডেলে আইএসপি সেবা মুনাফার পরিবর্তে মানবকল্যাণ —বিশেষ করে বিরাজমান দারিদ্র ও আয়বৈষম্য দূর করতে আপাদমস্তক কাজ করছে দেশের আইএসপি খাত। ইতিমধ্যেই দেশের কুটির, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তার ইন্টারনেট সেবাকে সামাজিক ব্যবসা হিসাবে নিজের অবস্থান করে নিয়েছে। কেনো না এখনো ইন্টারনেট সেবাকে ব্যান্ডউইথ কিনে বাসায় কানেকশন দেয়ার মতো সরল ব্যবসায় ধারণা করা হয়। তবে ইন্টারনেট ব্যবসায় মোটেই বাতাস বিক্রির মতো কোনো সাধারণ বিষয় নয়। ইন্টারনেট শুধু সংযোগ নয়। ইন্টারনেট একটি ডিজিটাল সেবার ইকোসিস্টেম। এই ইকো সিস্টেমে ধাপে ধাপে ভ্যাল্যু অ্যাড হয়ে সৃষ্টি করে নতুন কর্মসংস্থান, সহজ করে কাজের প্রক্রিয়া; সব নাগরিককে ক্ষমতায়নের সুযোগ করে দিয়ে ঘুচে দেয় দারিদ্রের অভিশাপ। কিন্তু খালি চোখে এর খরচগুলো দৃশ্যমান হয় না।
অথচ গত তিন বছর ধরে ‘এক দেশ এক রেট’ বাস্তবায়ন নাগরিকের দোরগোড়ায় ইন্টারনেট সেবা পৌঁছে দিয়ে এরই মধ্যে বিশ্বে নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে দেশের ২৭০০ আইএসপি সেবা দাতারা। এছাড়াও ৩-শূন্য তত্ত্বের যে সামাজিক আন্দোলনের মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা বিশ্বব্যাপী সূচনা করেছেন -এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বাংলাদেশের আইএসপি ব্যবসায়ীরা। কেননা, কাজের পরিধি ও ব্যাপ্তিতে প্রান্তিক পর্যায়ে শূন্য বেকারত্ব সৃষ্টিতে অবদান, গ্রিন টেকনোলজি নির্ভর রাউটার, সুইচ ব্যবহারের মাধ্যমে শূন্য কার্বন নির্গমে এগিয়ে থাকা এবং অ্যাক্টিভ শেয়ারিং করে কমন ইনফ্রাস্ট্রাকচার ব্যবহার করে থাকে এই খাতের উদ্যোক্তারা।
আইএসপির সামাজিক ব্যবসায় মডেলের ফলাফল
১) এখন পর্যন্ত নানা লাইসেন্সেরে ঘোরটোপ পেরিয়ে দেশে যেভাবে লাস্টমাইলে ইন্টারনেট সেবা দেয়া হচ্ছে তা ব্যক্তিগত মুনাফাবিহীন কল্যাণকর ব্যবসা মডেলে চলছে।
২) ব্যবসায়টি অধিক কর্মী নির্ভর হওয়ায় সাধারণত স্বল্প থেকে উচ্চ শিক্ষিত পর্যায়ে নির্বিশেষে বেকারত্ব ঘুচে দিয়ে সবার অর্থনৈতিক সক্ষমতা অর্জনে ভূমিকা রাখছে। বস্তুত এখানে যারা কাজ করেন তাদের ভালো কাজের পরিবেশ ও চলমান বাজার অনুযায়ী বেতন-ভাতা দেয়া হয়। ফলে যুব সমাজের একটি বড় অংশ এই আইএসপি’র মতো সামাজিক ব্যবসায়ে জড়িয়ে পড়েছেন। অপরদিকে, বেকারত্ব কিংবা হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে বিভিন্ন অপরাধ সহ নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়তো।
৩) আইএসপি ব্যবসাটি সম্পূর্ণ দেশীয় বিনিয়োগে পরিচালিত এবং মূলধন সুরক্ষাতে ১০ থেকে ১৫ বছর সময় লেগে যায়। পরিচালন ব্যয় আয়ের সমান, ক্ষেত্র বিশেষে অধিক হয়। ফলে দীর্ঘ যাত্রায় বিনিয়োগকারীরা শুধু তাদের বিনিয়োগকৃত অর্থই ফেরত পান। কার্যত এর বাইরে কোনো প্রকার লভ্যাংশের দেখা পাওয়া দুস্কর।
৪) লাস্ট মাইলে পর্যাপ্ত এনটিটিএন না থাকায় প্রতিদিনই ক্যাবল কাটা পড়ে। সেই বিচ্ছিন্ন সংযোগ নতুন করে স্থাপন করে শেষ ধাপের বা চূড়ান্ত সেবা দাতা হিসেবে আইএসপিরা সিস্টেম লসের শিকার হন। অর্থাৎ বিনিয়োগকৃত অর্থ ফেরত নেওয়ার পর বিনিয়োগকৃত অর্থের মুনাফা কোম্পানির সম্প্রসারণ কাজেই তাদেরকে খরচ করতে হয়।
৫) স্থানীয় পেশী শক্তি মোকাবেলা করতে গিয়ে প্রতিনিয়ত জানমালের ঝুঁকি, জোরপূর্বক নেটওয়ার্ক দখল রোধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যকর ভূমিকার অভাব ইত্যাদি সত্ত্বেও সামাজিক ব্যবসা হিসেবে আনন্দের সঙ্গে ব্যবসায় পরিচালনায় নিয়োজিত রয়েছেন এই খাতের উদ্যোক্তারা। ফলে অতিমারিতে, ঝর-ঝঞ্ঝা, জলোচ্ছ্বাস; অর্থাৎ মুনষ্য ও প্রকৃতিক দুর্যোগে দমে না গিয়ে বরং সামনের কাতারে থেকেছে এই খাতের যোদ্ধারা।
এই ইন্টারেনট সেবাদাতাদের বদৌলতেই সরকারি সেবার পাশাপাশি শিক্ষা, দক্ষতা উন্নয়ন , টেলি-হেলথ, ই-কমার্স এর সুপার হাইওয়েতে চলতে পারছে দেশ। অথচ এই খাতের হাজার হাজার উদ্যোক্তা এবং তাদের উপর নির্ভরশীল কর্মচারীদের উপেক্ষা করে গুটিকয়েক কোম্পানিকে মনোপলি ব্যবসা করার সুযোগ করে দেয় বিগত সরকার। সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের পক্ষে অবস্থান নিয়ে আইজিডাব্লিউ অপারেটরদের অবৈধ আইওএফ প্রতিষ্ঠা, কিংবা অতিমাত্রায় লাভের আশায় মোবাইল অপারেটররা অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসার মাধ্যমে কল টার্মিনেশন এবং সাজা প্রাপ্ত হওয়ার উদাহরণও অতীতে আমাদের সামনে বিদ্যমান। একইভাবে আইএসপি কর্তৃক খুবই জনপ্রিয় IPTV/OTT পরিষেবাকে বন্ধ করার সব রকমের নীল নকশা বাস্তবায়ন করা হয়; যেখানে জনগণ বিদেশি OTT যেমন Netflix, Amazon Prime, YouTube TV অবাধে দেখতে পারছে। অপরদিকে দেশীয় উদ্যোক্তাদের আইপি টিভি এবং ওটিটি প্ল্যাটফর্ম তৈরিতে পদে পদে বাধা সৃষ্টি করা হয়েছে শুধুমাত্র একটি সিন্ডিকেটের হাতে এই ব্যবসাটি তুলে দেওয়ার জন্য। এটা ভুললে চলবে না যে, আইএসপিরা ছোট ব্যবসায়ী হলেও সমষ্টিগতভাবে তারা সব থেকে বড়। লাস্ট মাইল কানেক্টিভিটি শুধুমাত্র আইএসপি-দেরই এখতিয়ার। বিশ্বের উন্নত দেশে আইএসপিরা 4G/5G ফ্রিকোয়েন্সি এলোকেশন নিয়ে ব্রডব্যান্ড এর পাশাপাশি ওয়ারলেস ইন্টারনেট সেবাও দিয়ে থাকে। কিন্তু, আমাদের দেশে এই ধরনের সুযোগ রহিত করে রাখা হয়েছে। এতে করে আইএসপিরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। এই সুযোগ ব্যবহার করে মোবাইল অপারেটররা ফিক্সড ব্রডব্যান্ড এরিয়াতে এখতিয়ার বহির্ভূত ব্যবসা করছে।
এমন যদি হতো…
প্রধান উপদেষ্টা ডক্টর মোহাম্মদ ইউনুস ১৯৯৬ সালে গ্রামীণফোন প্রতিষ্ঠা করে নারীর ক্ষমতায়নের মাধ্যমে বিশ্ববাসীর কাছে প্রথম বাংলাদেশকে চিনিয়ে দেন যেটা একটা সামাজিক আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়েছিল। সেই স্বপ্নের ধারাবাহিকতায় বহু ছোট ছোট উদ্যোক্তা সারাদেশে গ্রামেগঞ্জে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ব্যবসায় নেমে পড়ে। আজকের দিনে দেশের অগ্রগতিতে অবশ্যই এই যোদ্ধারা জিডিপিতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অবদান রাখছে। শুধুমাত্র সরকারের ভুল নীতি এবং কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর কূটচালে আন্তর্জাতিক বড় বড় সিডিএম প্রোভাইডাররা যেমন google, facebook, akamai নিজস্ব ডাটা সেন্টার স্থাপন করতে চায়নি। অথচ এই সার্ভিসই আমরা পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে ইমপোর্ট করে আনছি প্রতিবছর ৭০ মিলিয়ন ডলার এর অধিক খরচ করে। নীতি সহায়তা বাদ রেখে বিগত সরকার আইএসপি গুলোর উপরে SOF চাপিয়ে দিয়েছে। টেলিকম ইন্ডাস্ট্রিতে এটা একটি কালো অধ্যায় এবং ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট প্রসারের পথে ষড়যন্ত্রের অংশ বলেই মনে করেন বাজার বিশ্লেষকেরা। আমাদের প্রত্যাশা, অভিভাবক সংস্থা বিটিআরসি বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে যৌক্তিকভাবে ছাত্র-জনতা অভ্যুত্থনের সুফল ঘরে ঘরে পৌঁছে দেবেন। একইসঙ্গে বিষয়টি মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা ডঃ মোঃ ইউনূস সবিনয় দৃষ্টি দেবেন বলেই আমাদের বিশ্বাস।
আমরা মনে করি, শান্তিতে নোবেলজয়ী প্রধান উপদেষ্টার বৈশ্বিক যোগাযোগ এবং বলিষ্ঠ নেতৃত্ব গুণে অতিসত্বর ফেসবুক এবং গুগলের ডাটা সেন্টার বাংলাদেশের মাটিতেই স্থাপিত হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রয়োজনীয় মুদ্রা নীতি সংস্কার করে PayPal কে বাংলাদেশে উন্মুক্ত করে ফ্রিল্যান্সিং এবং আউটসোর্সিং এর মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রার ইনবাউন্ড প্রবাহ ত্বরান্বিত করবে। সর্বোপরি আইএসপিরা যেহেতু সমাজ উন্নয়ন এবং দারিদ্র দূরীকরণে অনুঘটক হয়ে কাজ করে যাচ্ছে; ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ব্যবসাকে সহসাই একটি সামাজিক ব্যবসা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে আইএসপি শিল্পের বিকাশে নীতি সহায়তা, এবং ক্ষেত্র ভেদে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ঋণ এই ব্যবসায় জড়িত উদ্যোক্তাদের জন্য এনজিও এবং সিডিউল ব্যাংক কতৃক সহজ কিস্তিতে ঋণ ব্যবস্থা করা হোক। পরিশেষে, যেহেতু আইএসপি একটি সামাজিক ব্যবসা; তাই এটি করের আওতামুক্ত রেখে সহজ পরিচালন, নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের সুযোগ করে দেবে। কেননা শ্রমঘন এই খাতের কর্মীদের বেতন, বোনাস, প্রশিক্ষণ খরচ, স্বাস্থ্য বীমাসহ অন্যান্য সহায়তা দানে সম্পূর্ণ ব্যয় হয়। তাই, আইএসপি লাইসেন্সধারী দেশীয় কোম্পানির ক্ষেত্রে প্রথম ১০ বছর সরকার প্রদত্ত সকল প্রকার কর এবং রেভিনিউ শেয়ারিং এর আওতার বাইরে থাকা আবশ্যক। আর এটা করা হলে আগামী তিন বছরের মধ্যে প্রতিটি ঘরে ঘরে সিঙ্গাপুরের মত ৫০০ এমবিপিএস ইন্টারনেট সেবা দিতে সক্ষম হবে আইএসপি উদ্যোক্তারা। এটাই একমাত্র পথ ইন্টারনেটের গ্লোবাল ইনডেক্সে বাংলাদেশকে উন্নত দেশের কাতারে মর্যাদার সূচকে এগিয়ে আনার।
লেখক: উদ্যোক্তা, প্রযুক্তিবিদ এবং সাবেক সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট, আইএসপিএবি
সারাবাংলা/এএসজি
আইএসপি ইন্টারনেট ইন্টারনেট সেবা দেশীয় উদ্যোক্তা মত-দ্বিমত সাইফুল ইসলাম সিদ্দিক