ইসলামী দলগুলোর জোট কোন পথে
১৯ নভেম্বর ২০২৪ ২১:৫৭ | আপডেট: ২০ নভেম্বর ২০২৪ ০৪:০৬
ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী মূলতঃ আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ইসলামী দলগুলোর একটা বলয় গড়ে তুলতে চাইছে। আর এই মুহূর্তে মোটামুটি গুরুত্বও পাচ্ছে। কর্মী সমর্থকদের মধ্যেও ব্যাপক আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। তবে রাজনীতির মাঠের হিসেব-নিকেশ কিছুটা হলেও ভিন্ন। এর কারণও স্পষ্ট। রাজনীতির মাঠে জামায়াত দলটি সঠিক পথের বলে মনে করে থাকেন দলটির সকল স্তরের নেতা ও কর্মীরা। অপরদিকে বিভিন্ন সময়ে মতাদর্শগত অমিল এবং অতিমাত্রায় আত্মকেন্দ্রিকতা অপরাপর দলগুলোকে জামায়াত বিদ্বেষী করে তুলেছে। আমরা বিভিন্ন সময়ে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নেতাদের প্রকাশ্য জামায়াতবিরোধিতা দেখেছি। আর সেটা ছিল অব্যাহত।
বাংলাদেশে নিবন্ধিত ইসলামী দল হচ্ছে ১১ টা। দলটির সূত্রগুলো বলছে, ইতোমধ্যেই ইসলামি শাসনতন্ত্র আন্দোলন, লেবার পার্টি, বার দলীয় জোট, ইসলামী আন্দোলনসহ কয়েকটি দল এবং কয়েকজন ইসলামি ব্যক্তিত্বের সাথে মত বিনিময় করেছেন বলেও শোনা যাচ্ছে। জামায়াতের নেতারা তেমনটা জানিয়েছেন বিভিন্ন প্লাটফর্মে। এতে তারা এক মঞ্চ করার বিষয়ে আশাবাদী। যা হবে বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য নতুন এক ঘটনা।
প্রসঙ্গত, তরিকত ফেডারেশন, খেলাফত আন্দোলন, মুসলিম লীগ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, ইসলামিক ফ্রন্ট, ইসলামী ঐক্যজোট, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট, খেলাফত মজলিস এবং ইনসানিয়াত বিপ্লবের নাম নিবন্ধিত দল হিসেবে নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে আছে। যদিও দলগুলো রাজনীতির মাঠে নতুন কর্মী তৈরি করতে পারেনি সে অর্থে। অর্থাৎ নিজস্ব বলয়ের বাইরে তারা নতুন কোনও ভোটারের সমর্থন পাবে এমন ধারণাও করা যাচ্ছে না। ফলত একই কর্মী এবং অনুসারী নিয়ে খুব যে সুবিধা করতে পারবে এমনটাও বলা যাচ্ছে না। তবে জোট হলে ভিন্ন কথা। যেহেতু এখন আনুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচন দাবী জানিয়ে আসছে অপেক্ষাকৃত ছোট ও মাঝারি মানের দলগুলো। সেক্ষেত্রে এইসব ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর জোট কতটা প্রভাব বিস্তার করতে পারবে তা-ও সুনির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছে না।
কিন্তু চমকপ্রদ বিষয় হচ্ছে জামায়াতের এই মুহূর্তে নিবন্ধন নেই। ২০১৩ সালে হাইকোর্ট এ নিবন্ধন বাতিল করেছিল। আবার হেফাজতে ইসলাম অরাজনৈতিক সংগঠন বলে নিজেদের দাওয়াতি কাজের অংশ হিসেবে কর্মকান্ড পরিচালনা করলেও তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় রয়েছেন। সে সব দলে তাদের পদ-পদবীও রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে হেফাজত রাজনীতিতে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। আর এতে মনে করা হচ্ছে ইসলামপন্থী দলগুলো শক্তিশালী হবে। অভ্যুত্থানকালীন আন্দোলনে তারা সেই শক্তিমত্তার প্রদর্শন করে রাজনীতিতে মোটামুটি শক্তপোক্ত অবস্থানও জানান দিয়ে যাচ্ছে। আর তাই এক সময়ের চরম বৈরী জামায়াতে ইসলামীর সাথে দূরত্ব কমিয়ে তারাও নরম সুরে।
তবে বাংলাদেশের ইসলামপন্থী দলগুলো যখনই ক্ষমতার স্বাদ পেতে শুরু করবে তখনই যে কোনও ঐক্যে ফাটল ধরবে। কারণ আদর্শিক দিক থেকে কিছুটা হলেও জামায়াত থেকে ব্যতিক্রম মনে করা হয় অন্যান্য দলগুলোকে। অতীতে আমরা দেখেছি বিএনপি জোটে জামায়াত থাকলেও ২৪ সালের সরকার পতনের পর উল্টো সুর দেখা যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে বিএনপি থেকে দূরত্ব বজায় রেখে জামায়াত যে প্লাটফর্ম করার কথা ভাবছে তা কার্যত আলোর মুখ দেখতে হলে জামায়াত তাদের পূর্বে ধ্যান ধারণা থেকে সরিয়ে উদার অবস্থান নিতে হবে। সেটা জামায়াতের অতীত চিন্তাধারার সাথে মিলে না। জামায়াত যদিও নিজেদের আধুনিকমনস্ক দল বলে প্রচার করেও থাকে তবে সাধারণ মানুষ তাদের সে কথা আস্থায় নিতে পারে না। জনগণের কাছেও পৌঁছাতে পারে না। এক্ষেত্রে অতীতের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড তাদের বিরুদ্ধে নেতিবাচক মনোভাব তৈরি করেছে যার কারণে মানুষও ভীতসন্ত্রস্ত। এ কারণে মূলত নিজেদের কর্মী-সমর্থক নিয়েই জামায়াতের বলয়। এবং এই বলয়েই তারা শক্তিসামর্থ্য প্রচার করে। এর বাইরে তেমন করে জামায়াত জনসমর্থন আদায়ে সক্ষম নয় বলেও মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
তবে ভিন্ন চিন্তা থেকে যদি দেখি, তাহলে জামায়াতের রাজনৈতিক চরিত্র এখনও মানুষের কাছে ভীতিকর। সে হিসেবে অন্য রাজনৈতিক দলগুলো এখনও জামায়াতকে বিশ্বাস করতে পারছে না। তার কারণ জামায়াত সাংগঠনিকভাবে বেশ শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে বলেও ধারণা করা হচ্ছে। পাশাপাশি তাদের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাও রয়েছে। কখনও সরকারের অংশ হয়ে। কখনও বিরোধী দলে। অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সে অভিজ্ঞতা তেমন নেই। এই কারণে যদি নির্বাচনী জোট করেও থাকে তবে তারা অন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে কোনঠাসা করতে পারে বলেও ধারণা করতে পারে। আর ঠিক এই কারণেই দলগুলো মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব বজায় রেখে চলবে। অর্থাৎ ধরি মাছ না ছুঁই পানি অবস্থা। এর মানে হচ্ছে ভালোর ভালো কৃতিত্ব যেমন খুব দ্রুতই নিতে পারে তেমনি খারাপের খারাপ থেকে দায় নিতে চাইবে না। যদি তেমন ভাবনা ভর করে অন্য ইসলামপন্থী দলগুলো তাদের বিশ্বাস করার কোন কারণ নেই। যদিও সেটা সময়ের হাতে সমর্পণ করাই সমীচীন হবে। তবে রাজনীতিতে কোন কিছুই পূর্বানুমান করা যায় না। এ ও প্রচার আছে রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। এই শেষ কথা যদি ইসলামী জোট গঠনেও বহাল থাকে তবে যে যে যার যার অবস্থান থেকে সর্তক থাকবে। আর সেটা বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলাচালে কৌশলগত। শেষমেশ জোটবদ্ধ হতে পারলে মনে হয় জামায়াতেরই বেশি লাভ হবে।
আবার অন্য দিকে বিএনপি এই মুহূর্তে নিজেদের খুব শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে মনে করে নির্বাচন অনুষ্ঠান হলে জয়ী হবে আর সরকার গঠনের দ্বারপ্রান্তে মনে করছে। সেই হিসেবে যেহেতু আওয়ামী লীগ এই মুহূর্তে মাঠে নেই বিএনপিকে চাপে রেখে আসন ভাগাভাগিতে দরকষাকষির জায়গা থেকে সংখ্যানুপাতিক হিসেবে বেশি আসন বাগিয়ে নিতেও ইসলামপন্থী জোটের উদ্যোগ কৌশলগত। এখন দেখার বিষয় কে কোন জোটে থেকে ভোটে লড়বে। এক্ষেত্রে অন্য দলগুলো জামায়াতকে সম্পূর্ণভাবে বিশ্বাস করতে চাইবে না।
আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে বিএনপি বলয়ের বাইরে সাধারণ ভোটারদের কাছে টানতে জামায়াত যতটা মরিয়া ততটা মাঠ গোছানো তাদের নেই। ঠিক যতটা বিএনপির আছে। অভ্যুত্থান পরবর্তী জামায়াতের শীর্ষ নেতার বক্তব্য তারপর তৃণমূলের প্রতিক্রিয়া এর পর শীর্ষ নেতার বক্তব্য ও চিন্তার ফারাক নতুন করে নড়েচড়ে বসতে ভাবিয়েছে আওয়ামী লীগসহ বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দলগুলোকে। এখনও পর্যন্ত আওয়ামী লীগ এবং তাদের দোসর আখ্যা দিয়ে জাতীয় পার্টিকে সংলাপে না ডাকায় দলটির পক্ষ থেকে অসন্তোষ জানানো হয়েছে। অথচ ছোট বড় কিংবা নামসর্বস্ব দলও প্রধান উপদেষ্টার আমন্ত্রণ পেয়ে বিভিন্ন দাবী এবং রূপরেখা প্রস্তাব দিয়ে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা ও দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবী জানিয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণার আগ পর্যন্ত বলা যাচ্ছে না ঠিক কবে বা কখন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আর এতে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড কতটা নিশ্চিত হবে। শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ কি আদৌ নির্বাচন করতে পারবে? যদি না পারে তবে ভোটের বা জোটের হিসাবও ভিন্ন হবে। অবশ্য গুঞ্জন রয়েছে জাতীয় সরকার নামে এই সরকার রাজনৈতিক আদলে সরকার পরিচালনায় আগ্রহী। আর যদি তা-ই হয় তবে কারা থাকছে সেই জাতীয় সরকারে?
সবাই ভোটের অংকে যোগ বিয়োগ করছে। দলগুলো আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের দাবী আনুষ্ঠানিকভাবে করছে না। ছাত্র-জনতার ব্যানারে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়করা দাবী জানিয়ে আসছে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের। সরকারের দুই জন উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ ও নাহিদ ইসলাম নিষিদ্ধের পক্ষে বক্তব্য দিচ্ছেন।
এটা নিশ্চিত যে, আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচনে মাঠে সুবিধা করতে পারবে না। আর এ জন্যই বিপুলসংখ্যক আওয়ামী লীগ সমর্থকের সমর্থন পাশাপাশি সাধারণের সমর্থন দুটোই কাছে টানতে চাইছে জামায়াত ও ইসলামী দলগুলো।
রাজনীতিতে একটা বহুল প্রচলিত প্রবাদ আছে, রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। তথাপিও বাংলাদেশে ইসলামপন্থী বড় জোট অনেকটাই অসম্ভবকে সম্ভব করার মতো ব্যাপার। আর যত সময় গড়াবে আমরা সেটা দেখবো। তবে এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের মনোভাবও বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে। কারণ আওয়ামী লীগ কোনভাবেই চাইবে না, বিএনপি ক্ষমতায় যাক। বিএনপি ক্ষমতায় না গেলে যদি আরেক অসম্ভব নতুন নতুন দল নিয়ে জোট গঠন কিংবা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন যদি দল গঠন করে তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অন্য কোনও চমক দেখা যেতে পারে। পরিবারতন্ত্রের কাছে বাংলাদেশের মানুষ নিজেদের জিম্মি মনে করলে ফল হবে দৃশ্যমান বিপরীত। সর্বোপরি মানুষ নিজেরাই সিদ্ধান্ত নেবে তারা কি চায়।
লেখক: আইনজীবী
সারাবাংলা/এসবিডিই