জলবায়ু অর্থায়ন ছাড়া ফি বছর কপ সম্মেলনের যৌক্তিকতা কী?
১৭ নভেম্বর ২০২৪ ১৫:১৩
বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন (কপ–২৯) নভেম্বর ১১-২২, ২০২৪ তারিখে আজারবাইজানের বাকুতে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। প্রতিবছরের মতো এবার ও বাংলাদেশের একটি প্রতিনিধিদল তাতে যোগ দিয়েছেন যেখানে সরকারের প্রধান উপদেষ্টাও রয়েছেন। এর মধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে প্রতি বছর এই ব্যয়বহুল সম্মেলন আয়োজনের প্রয়োজনীয়তা কি? কারন কপ-২৯ এর সাফল্য নির্ভর করবে জলবায়ু অর্থায়নে তথা আর্থিকসহায়তার লক্ষ্যে একমত হলে যার আভাস এখন পর্যন্ত কোনওদিক থেকে পাওয়া যাচ্ছে না। দ্রুত পরিবর্তনশীল জলবায়ু মোকাবেলায় উন্নয়নশীল দেশগুলোকেসহায়তা করতে ধনী দেশ প্রতি বছর কমপক্ষে ১ ট্রিলিয়ন ডলার সরবরাহ করে আর্থিক লক্ষ্যমাত্রার বিষয়ে একমত হতে পারে কিনা তার উপর এই বছরের জলবায়ু সম্মেলনের সাফল্য নির্ভর করে। কিন্তু প্রশ্ন হলো এই সম্মেলনস্থলে এবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারতের মত দেশগুলোর সরকার/রাষ্ট্র প্রধানগন কেন অনুপস্থিত? কেন প্রশ্ন উঠছে এই অকার্যকর সম্মেলন ফি বছরে করার কি দরকার যা এই অয়োজনেরসহায়ক বার্তা বহন করে না।
এ বছরের সম্মেলনের বিশেষজ্ঞদের স্বাধীন প্যানেলের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে দেশগুলোকে প্রতি বছর ৬ ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়োগ করতে হবে, অন্যথায় ভবিষ্যতে আরও বেশি অর্থ প্রদানের ঝুঁকি নিতে হবে। এসব নিয়ে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে চলতি বছর আর্জেন্টিনা তাদের প্রতিনিধি দল প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়। আর আলোচনায় তেল, গ্যাস ও কয়লার স্বার্থের উপস্থিতিও দীর্ঘদিন ধরে বিতর্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এদিকে, ‘কিক দ্য বিগ পলিউটার্স আউট (কেবিপিও)’ জোটের কর্মীরা বলেন, জাপান তার প্রতিনিধি দলের অংশ হিসাবে কয়লা জায়ান্ট সুমিতোমোর কর্মচারীদের নিয়ে এসেছিল, কানাডায় তেল উৎপাদক সানকোর এবং ট্যুরমালাইন অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং ইতালি শক্তি জায়ান্ট এনি এবং এনেলের কর্মচারীদের নিয়ে এসেছিল। শীর্ষস্থানীয় একদল জলবায়ু কর্মী সতর্কতাবাণী করে বলেন, ‘বৈশ্বিক জলবায়ু প্রক্রিয়া দখল হয়ে গেছে এবং এটি আর উদ্দেশ্য পূরণের উপযোগী নয়।’ তারা আরও বলেন, জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুন, জাতিসংঘের সাবেক জলবায়ু বিষয়ক প্রধান ক্রিস্টিনা ফিগুয়েরেস এবং শীর্ষস্থানীয় জলবায়ু বিজ্ঞানীরা স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে জলবায়ু আলোচনায় জরুরি ভিত্তিতে পরিবর্তন আনার আহ্বান জানানো হয়েছে।
বান কি মুন জলবায়ু সম্মেলনে যেসব অগ্রাধিকার জরুরি বলে মনে করেছেন তার একটি হলো, জলবায়ু অর্থায়ন লক্ষ্য নির্ধারণ করন। তিনি বলেন আমরা যখন বাকুতে কপ-২৯ নিয়ে কথা তুলছি, তখন বিশ্বনেতারা একটি নতুন জলবায়ু অর্থায়ন লক্ষ্য নির্ধারণ করতে চলেছেন। এতে দরিদ্র দেশগুলোর গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমাতে এবং জলবায়ু সংকটের প্রভাবের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে সাহায্য করার জন্য অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে। তাদের আলোচনার সময় আবহাওয়া পরিস্থিতি ক্রমবর্ধমানভাবে তীব্র হচ্ছিল। কেবল এই বছরেই আমরা উত্তর আফ্রিকা, মেক্সিকো, ভারত ও সৌদি আরবজুড়ে মারাত্মক তাপপ্রবাহ দেখেছি। দক্ষিণ আফ্রিকাজুড়ে একটি ঐতিহাসিক খরা; ব্রাজিলের প্যান্টানাল জলাভূমিতে বিপর্যয়কর দাবানল; ক্যারিবিয়ান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রেকর্ড ভঙ্গকারী হারিকেন এবং আরও অনেক কিছু। জলবায়ু পরিস্থিতি একদিকে কোনও সীমানা মানে না, একইভাবে কাউকে ছাড়ও দেয় না। এসব ঘটনা জলবায়ু সংকটে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ সম্প্রদায়গুলোকে রক্ষা করার জন্য বিশ্বনেতাদের এবং আমাদের সবার জন্য প্রয়োজনীয়তার স্পষ্ট অনুস্মারক হিসেবে কাজ করে। অনেক উন্নয়নশীল দেশের জন্য, বিশেষ করে আফ্রিকায় জলবায়ুর প্রভাবজনিত খরচ বিষ্ময়কর। আফ্রিকার দেশগুলো জলবায়ুর চরম রূপ নেওয়ার কারণে জিডিপির ৫ শতাংশ পর্যন্ত হারাচ্ছে। এ অঞ্চলের অনেক দেশ এই বিপর্যয় থেকে বাঁচতে তাদের জাতীয় বাজেটের ৯ শতাংশ পর্যন্ত বরাদ্দ দিচ্ছে।
ওয়ার্ল্ড মেটোরোলজিক্যাল অর্গানাইজেশনের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুসারে, সাহারা অঞ্চলে শুধু আফ্রিকার দক্ষিণে অকল্পনীয় জলবায়ু-সম্পর্কিত বিপর্যয়ের মুখোমুখি সম্প্রদায়গুলোকে রক্ষার জন্য আগামী দশকে বার্ষিক ৩০ বিলিয়ন থেকে ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রয়োজন হবে। জলবায়ু সংকট মোকাবিলা এড়িয়ে গিয়ে আমরা দারিদ্র্য হ্রাস, ক্ষুধা দূর এবং একটি সমৃদ্ধ ও স্থিতিস্থাপক বিশ্ব সম্প্রদায় গড়ে তুলতে পারব না। অবশ্য এখনও এ পরিমাণ অর্থের বরাদ্দ আমাদের জন্য বোঝা।
অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের তথ্যমতে, ২০২১ সালে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে প্রায় ৮৯.৬ বিলিয়ন ডলার প্রদান করা হয়েছিল। তবুও বৈশ্বিক জলবায়ু-সংক্রান্ত অর্থায়নে বিপর্যয় কমিয়ে আনতে বিভিন্ন মাত্রায় মনোযোগের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। জলবায়ু সংকটের প্রভাবে প্রস্তুতি গ্রহণ ও টিকে থাকতে সক্ষম করে গড়ে তোলার জন্য দেশগুলোকে সমর্থন করার পরিবর্তে নির্গমন হ্রাসে অর্থায়নের প্রায় ৯০ শতাংশ ব্যয় করা হয়। এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ সামনে নিয়ে আসে; বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে- যেগুলো ইতোমধ্যে ঋণের যন্ত্রণায় পঙ্গু। অর্থায়নের ক্ষেত্রে সংকট কমিয়ে আনা ও পরিস্থিতি খাপ খাওয়ানোর ব্যয়ের উভয় ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত তহবিল বরাদ্দ দিয়ে ভারসাম্য নিশ্চিত করতে হবে। সফলতা পেতে পরিবর্তন আনার মানে চ্যালেঞ্জের পরিমাণের সঙ্গে মোকাবিলা করতে জনসাধারণের জন্য তহবিল বাড়িয়ে দেওয়া। এটি অবশ্যই কপ-২৯ এ আলোচিত নতুন যৌথ পরিমাপকৃত লক্ষ্যের (এনসিকিউজি) একটি মূল উপাদান হতে হবে, যেখানে সমান অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে মোকাবিলার জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ পৃথক বলে স্বীকৃতি পাবে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগ মোকাবিলা করতে বরাদ্দকৃত অর্থ বাড়ালে ইতোমধ্যে জলবায়ু সংকটের বিধ্বংসী প্রভাবের সম্মুখীন হওয়া সম্প্রদায়গুলো রক্ষা করার জন্য সম্পদের ন্যায্য বণ্টন নিশ্চিত হবে।
কপ-২৯ এ মোকাবিলা অর্থায়নের ওপর গুরুত্ব দেওয়া অবশ্যই সাহসী ও রূপান্তরমূলক হতে হবে। ক্রমবর্ধমান পরিবর্তনের বিপদ অনেক বেশি। বিপর্যয় মোকাবিলায় কপ-২৯ প্রেসিডেন্সির মন্ত্রী নিয়োগ (আয়ারল্যান্ড ও কোস্টারিকা থেকে) এনসিকিউজি আলোচনার মধ্যে মোকাবিলাকে গুরুত্ব দেওয়ার একটি ইতিবাচক সংকেত, যিনি অনুষ্ঠানের আগ পর্যন্ত পরামর্শ ও দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় নেতৃত্ব দেবেন।
কপ-২৯ এ নেতাদের অবশ্যই পাবলিক অ্যাডাপ্টেশন ফাইন্যান্স বাড়ানোর জন্য উচ্চাভিলাষী পদক্ষেপের প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। এ উদ্যোগ কমিয়ে আনা ও ক্ষয়ক্ষতি থেকে আলাদা হিসেবে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এসব অঙ্গীকার অবশ্যই উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রয়োজনের ওপর ভিত্তি করে গৃহীত হবে। এখানে সবচেয়ে দুর্বলদের জন্য আরও ভালো অবস্থা নিশ্চিত করতেসহজ আবেদন প্রক্রিয়া থাকবে।
জলবায়ু অর্থায়ন সাধারণত দুটি ভাগে বিভক্ত। প্রথম ভাগে রয়েছে প্রশমন বা মিটিগেশন, যেমন— নবায়নযোগ্য শক্তির অবকাঠামো নির্মাণ, যা জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমাতেসহায়তা করে। দ্বিতীয় ভাগে রয়েছে অভিযোজন বা অ্যাডাপটেশন, যা বন্যা প্রতিরোধের মতো জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায়সহায়ক। উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোর উভয় ক্ষেত্রেই বেশিসহায়তা প্রয়োজন। ছোট দ্বীপ রাষ্ট্রগুলোর জোটের অর্থায়ন বিষয়ক জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা মাইকাই রবার্টসন বলেছেন, এই অঞ্চলগুলো জলবায়ু অভিযোজন ও প্রশমন উভয়ের খরচ বহন করতে হিমশিম খাচ্ছে এবং ক্রমবর্ধমান চরম আবহাওয়া মানুষের জীবনকে আরও কঠিন করে তুলছে।
বিভিন্ন গবেষণার তথ্য বলছে, তাপপ্রবাহ, ভারী বৃষ্টিপাত ও খরার মতো জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের জন্য সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে দরিদ্র দেশই বেশি, যাদের বৈশ্বিক উষ্ণায়নে অবদান খুব কম। এসব দেশগুলোকে নামে ডাকা হয় গ্লোবাল সাউথ। ২০০৯ সালে গ্লোবাল নর্থ তথা শিল্পোন্নত দেশগুলো প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তারা গ্লোবাল সাউথের দরিদ্র দেশগুলোকে আর্থিকভাবেসহায়তা করবে। ২০২০ সালের মধ্যে প্রতি বছর ১০০ বিলিয়ন ডলার প্রতিশ্রুতি ছিল তাদের। এই অর্থায়নের লক্ষ্য ছিল দরিদ্র দেশগুলোকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় সক্ষম করে তোলা। যেমন—কোনও কোনও দেশ সমুদ্র প্রতিরক্ষা বাঁধ নির্মাণ করতে পারে। আবার কোনও দেশ নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বাড়ানোর জন্য কাজ করতে পারে। ভারী বৃষ্টিপাতের বিরুদ্ধে মজবুত অবকাঠামো তৈরিও কোনও কোনও দেশের জন্য বড় কাজ। দেরিতে হলেও ১০০ বিলিয়ন ডলারের লক্ষ্য শেষ পর্যন্ত পূরণ করা হয়েছে। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই পরিমাণও এখন অপ্রতুল মনে করছেন পরিবেশবিদরা। এবারের কপ-২৯ সম্মেলনেও জলবায়ু অর্থায়নের এই বিষয়টি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হবে। ইঙ্গিত রয়েছে, এবার অনুন্নত ও অনুন্নয়নশীল দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় বছরে দেড় ট্রিলিয়ন করে অর্থায়ন চাইতে পারে। বেশির ভাগ জলবায়ু অর্থায়ন উন্নয়নশীল দেশগুলোর কার্বন নির্গমন কমাতে এবং জলবায়ু লক্ষ্য অর্জন করতেসহায়তা করার জন্য ব্যয় হয়। তবে এই অর্থের অনেকটাই ঋণের আকারে আসে। রবার্টসন প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘এটি একটি বিশাল সমস্যা, যার মুখে আমরা পড়ছি। একদিকে একে ১০০ বিলিয়ন ডলার হিসাবের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অন্যদিকে এই অর্থ আবার বরাদ্দ করা হচ্ছে ঋণ আকারে। অর্থাৎ এই অর্থ দাতা দেশের কাছেই ফেরত যাচ্ছে— সেটিও আবার সুদসহ। প্রকৃতপক্ষে তাহলে কে কাকেসহায়তা করছে?’ বিশ্লেষকরা বলছেন, জলবায়ু অর্থায়নের সুষম বণ্টন তথা সবচেয়ে প্রয়োজন যাদের তাদের কাছে পৌঁছানোর লক্ষ্য অর্জনেসহায়তা করার জন্য ঋণসহ আর্থিক প্রক্রিয়ার একটি মিশ্রণ প্রয়োজন। এটাই হবে এবারকার সম্মেলন (কপ–২৯) এর মুখ্য বিষয়।
লেখক: অধ্যাপক (অর্থনীতি), সাবেক পরিচালক, বার্ড (কুমিল্লা), সাবেক ডিন (ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ) ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি
সারাবাংলা/এসবিডিই