কিশোরদের অপরাধপ্রবণতা থামানো জরুরী
২৬ নভেম্বর ২০২৪ ১৭:৫৯
শিশু ও কিশোরদের সুষ্ঠু মানসিক বিকাশ একটি দেশের সামগ্রিক মানবিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে নিবিড়ভাবে সংশ্লিষ্ট। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের দেশে এ বিষয়টির যতটুকু গুরুত্ব থাকার কথা আমরা সেই কাঙ্ক্ষিত মাত্রার চেয়ে বহু পিছিয়ে রয়েছি। জনমিতিক পূর্বানুমানের ভিত্তিতে জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপি) তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশের জনসংখ্যাগত লভ্যাংশ কিংবা ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অর্জন করার সময় এই শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত বিদ্যমান থাকবে। অর্থাৎ এই সময় আমাদের দেশের জনগণের মধ্যে নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর চেয়ে কর্মক্ষম ব্যক্তির সংখ্যা বেশি থাকবে যারা দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখার পাশাপাশি দেশ গড়ার কাজে অংশ নেবে।
এই কর্মক্ষম ব্যক্তিদের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো শিশু কিংবা কিশোররা। যাদের বয়স ১৬ বছরের কাছাকাছি এবং তাদের থেকে বয়সে যারা ছোট তারা এই জনসংখ্যার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই জনগোষ্ঠীকে গুরুত্ব দিয়ে নীতি নির্ধারণ করা তাই দেশের সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, যাদের কাজের ওপর দাঁড়িয়ে আমরা জনসংখ্যাগত লভ্যাংশ অর্জন করার স্বপ্ন দেখি তাদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। কিশোর গ্যাং বা সমষ্টিগত কিশোর অপরাধী চক্রে কিশোরদের জড়িয়ে পড়া তাদের সম্পর্কে আমাদের উদাসীনতার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে অনুমান করা যায় যার সুনির্দিষ্ট কারণ বিশ্লেষণ করা আবশ্যক। বাংলাদেশের মতো দেশে এ বিষয়ক গবেষণা অপ্রতুল। কিশোর গ্যাং বলতে মূলত অপ্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিদের এমন সংগঠিত দলদের বোঝায় যারা বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত থাকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বহু ধরনের মানুষ বসবাস করে এমন শহুরে এলাকায় এই ধরনের দল গড়ে ওঠে। এ দলগুলোর নিজেদের মধ্যে একটি ক্ষমতা কাঠামো থাকে, নিজেদের নির্ধারণ করা এলাকা থাকে এবং নির্দিষ্ট ধরনের অপরাধকেন্দ্রিক লক্ষ্য থাকে। বর্তমান সময়ে তথ্যপ্রযুক্তির প্রসারের সাথে এদের নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ এবং প্রতিযোগিতার নানা সুযোগ তৈরি হয়েছে। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যেমন—টিকটক কিংবা ফেসবুকের মাধ্যমে এদের মধ্যে নিজেদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডকে জনসমক্ষে নিয়ে আসার একটি প্রবণতা বর্তমানে বেশ লক্ষ্য করা যায়। এটি তাদের প্রাধান্য বিস্তার করার একটি উপায়ও বটে।
অপ্রাপ্ত বয়স্কদের অপরাধমূলক কাজে দল গঠন করার পেছনের কারণ কী? কিশোররা সাধারণত বিভিন্ন সামাজিক বা মনস্তাত্ত্বিক কারণে দলবদ্ধ হয়ে কাজ করতে উদ্বুদ্ধ হয়। মানুষের বেঁচে থাকার স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার মধ্যেই দলবদ্ধ হয়ে কাজ করার ব্যাপারটি রয়েছে। অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোররা যেহেতু তাদের আর্থিক কিংবা অন্যান্য সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে জানে কাজেই দলবদ্ধ হওয়ার মাধ্যমে সেই সমস্যাগুলোর একটি সমাধান তারা করতে পারে। তাছাড়া এদের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে অংশ নেওয়া নিয়ে যে রোমাঞ্চ কাজ করে তা দলীয় ব্যবস্থার বাইরে অর্জন করা কঠিন। পাশাপাশি দলীয়ভাবে কাজ করলে রাজনৈতিক সমর্থন পাওয়া যায় যা তাদের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর পাশাপাশি ঝুঁকি নিরসনে সহায়তা করে। মাদক ব্যবসা বা চুরি-ছিনতাই করার মাধ্যমে কিংবা যে কোনওও ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে আর্থিক সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে দলীয় অংশগ্রহণ তাদের মধ্যে এক ধরনের নিরাপত্তাবোধ তৈরি করে। এসব কারণে অনেক অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশু কিংবা কিশোর এই ধরনের নানা অপরাধমূলক চক্রে জড়িয়ে পড়ে।
বাংলাদেশে কিশোর অপরাধীদের সংখ্যা অতীতের যে কোনও সময়ের তুলনায় এখন অনেক বেশি। ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর এবং খুলনা মহানগরে বিভিন্ন নামে কিশোর গ্যাং গড়ে উঠেছে যেগুলো সামগ্রিক অপরাধ পরিসংখ্যানে বেশ নেতিবাচক প্রভাব রাখছে। এছাড়া জেলা শহরে কিংবা মফস্বলেও এদের উপস্থিতি বেশ আশঙ্কাজনক। এদের নামগুলো হয় বাহারি এবং চটকদার। ২০২৪ সালের প্রথম আলো পত্রিকার প্রতিবেদনে শুধু ঢাকায় ১২৭টি কিশোর গ্যাং সক্রিয় রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এর আগের দেড় বছরে এ সংখ্যা বেড়েছে ৬১টি। এরা নানা ধরনের সংঘবদ্ধ অপরাধে জড়ানোর পাশাপাশি নিজেদের মধ্যেও প্রায়ই বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে। পারস্পরিক এ ধরনের দ্বন্দ্ব তাদের দীর্ঘমেয়াদে কিশোর গ্যাংয়ের দুষ্টচক্রে আবদ্ধ করে ফেলে। কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড সবসময় চালালেও কিছু ঘটনায় তাদের মাধ্যমে সংঘটিত ভয়ংকর বেশকিছু কর্মকাণ্ড সামনে চলে আসে। বরগুনা শহরের আলোচিত রিফাত হত্যাকাণ্ডে জড়িয়ে ২০১৯ সালে আলোচনায় আসে ইংরেজিতে ‘০০৭’ নামের কিশোর গ্যাংটি। এর আগে ঢাকার উত্তরায় খেলার মাঠে একজন কিশোরকে নির্মমভাবে হত্যা করে আলোচনায় আসে ‘ডিসকো বয়েজ’ ও ‘নাইন স্টার গ্রুপ’ নামের দুটি কিশোর গ্যাং।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো প্রতিবেদনে এদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার কথা উল্লেখ করা হয় এবং তাদের মধ্যে এক ধরনের নায়কোচিত ভাব দেখানোর প্রবণতাকে গ্যাং সংস্কৃতি গড়ে ওঠার শুরুর দিকের কারণ হিসেবে বলা হয়। এর পেছনে তাদের কোনও ধরনের গবেষণা ফলাফল রয়েছে কিনা তার উল্লেখ অবশ্য পাওয়া যায় না। তবে এ সব গ্রুপের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা অত্যন্ত নির্মম একটি বাস্তবতা। সরকারি সংস্থাগুলো কিশোর অপরাধ তথা গ্যাং সংস্কৃতি প্রতিরোধে বাচ্চাদের পড়ালেখার বাইরেও বিভিন্ন সহ-পাঠ্যক্রমিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করার গুরুত্বের কথা বলেছে। এসব গ্যাংয়ের সদস্যরা রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে হত্যা, ধর্ষণ, মাদক পাচার, চুরি, ছিনতাইসহ বিভিন্ন ধরনের হিংস্র ও সহিংস কর্মকাণ্ডে প্রায়ই লক্ষ করা যায়। সামাজিক অব্যবস্থাপনা, অনিরাপদ এলাকায় বসবাস, বিদ্যালয়ে ব্যর্থতা, বিচ্যুত সঙ্গীদের সাথে ঘনিষ্ঠতা, নেতৃত্বের তীব্র আকাঙ্ক্ষা, পারিবারিক দায়িত্বহীনতা, পারিবারিক বঞ্চনা, পরিবারের সদস্যদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ, মাদক প্রভৃতি সামাজিক কারণ এবং গুরুতর মানসিক আঘাত কিংবা ট্রমা, বিষণ্নতা, মনোযোগহীনতা, কম আত্মমর্যাদা, দ্রোহী মনোভাব এবং নৈতিক অবক্ষয়সহ বিভিন্ন মনস্তাত্ত্বিক কারণের সাথে কিশোর অপরাধে জড়িত হওয়ার প্রবণতার কিংবা গ্যাং অন্তর্ভুক্তির তাৎপর্যপূর্ণ সম্পর্ক এসব গবেষণায় উঠে এসেছে।
বাইরের দেশের এসব গবেষণা এবং বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবস্থা চিন্তা করলে আরও কিছু বিষয়কে কিশোর অপরাধের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে (যেমন-অভিভাবকদের উভয়ের অর্থনৈতিক কাজে অংশগ্রহণ, রাজনৈতিক প্রভাব কিংবা নৈতিক শিক্ষার অপর্যাপ্ততা) তবে এগুলোর কার্যকারণ সম্পর্ক নির্ধারণ করতে হলে আঞ্চলিক সংখ্যাতাত্ত্বিক এবং গুণগত গবেষণা আবশ্যক। কিশোরদের গ্যাং অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে কিশোর অপরাধ প্রতিরোধের করার জন্য কিছু সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। আমাদের প্রথাগত প্রতিরোধ ব্যবস্থা হিসেবে পরিবারভিত্তিক, বিদ্যালয়কেন্দ্রিক এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানভিত্তিক উদ্যোগের কথা বলা হলেও কর্মসূচি নির্দিষ্ট না থাকার কারণে যথাযথ সচেতনতা তৈরি করা সম্ভব হয় না। ফলে এক্ষেত্রে কার্যকর কার্যকর তেমন কোনও প্রতিরোধ ব্যবস্থা সম্পর্কে জানা যায় না। উত্তর আমেরিকার দেশগুলোয় সাধারণ শিক্ষার্থীদের জন্য গ্যাং অন্তর্ভুক্তি প্রতিরোধে বিভিন্ন কর্মসূচি চালু রয়েছে। এক্ষেত্রে তিনটি পর্যায়ের কিশোরদের জন্য ঝুঁকি বিবেচনায় প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং সর্বোচ্চ মাত্রার প্রতিরোধ ব্যবস্থা চালু রয়েছে। এ সব কর্মসূচির আওতায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তত্ত্বাবধানে বিদ্যালয় কিংবা এলাকাভিত্তিক বিভিন্ন উদ্যোগ হাতে নেওয়া হয়। প্রাথমিক প্রতিরোধ কর্মসূচির কৌশল হিসেবে যেখানে গ্যাং অন্তর্ভুক্তির সম্ভাবনা আছে এমন শিশু-কিশোরদের সচেতন করার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। সচেতনতা তৈরি, আচরণগত প্রশিক্ষণ, সমস্যা সমাধান এবং দ্বন্দ্ব নিরসনের কৌশল শেখানোর পাশাপাশি গ্যাং সংস্কৃতির প্রতি নিরুৎসাহিত করা এই কর্মসূচির উদ্দেশ্য। এই মডেল পানামা ও বেলিজসহ বিশ্বের অনেক উন্নয়নশীল দেশেও অনুসরণ করা হচ্ছে।
সর্বোচ্চ মাত্রার প্রতিরোধ ব্যবস্থা তাদের জন্য নেওয়া হয় যারা ইতিমধ্যে গ্যাং সংস্কৃতিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে এদের একটি নিরাপদ প্রত্যাবর্তন ব্যবস্থার মাধ্যমে যাতে সমাজে পুনর্বাসিত করা যায় সে লক্ষ্যে পড়াশোনা ও কর্মদক্ষতাকে গুরুত্ব দিয়ে বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়া হয়। আমাদের দেশের গ্যাং সমস্যা একটি গুরুতর বিষয় যেটিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয় না। অন্যান্য দেশের সমস্যার আলোকে এই সমস্যা সমাধানের জন্য আমাদের নিজস্ব কর্মসূচি নির্ধারণ করা আবশ্যক। গ্যাং অন্তর্ভুক্তির কারণ হিসেবে বিভিন্ন দেশের গবেষণায় পাঁচটি পরিসর চিহ্নিত করা হয়। এগুলো হলো—ব্যক্তিগত, পারিবারিক, বন্ধু নির্বাচন, বিদ্যালয় এবং বসবাসের এলাকা। বেশি পরিসর ঝুঁকিপূর্ণ হওয়া মানে তার গ্যাং অন্তর্ভুক্তির সম্ভাবনা বেড়ে যাওয়া। আমাদের দেশেও বিভিন্ন এলাকার শিশু-কিশোরদের ঝুঁকির পরিমাণ নির্ণয় করার মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি নিলে এ ক্ষেত্রে ভালো উদ্যোগ আসতে পারে বলে মনে করি।
লেখক: উন্নয়নকর্মী, কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই