ব্যাংকখাত সংস্কারে ৮টি বিষয়কে অগ্রাধিকার দিতেই হবে
৩০ নভেম্বর ২০২৪ ১০:২৭
ব্যাংকখাতের সীমাহীন দুর্দশার জন্য দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নই দায়ী। এছাড়া আইন-আদালতের দুর্বলতা এবং ফাঁকফোড়ও কম দায়ী নয়। প্রচলিত ও ইসলামী ধারার ব্যাংকসহ দেশে বর্তমানে ৬২টি বাণিজ্যিক ব্যাংক রয়েছে। এর মধ্যে গুটিকয়েক ব্যাংক ছাড়া অধিকাংশ ব্যাংকই তারল্য সংকটে রয়েছে। আজকের সমাজ-অর্থনীতি বহুলাংশে অর্থপ্রবাহের স্বচ্ছতা, নির্ভরযোগ্যতা ও মসৃণতার ওপর নির্ভরশীল। অর্থের প্রবাহ কোনও না কোনভাবে ব্যাংকগুলোর ওপর নির্ভর করে। দেশের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে এবং রেমিট্যান্স প্রেরণ ও প্রাপ্তিতে ব্যাংকের বড় ধরনের ভূমিকা রয়েছে। ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা নিশ্চিতে অর্থ সঞ্চয়, সুদ-মুনাফা অর্জন আবার আর একপক্ষ ঋণ বা বিনিয়োগ গ্রহণ বা বৃদ্ধি এর মাধ্যমে আয়/প্রাপ্তি করতে ব্যাংকগুলোকে নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে গণ্য করা হয়। আমানতের সুরক্ষা ও উপযুক্ত স্থানে বিনিয়োগ/ব্যবসায় করে টেকসইভাবে টিকে থাকা ব্যাংকখাতের সফলতা।
পতিত স্বৈরাচারী সরকার দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যক্তিগত সম্পত্তির মতো ব্যবহার করে অনিয়মের মাধ্যমে লাখ লাখ কোটি টাকা বের করে নিয়েছে। হাতেগোনা কয়েকজন দুষ্ট ব্যবসায়ীকে এক্ষেত্রে তারা ব্যবহার করেছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর ব্রিটিশ প্রভাবশালী গণমাধ্যম ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অভিযোগ করেছেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা তার শাসনামলে ব্যাংক খাত থেকে ১৭ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৭০০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ অর্থ সরিয়েছেন। তিনি আরও জানান, এর মধ্যে এস আলম গ্রূপের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলম (এস আলম) ও তার সহযোগীরাই নিয়েছেন অন্তত ১০ বিলিয়ন বা ১ হাজার কোটি ডলার। প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা দফতরের (ডিজিএফআই) সাবেক কিছু কর্মকর্তা শীর্ষস্থানীয় ব্যাংক দখল করতে সহায়তা করেছেন। তিনি জানান, এসব ব্যাংক দখল করে আনুমানিক ২ লাখ কোটি টাকা (১ হাজার ৬৭০ কোটি ডলার) বাংলাদেশ থেকে পাচার করা হয়েছে। এভাবে ব্যাংক ও আর্থিক খাত ভয়াবহ খাদের কিনারে পতিত হয়, যার ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে বিরাট শূন্যতা দেখা দেয়। বেড়ে যায় খেলাপি ঋণ। ২০২৪ সালের জুন শেষে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে দুই লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ১৬ লাখ ৮৩ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকার ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ। শুধু তাই নয়, গত ১৬ বছরের মধ্যে বিতরণ করা ঋণ ও খেলাপি ঋণের সর্বোচ্চ অনুপাত এটি। এমন পরিস্থিতিতে ব্যাংক খাত সংস্কারে সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া ব্যাংক খাত সংস্কার সম্ভব নয়।
ইতোমধ্যে ব্যাংক খাত সংস্কারে গঠিত হয়েছে টাস্কফোর্স। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, টাস্কফোর্স আপাতত দুর্বল ব্যাংকগুলোকে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে কাজ করবে। তবে নন ব্যাংক ফাইনান্স প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই) সংস্কারে আপাতত কাজ করছে না। কারণ, আর্থিক খাতে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অ্যাসেট মাত্র ৪ শতাংশ। বেশিরভাগ অর্থই ব্যাংকগুলোতে। এজন্য ব্যাংক খাত নিয়েই আগে কাজ করা হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক সামষ্টিক অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখতে সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নানা ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। যেমন মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি প্রণয়ন, টাকার সরবরাহ হ্রাস, সুদের হার দফায় দফায় বাড়ানোর মাধ্যমে বাজারভিত্তিক করা এবং ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন এবং ক্রলিং পদ্ধতিতে ডলারের দর নির্ধারণের বিষয়গুলো রয়েছে। তবে এ মুহূর্তে ব্যাংক খাতে প্রয়োজন খেলাপি ঋণ আদায়ের মাধ্যমে তারল্য ঘাটতি দূর করা, পরিদর্শনের মাধ্যমে অনিয়ম উদ্ঘাটন এবং আর্থিক খাতের সুশাসন নিশ্চিতের লক্ষ্যে প্রণীত রূপরেখা জনগণকে জানানো, সে অনুযায়ী কাজ শুরু করে দেওয়া।
ব্যাংক খাত সংস্কারে যেসব বিষয় দেখা উচিত তা হল-
১. গ্রাহক সেবার মান বাড়াতে হবে।
২. ব্যাংকের প্রকৃত মালিক কারা, মালিকানা স্বত্ব ও কতৃত্ব কেমন হবে, প্রতিষ্ঠানে তাদের প্রভাব।
৩. সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি) ও বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যে সমন্বয় ও সম্পর্ক থাকা।
৪. আমানতকারীদের ব্যাংকের ওপর আস্থা সুরক্ষা।
৫. বিনিয়োগ বা ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে নিয়মনীতি পরিপালন ও প্রভাবশালীদের বিষয়ে ব্যাবসায়ী ও ব্যাংকের সম্পর্কের বিষয় পরিষ্কার করা।
৬. ব্যাংকের সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও ব্যাংকের স্বাস্থ্য সুরক্ষা সংক্রান্ত বিষয়।
৭. প্রজেক্ট বিনিয়োগ ও অপচয় রোধ, ব্যয় কমানো ও মুনাফা বাড়ানোর বিষয়।
৮. ব্যাংক কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ ও সমাজ কল্যাণ বিষয়ক বিষয়গুলো সম্পর্কে সুস্পষ্ট কাঠামো ও নীতি নির্ধারণ করা ও পদক্ষেপ নেয়া।
এছাড়া খেলাপি ঋণ আদায়ে অর্থ ঋণ আদালত কি যথেষ্ট সেটাও বিবেচনায় থাকা উচিত। রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ীদের কমিটমেন্ট ও তাদের দৃষ্টি ভঙ্গির বিষয়গুলোও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। ব্যবসায়ীদের সুযোগ-সুবিধা প্রদানে অর্থনীতির পরিস্থিতি ও টেকসই অর্থনৈতিক ধারা রক্ষায় রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত অনেক গুরুত্বের দাবি রাখে। ব্যাংক খাত সংস্কারে অর্থনীতির পাশাপাশি রাজনৈতিক উদ্যোগ ও বন্দোবস্ত এ মুহূর্তে খুবই জরুরি।
লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক ও ব্যাংকার
সারাবাংলা/এসবিডিই