এডিপি বাস্তবায়নে দেরি ও সমাধানের উপায়
২৪ নভেম্বর ২০২৪ ০৯:২৬
বিগত সরকার গত জুন, ২০২৪ এ একটি বাজেট (২০২৪-২৫) মহান জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করেছিলেন যেখানে চলতি অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) দুই লাখ ৭৮ হাজার ২৮৯ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। কিন্তু বছরের শুরুতে জুলাই মাসের ১ তারিখ থেকে কোটা সংস্কার আন্দোলনের ফলে সরকার ৫ই আগষ্ঠ পদত্যাগ করে এবং এ পরিস্থিতিতে (এডিপি) বাস্তবায়নের গতি মন্থর হয়ে পরে যা উন্নয়নের জন্য একটি বড় বিপর্যয় বলে প্রতিয়মান হয়। তথ্য বলছে, অর্থবছরের শুরুর দিকে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নের গতি এমনিতেই ধীর থাকে। আর চলতি পরিস্থিতিতে এটা হবে তা অস্বাভাবিক কিছু নয়।
দেশে লক্ষ্যমাত্রার এডিপি বাস্তবায়নের দৌড়ে আগের সব ব্যর্থতার রেকর্ডভঙ্গ হয়েছে অর্থ্যাৎ চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) সময়ে মাত্র ৪ দশমিক ৭৫ অর্জন নিয়ে দেশ সর্বনিম্ন এডিপি বাস্তবায়নের নতুন রেকর্ড গড়েছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, অর্থবছরের শুরুতে সাধারণত প্রস্তুতিমূলক কাজ হয়ে থাকে। যদিও এডিপি বাস্তবায়নের পরিসংখ্যান বলছে ভিন্নকথা। এর আগেও দেশ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা পার করেছে। কিন্তু এডিপি বাস্তবায়ন এত কম পরিমাণ অর্জন এর আগে কখনোও হয়নি।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ৩ মাসের (জুলাই-সেপ্টেম্বর) আইএমইডি প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, জুলাই-সেপ্টেম্বর— এই তিনমাসে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) অর্থ ব্যয় হয়েছে মাত্র ১৩ হাজার ২১৫ কোটি ৩০ লাখ টাকা, যা মোট এডিপি বরাদ্দের মাত্র ৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ। এর মধ্য দিয়ে এডিপি বাস্তবায়নে দেশের ইতিহাসে আগের সর্বনিম্ন রেকর্ডটিও পেছনে পড়ে গেছে। চলতি অর্থবছরের এডিপি বাস্তবায়নের অগ্রগতি প্রতিবেদন তথ্য বলছে, গত (জুলাই-সেপ্টেম্বর) সময়ে মন্ত্রণালয় ও বিভাগওয়ারি বাস্তবায়ন হার সর্বোচ্চ মাত্র ১৫ দশমিক ২০ শতাংশ। বাকি বেশিরভাগেরই এক অঙ্কের কোঠায়। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নের এই দৌড়ে এখন পর্যন্ত হিসাবের খাতাই খুলতে পারেনি স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ, আইন ও বিচার বিভাগ এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। আবার খরচের খাতা খুলেও তিন মাসে ১ শতাংশও এডিপি বাস্তবায়ন করতে পারেনি ১০ মন্ত্রণালয় ও বিভাগ।
আইএমইডির ওয়েবসাইটে ২০১২-১৩ অর্থবছর পর্যন্ত জুলাই-সেপ্টেম্বরের তথ্য পাওয়া যায়। সেখানে কোনও অর্থবছরই এডিপি বাস্তবায়ন হার সাড়ে ৬ শতাংশের কম ছিল না। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এডিপি বাস্তবায়ন হার ছিল ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ। এর আগের অর্থবছরে (২০২১-২২) বাস্তবায়ন হার ছিল ৮ দশমিক ৫৫ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ৮ দশমিক ২৬ শতাংশ এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে ছিল ৮ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ। গত ১৩ অর্থবছরের তিন মাসের এডিপি বাস্তবায়নের চিত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সবচেয়ে কম এডিপি বাস্তবায়িত হয়েছিল ২০১৫-১৬ অর্থবছরে। তবে ওই অর্থবছরও একই সময়ে বাস্তবায়নের হার ছিল ৬ দশমিক ৭৪ শতাংশ। এর বিপরীতে সবচেয়ে বেশি বাস্তবায়ন হার ছিল ২০১২-১৩ অর্থবছরে। ওই অর্থবছরের একই সময়ে বাস্তবায়ন হার ছিল বরাদ্দের ১৩ শতাংশ। এ ছাড়া বাকি অর্থবছরগুলোর বেশির ভাগ সময়েই বরাদ্দের ৮ শতাংশের ওপরে বাস্তবায়িত হয়েছে। তথ্যানুযায়ী, শুধু সেপ্টেম্বর মাসে এডিপি বাস্তবায়ন ৬ হাজার ৭২ কোটি ২২ লাখ টাকা। অর্থাৎ এ সময় বাস্তবায়নের হার ২ দশমিক ১৮ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরের সেপ্টেম্বর মাসে খরচ হয় ১০ হাজার ৬৭ কোটি ৭৬ লাখ টাকা, যা বরাদ্দের ৩ দশমিক ৬৭ শতাংশ। অর্থাৎ মাসের হিসাবে আগের অর্থবছরের তুলনায় বাস্তবায়ন হার কমেছে ১ শতাংশের বেশি। আগের বছরগুলোতেও একই সময়ে বাস্তবায়ন হার ছিল ৩ শতাংশের বেশি। চলতি অর্থবছরের তিন মাসে সবচেয়ে বেশি এডিপি বাস্তবায়ন করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, তারা তিন মাসে বাস্তবায়ন করেছে বরাদ্দের ১৫ দশমিক ২০ শতাংশ। এ ছাড়া বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ ১৪ দশমিক ৩১ শতাংশ, পল্লা উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ ১৪ দশমিক ৫১ শতাংশ, লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগ ১১ দশমিক ৭৭ শতাংশ, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় ৮ দশমিক ৩৮ শতাংশ। শতাংশের হিসাবে বাস্তবায়নে পিছিয়ে থাকলেও টাকা খরচে এগিয়ে রয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। বিভাগটির ২৩১ প্রকল্পের বিপরীতে বরাদ্দ ছিল ৪২ হাজার ৯৫৬ কোটি ৭১ লাখ টাকা। ৩ মাসে ব্যয় হয়েছে ৩ হাজার ১৩৪ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। দ্বিতীয় অবস্থান বিদ্যুৎ বিভাগ খরচ করেছে ২ হাজার ৭৩৩ কোটি ৯ লাখ টাকা, যা মোট বরাদ্দের ৬৮ দশমিক ২৯ শতাংশ।
বর্তমান অন্তর্বতী সরকার উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যাপারে কিছুটা রক্ষনশীল এবং বিগত তিন মাস সময়ে ২টি একনেক সভা করেছে যাতে সিদ্ধান্ত হয়েছে কোন অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পে বরাদ্ধ যাবে না এবং চলমান প্রকল্পগুলো প্রাধিকারের ভিত্তিতে চলমান থাকবে যা হবে উন্নয়নের অংশীদার। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে সরকার যে কৃচ্ছতাসাধন নীতি গ্রহণ করেছে, এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে আরএডিপিতে। সেই সঙ্গে তীব্র ডলার সংকটও অন্যতম কারণ। ‘উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন কম হওয়ার প্রকৃত কারণ বলা কঠিন। তবে কাজের অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, দায়িত্ব যখন ভাগাভাগি হয়, তখন সবার ওপরই সমান দায়। কিন্তু সবাই সমানভাবে কাজ করতে পারে না। এ ছাড়া প্রকল্প পরিচালক (পিডি) গুরুত্বপূর্ণ পদ হলেও এ ক্ষেত্রে যাদের নিয়োগ দেওয়া হয়, অনেক ক্ষেত্রে তা সঠিক হয় না। পাশাপাশি আমলাতান্ত্রিক জটিলতাও রয়েছে। এই জটিলতা শুধু আমাদের অংশে নয়, উন্নয়নসহযোগীদের মধ্যেও রয়েছে। ফলে ঋণের অর্থছাড়ে দেরি হয়। এর প্রভাব পড়ে প্রকল্প বাস্তবায়নে।
চলমান অর্থবছরের উন্নয়ন প্রকল্পের তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, দ্বিতীয় পদ্মাসেতুসহ বড় ৯টি প্রকল্পের প্রাথমিক খরচ ধরে আগামী অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) যুক্ত করা হয়েছে। পাটুরিয়া থেকে গোয়ালন্দে দ্বিতীয় পদ্মা সেতু নির্মাণে প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছে ১২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ বলছে, প্রস্তাবিত দ্বিতীয় পদ্মা সেতুর দৈর্ঘ্য হবে সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার, প্রস্থ ১৮.১ মিটার। দুই প্রান্তে সংযোগ সড়ক হবে সাড়ে ১৫ কিলোমিটার। নদীশাসনের কাজ হবে দুই প্রান্তে ১৮.৪ কিলোমিটার। প্রকল্প বাস্তবায়নে সম্ভাব্য উন্নয়নসহযোগী হিসেবে রাখা হয়েছে বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক ও জাপান ব্যাংক অব ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশনকে (জেবিআইসি)।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতি এ মুহূর্তে এমন একটি সন্ধিক্ষণে এসেছে, সবাই মনে করছেন যে ব্যাপক সংস্কার সাধনের এটাই উপযুক্ত সময় এবং এই দুর্লভ সুযোগটি কোনওভাবেই হাতছাড়া করা ঠিক হবে না। এই গুরুত্বপূর্ণ সময়টিতে এমন কিছু পরিবর্তন আনতে হবে, যেগুলো কিনা ইএসজি বাস্তবায়ন, ব্যবসাসহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি, জনগণের স্বাধীনতা ও মানবাধিকার রক্ষায় অত্যন্ত জরুরি। এই সংস্কারের উদ্দেশ্য হবে একটি স্বচ্ছ এবং প্রতিযোগিতামূলক ইকোসিস্টেম গড়ে তোলা, যা বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়াবে এবং সব ধরনের দুর্নীতি দমন করবে। এ কাজ করতে গিয়ে প্রথমেই অর্থনীতির চ্যালেঞ্জগুলোর মুখোমুখি হতে হবে এবং কোনওভাবেই বিশেষ করে আর্থিকখাতের দুর্বলতাগুলো উপেক্ষা করা যাবে না। আর্থিকখাতে সুশাসনের অভাবে পুঞ্জীভূত বিপুল খেলাপি ঋণ, ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট, ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি এবং অপর্যাপ্ত জবাবদিহিতার নজির তৈরি হয়েছে। এই ত্রুটিগুলো রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে এবং ব্যাপকভাবে এর মাশুল দিয়ে চলেছে জাতি। সেইসঙ্গে যৌক্তিক সময়ে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন, জনগণের দুর্ভোগ লাগবে বাজার নিয়ন্ত্রণ, জননিরাপত্তা নিশ্চিতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নসহ ‘মব জাস্টিসের’ মতো অনভিপ্রেত ঘটনা নিয়ন্ত্রণে এনে রাজনৈতিক এবং সামাজিক স্থিতিশীলতা রক্ষা করাই অন্তর্বর্র্তী সরকারের মূল অগ্রাধিকার হওয়া উচিত বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। গত তিনমাসের মূল্যায়নে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ভঙ্গুর সামষ্টিক অর্থনীতিতে খানিকটা শৃঙ্খলা ফিরেছে। আর দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠানের স্পষ্ট পদক্ষেপ না নেয়ায় এক ধরনের অস্বস্তির কথা জানিয়েছেন রাজনীতিবিদরা।
শপথ নেয়ার পরই সংস্কারকে প্রাধান্য দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। রাষ্ট্র সংস্কার, অর্থনীতি পুনর্গঠন, আইনশৃঙ্খলা ও বিচারব্যবস্থাসহ বিভিন্ন সেক্টরে সংস্কার প্রক্রিয়া শুরু করে নতুন সরকার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, অর্থনীতি পুনরুদ্ধার এবং রাজনীতি ও নির্বাচন ব্যবস্থায় সংস্কার আনার ওপর সবার আগে জোর দিতে হবে দায়িত্ব পাওয়া উপদেষ্টাদের। বিশ্লেষকদের মতে, রাষ্ট্র সংস্কারই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান কাজ বলে বিবেচিত হলেও তৃতীয় মাসে এসে তা কিছুটা প্রশ্নের মুখে পড়ে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের জন্য ১০টি কমিশন গঠন করে। কমিশনগুলো হলো নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার, পুলিশ সংস্কার, বিচার বিভাগ সংস্কার, দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার, জনপ্রশাসন সংস্কার, সংবিধান সংস্কার, স্বাস্থ্য খাত সংস্কার, শ্রমিক অধিকার সংস্কার, নারী অধিকার সংস্কার ও গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন। তাই জাতি আশা করছে সবাই মিলে বর্তমান সরকারকে সহযোগীতা করা এবং সংস্কার কর্মসূচী যাতে অব্যাহত থাকে সে জন্য সরকারকে পর্যাপ্ত সময় দেওয়া। সেখানে এডিপি বাস্তবায়নে কিছু বিলম্ব দীর্ঘমেয়াদে প্রভাব ফেলবে না।
লেখক: অধ্যাপক, গবেষক ও সাবেক পরিচালক, বার্ড, কুমিল্লা
সারাবাংলা/এসবিডিই