খেলাপি ঋণ সমস্যার সমাধান কোথায়?
২৫ নভেম্বর ২০২৪ ১০:০৯
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারানো আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নেওয়া ঋণখেলাপি চিহ্নিত হতে শুরু করায় চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে খেলাপি ঋণ বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতের খেলাপি দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের প্রায় ১৭ শতাংশ। গত ডিসেম্বরে খেলাপি ছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা বা ৯ শতাংশ। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যাংক দখল, জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ নিয়ে বিদেশে পাচার ও কয়েকটি শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক থেকে অবৈধ উপায়ে ঋণ নেয়াই ঋণখেলাপির কারন হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। তবে ব্যাংক খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন, প্রকৃত খেলাপি ঋণের অঙ্ক আরও বেশি। কারণ, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হিসাবে অবলোপন করা ও আদালতের আদেশে স্থগিত থাকা ঋণ বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। এছাড়া বিপুল অঙ্কের ঋণ পুনঃতফশিল করা আছে। সেগুলোও এই হিসাবে নেই।
সরকার পরিবর্তনের পর ব্যাংক খাত সংস্কারে পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র আগামী দিনে আরও বেরিয়ে আসবে বলে মনে করছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। জানতে চাইলে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি ড. মইনুল ইসলাম বলেন, খেলাপি ঋণের এই তথ্য ভুয়া। কারণ বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান গভর্নর আহসান এইচ মনসুর নিজেই বলেছেন, খেলাপি ঋণ ৬ লাখ কোটি টাকা। এছাড়া একটা গণমাধ্যমেও বলা হয়েছে প্রকৃত খেলাপি প্রায় ৭ লাখ কোটি টাকা। মূলত কৌশলগত কারণে বলা যাচ্ছে না। তবে প্রকৃত খেলাপি ঋণ ৭ লাখ কোটি টাকার কম হবে না। কারণ এখানে ঋণ অবলোপন, অর্থঋণ আদালতে মামলা, আদালতে স্থগিতাদেশ ও ঋণ পুনঃতফসিল করা বিপুল অঙ্কের টাকার হিসাব নেই।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা নেওয়ার সময় ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার কোটি টাকা। এরপর বাড়তে বাড়তে ২০১৩ সালের মার্চে প্রথমবারের মতো অর্ধলাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছিল। ওই সময় খেলাপি ঋণ ঠেকে ৫১ হাজার ২০ কোটি টাকায়, যা ছিল মোট ঋণের ১১ দশমিক ৯০ শতাংশ। এরপর বিভিন্ন সুবিধা দিয়ে খেলাপি ঋণ কমিয়ে রাখার চেষ্টা হলেও তেমন কাজ হয়নি। ২০১৯ সালের মার্চে প্রথমবারের মতো খেলাপি ঠেকে ১ লাখ ১০ হাজার ৮৭৪ কোটি টাকা, যা ছিল মোট ঋণের ১১ দশমিক ৮৭ শতাংশ। আর গত জুনে প্রান্তিক শেষে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছিল ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। সরকার পতনের পর গত সেপ্টেম্বরে এ তথ্য প্রকাশ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সরকার পতনের পর গত সেপ্টেম্বরে এ তথ্য প্রকাশ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই সময় পর্যন্ত বিতরণ করা ঋণের যা ছিল ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ। এভাবে গত ১৬ বছরে ১৩ গুণ বেড়ে এখন প্রায় ৩ লাখ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, জুন থেকে সেপ্টেম্বর এই ৩ মাসে খেলাপি ঋণ বাড়াতে সরকারি ব্যাংকের চেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে বেসরকারি ব্যাংকগুলো। এই সময়ে সরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৩ হাজার ৬২৮ কোটি টাকা। আর বেসরকারি ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির পরিমাণ ছিল ৪৯ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ শ্রেণীকরণ ও প্রভিশনিংয়ের নীতিমালা ছিল আন্তর্জাতিকমানের। তবে ২০১৪ সালের নির্বাচনের ঠিক আগে রাজনৈতিক বিবেচনায় তা শিথিল করে আওয়ামী লীগ সরকার। ২০১৩ সালে নামমাত্র ডাউনপেমেন্টে বিশেষ বিবেচনায় ঋণ পুনঃতপশিলের সুযোগ চালু করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপর ২০১৫ ও ২০১৮ সালে আবারও ২ শতাংশ ডাউনপেমেন্ট দিয়ে ঋণ নিয়মিত এবং পুনর্গঠনসহ বিভিন্ন ছাড় দেওয়া হয়। সবকিছু ছাপিয়ে করোনা শুরুর পর ২০২০ সালে এক টাকা না দিলেও ঋণ নিয়মিত দেখাতে বলা হয়। ২০২১ সালে কিস্তির ১৫ শতাংশ এবং ২০২২ ও ২০২৩ সালে অর্ধেক দিলেই নিয়মিত দেখানো হয়। অবশ্য এতসব সুযোগ দিয়েও খেলাপি ঋণ আটকানো যায়নি। এর মধ্যে আইএমএফের ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের কারণে নীতি সহায়তা বন্ধ হচ্ছে। আইএমএফের ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের জন্য বিভিন্ন শর্ত পরিপালন করতে হচ্ছে। সংস্থাটি ২০২৬ সালের মধ্যে বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশের নিচে এবং সরকারি ব্যাংকের ১০ শতাংশের নিচে নামানোর শর্ত দিয়েছে। তবে এ খেলাপি ঋণ কম দেখানোর জন্য আগের মতো নীতিসহায়তা দেওয়া যাবে না। বরং ২০১৯ সাল থেকে মেয়াদি ঋণ এক বছর কোনো কিস্তি না দিলেও তা মেয়াদোত্তীর্ণ না করার বিধান তুলে দিতে হচ্ছে।
বেনামি ও ভুয়া ঋণ ঠেকানো, এক জায়গা থেকে ঋণ নিয়ে আরেকখানে সমন্বয়, বারবার ঋণসীমা বাড়ানোর সুযোগ বন্ধ হচ্ছে। এরই মধ্যে একের পর এক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন, সুশাসন জোরদারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সুফল পেতে কিছুটা সময় লাগবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। এদিকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের অঙ্ক দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২৬ হাজার ১১১ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ৪০ দশমিক ৩৫ শতাংশ। অন্যদিকে বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের অঙ্ক দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৪৯ হাজার ৮০৬ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ১১ দশমিক ৮৮ শতাংশ। বিদেশি ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের অঙ্ক দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ২৪৫ কোটি টাকা বা বিতরণ করা ঋণের ৪ দশমিক ৯৯ শতাংশ এবং বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের অঙ্ক ৫ হাজার ৮১৩ কোটি টাকা। ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, অস্থিতিশীল অর্থনৈতিক অবস্থাকে কারণ হিসাবে দেখিয়ে অনেকে ঋণ পরিশোধ করতে চান না। তাদের এই প্রবণতা মন্দ ঋণের বোঝা আরও বাড়াতে পারে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা অধিকাংশ ঋণ অনিয়ম ও কেলেঙ্কারির মাধ্যমে নেওয়া হয়েছে। ফলে এসব ঋণ আদায় করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
অনেকেই বলছে ঋণখেলাপি ব্যাংক তারল্যে ঘাটতির একটি বড় কারন এবং সত্যতাও রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদন বলছে চলতি বছরের ১ জুলাই থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই তিন মাসে তারল্য কমেছে ২৭ হাজার ১৫১ কোটি টাকা। গত বছরের জুন শেষে ব্যাংকে মোট তারল্য ছিল ৪ লাখ ৩১ হাজার ৯২৯ কোটি টাকা যা গত ৩০ সেপ্টেম্বর তা কমে দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৪ হাজার ৭৭৮ কোটি টাকায়। ওই সময়ে মোট তারল্য বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ১৫ হাজার ৫৩৫ কোটি টাকায়। এ হিসাবে গত জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত এই চার মাসে তারল্য কমেছে ২৬ হাজার ১৪৭ কোটি টাকা। প্রতিবেদনে ব্যাংকিং খাতে তারল্য কমার জন্য চারটি কারণকে শনাক্ত করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেমন: করোনার পর হঠাৎ করে চাহিদা বৃদ্ধি, বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহে বাড়তি প্রবৃদ্ধি, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বাড়ার কারণে আমদানি ব্যয়ের মাত্রাতিরিক্ত প্রবৃদ্ধি ও ব্যাংক থেকে নগদ টাকা তুলে গ্রাহকরা নিজেদের হাতে রাখার প্রবণতা বেড়ে যাওয়া। এসব কারণের বাইরেও ব্যাংকিং খাতে তারল্য কমার আরও কিছু কারণ হলো সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিছু গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, ‘ব্যাংকিং খাতে টাকা নেই’। এ ধরনের গুজবের শিকার হয়ে ব্যাংক থেকে অনেকে টাকা তুলে নিয়েছেন। এ পরিস্থিতিতে ব্যাংকিং খাতে তারল্যের জোগান স্বাভাবিক রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নগদ টাকার জোগান বাড়ানো হয়েছে বিশেষ করে মুদ্রানীতির বিভিন্ন উপকরণ ব্যবহার করে ব্যাংকগুলোর চাহিদা অনুযায়ী কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা দেওয়া হয়েছে প্রায় প্রতিদিনই। কোনো কোনোদিন ১৩ হাজার কোটি টাকারও জোগান দেওয়া হয়েছে। এর বিপরীতে অনেক উপকরণের মেয়াদ শেষ হওয়ায় ওইসব অর্থ ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ফেরত দিয়ে নতুন করে টাকা নিয়েছেন। এটি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া।
ব্যাংকে তারল্য ব্যবস্থাপনার এবটি নিয়ম রয়েছে যে তার মোট আমনতের ৫.৫% থেকে ৬.৫% পর্যন্ত ভল্টে রাখতে হবে দৈনন্দিন লেনদেন মেটানোর জন্য এবং বিশেষ সময়ে বিশেষ ক্ষেত্রে যদি তারল্যেও প্রয়োজন হয় তা হলে একই ব্যাংকের ফিডিং ব্যাংক শাখা থেকে ধার করবে সুদের বিনিময়ে। আবার সেই ব্যাংক শাখার যদি বাড়তি তারল্য থাকে তবে সেই ব্যাংক শাখা নিদির্ষ্ট হারে তারল্য ব্যাংক ভল্টে রেখে তা আবার নিদির্ষ্ট সুদ প্রাপ্তির বিনিময়ে ফিডিং শাখায় স্তানান্তরিত করবে। সেটাই তারল্য ব্যবস্থাপনার মূলনীতি। সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক কয়েকটি ইসলামী ব্যাংকে মোটা অংকের তারল্য সরবরাহ করেছে এই কারনে যে এই ব্যাংকগুলো থেকে মোটা অংকের ঋণ আইনবর্হিভূতভাবে তিনটি কোম্পানির কাছে চলে গেছে যা এই ব্যাংকের তারল্য সংকটের মূল কারন। তবে প্রশ্ন উঠেছে, বাংলাদেশ ব্যাংক কি চাইলেই বাণিজ্যিক ব্যাংকে নগদ টাকা সরবরাহ করতে পারে? আমানতকারীরা যেসব বাণিজ্যিক ব্যাংকে অর্থ ও সঞ্চয় জমা রেখেছেন, তাদের সেবার গ্যারান্টি বাংলাদেশ ব্যাংক আগ বাড়িয়ে কেন দিচ্ছে? কেন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো নিজেরা আমানতের নিরাপত্তার ব্যাপারে গ্রাহক যোগাযোগ বাড়াচ্ছে না? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে পেলেই আর কোনও সমস্যা থাকবে বলে মনে হয় না।
গনতান্ত্রিক সমাজে রাজনীতি সর্বক্ষেত্রে বিচরণ করলেও অন্তত ব্যাংকিং এর মত সেবাধর্মী আর্থিক খাতটিকে রাজনীতিমুক্ত রাখা যায় না কেন? এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংকিং খাতের অভিবাবক হিসাবে তার সঠিক দায়িত্ব পালন করতে পারে না কেন? ঋন মওকুফ ,ঋনের পুনঃ তফসীলিকরন, ঋনের অবোলপন ইত্যাদি বিষয়গুলো এখন খুবি ক্ষতিকর ও অলাভজনক। এখন ব্যাংকও ঢালাওভাবে সবাইকেও সুযোগ দিতেও পারে না, কিংবা ঢালাওভাবে বিবেচনায়ও আনতে পারে না। কিন্তুু জায়গাটিতে ব্যাংকার কিংবা ব্যাংকিং সুসাশসনের অভাব পরিলক্ষিত হয় যা কোনওভাবেই প্রতিষ্ঠিত করা যাচ্ছে না। যারা অপরাধের সঙ্গে জড়িত তাদের বিচার হয় না। আইন তাদের স্পর্শ করতে পারে না, যার কারণে ব্যাংকখাতে একের পর এক কেলেঙ্কারি ঘটে চলেছে।
ব্যাংকখাত ও অর্থনীতি বাঁচানোর জন্য সবাইকে সোচ্চার হতে হবে। দুর্নীতিবাজ, অর্থ পাচারকারী, ব্যাংকের টাকা লুটকারীরা যত বড়ই হোক না কেন, তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি সহায়তা, প্রশাসনিক সমর্থন ইত্যাদি তফসিলি বানিজ্যিক ব্যাংকগুলোর জন্য খুবি জরুরি। সরকার যদি সচেষ্ট হয় তবে সমাজিকভাবে এইসব খেলাপি ঋনের মোকাবিলা করাও সম্ভব আবার প্রশাসনিকভাবেও সম্ভব। এখন কোনটি ভাল হবে তা কর্তৃপক্ষ ভেবে দেখবে। তবে ব্যাংকিং শিল্পের স্বার্থে সমস্যাগুলোর অবশ্যই শান্তিপূর্ণ সমাধান চাই।
লেখক: অধ্যাপক (অর্থনীতি), সাবেক পরিচালক, বার্ড (কুমিল্লা), সাবেক ডিন (ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ) ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি
সারাবাংলা/এসবিডিই