এইচএসসির ইংরেজিতে ফল বিপর্যয়ে করণীয়
৬ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৮:৩৮
সাম্প্রতিক সময়ে ২০২৪ সালের এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। সাতটি বিষয়ের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানের ফলে বাকি ছয়টি স্থগিত বিষয়ের পরীক্ষার ফলাফল তাদের এসএসসি পরীক্ষার সাবজেক্ট ম্যাপিং করে ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। মূলত ফলাফলে পাশ/ফেল নির্ভর করেছে ইংরেজি বিষয়ের উপর। ইংরেজি বিষয়ে চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের পাশের হার ছিল মাত্র ৬৮.৮৯%। চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের সামগ্রিক পাশের হার ৭০%। পুরো বাংলাদেশের চিত্রই কম বেশি অনেকটা এই রকম।
ইদানিং ইংরেজি বিষয়ের এই ফল বিপর্যয় নিয়ে চারদিকে হইচই শুরু হয়েছে। শিক্ষাবোর্ড সমূহে এবং সচিবালয়ে অনুত্তীর্ণ পরীক্ষার্থীরা বিভিন্ন অভিযোগসহ ভাঙচুরের ঘটনা পর্যন্ত পত্র-পত্রিকার খবর হয়েছে। বোর্ড কর্তৃপক্ষকেও তাদের সার্বিক নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে মানববন্ধন করতে দেখা গেছে। বিশেষ করে গত দুই দশকে যেখানে এ+ পাওয়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতার মহড়া চলছে সেখানে চট্টগ্রাম বোর্ডের ইংরেজি একটি বিষয়ে ৩১% (প্রায়) পরীক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়েছে। রীতিমতো ডিজাস্টার বলা যায়। যে সময়ে ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ লার্নিং একাডেমিসমূহ ‘English phonetics, Basics, Four skills, CLT, Rhetoric English’ ইত্যাদি নিয়ে মাতামাতি সেখানে আমাদের এক শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা ইংরেজি বিষয়ে অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে।
প্রায় এক তৃতীয়াংশ শিক্ষার্থী ১০০ নাম্বারে ৩৩ নাম্বার পেয়ে উত্তীর্ণই হতে পারেনি। অথচ ‘বেনিফিট অব ডাউট’ সবসময় পরিক্ষার্থীদের পক্ষে যায়। তা সত্ত্বেও ইংরেজি বিষয়ে আমাদের শিক্ষার্থীর বড় একটি অংশ ইংরেজিভীতির যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। নিঃসন্দেহে এটি একটি অ্যালার্মিং নিউজ। মনে হচ্ছে ইংরেজি বিষয়ের মানটা নির্দিষ্ট স্কুল- কলেজের ভিতর সীমাবদ্ধ-একটি নির্দিষ্ট শ্রেণীর ভেতর আবদ্ধ। অনেক আগের এই কনসেপ্ট থেকে আমরা এখনও বের হতে পারিনি। ইংরেজি বিষয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বৈষম্যের ব্যবধানটা দিন দিন বাড়ছে। ২০২৪ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় ইংরেজিতে এ+ এর সংখ্যা বাড়ছে, অপরদিকে ইংরেজিতে অনুত্তীর্ণের সংখ্যাও বাড়ছে।
জেলা শহর এবং মহানগরের অনেক স্কুল-কলেজে শিক্ষার্থীদের ইংরেজি দখল অনেক ভালো। শহর থেকে একটু দূরে গেলেই সূচক অনেক নিম্নগামী। ভাল স্কুল/কলেজগুলো আরও ভালো করছে, অন্যদিকে দুর্বল প্রতিষ্ঠানগুলো আরও দুর্বল হচ্ছে। এইচএসসি পড়ুয়া অনেক শিক্ষার্থীর ইংরেজি বিষয়ের বেসিক লেভেল খুবই প্রশ্নসাপেক্ষ। বিভিন্ন সময় তাদের প্রাথমিকস্তর এবং মাধ্যমিকস্তরের উত্তীর্ণের বিষয়ে প্রশ্নবোধক চিহ্ন আসছে। ছাত্র/ ছাত্রীদের একটা অংশ দুই- তিন মাসে পুরো শিক্ষাবর্ষের সিলেবাস শেষ করে ৯০% এর উপর নাম্বার পেয়ে যায়। অন্যদিকে পুরো শিক্ষাবর্ষে ইংরেজি পড়ে অনেক শিক্ষার্থীদের পাস নাম্বার তুলতে হিমশিম খেতে হয়।
প্রকৃতপক্ষে ইংরেজি বিষয় নিয়ে আগেও বিভিন্ন শিক্ষাবোর্ডের ফলাফল বিপর্যয় হয়েছে। কেন ইংরেজি বিষয়ের কারণে ফলাফল বিপর্যয় হয়? এটা কি করোনা মহামারীর ভয়াবহতা নাকি আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার শিক্ষা পদ্ধতির বিফলতা? প্রথম শ্রেণী থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত টানা ১২ বছর ইংরেজি পড়ে শিক্ষার্থীরা ইংরেজি বিষয়ে দক্ষতা অর্জন তো দূরের কথা, পাসও করতে পারছে না। তাও আবার জেএসসি, এসএসসি, এবং এইচএসসি পরীক্ষার অনেকগুলো কমন আইটেমস/কম্পোনেন্টস এ পরীক্ষা হয়। যেমন- ‘Seen Passage’ থেকে ‘MCQ, Question Answer, Cloze Test with Clues, Cloze Test without clues, Re-arrange, Letter, Paragraph, Application, Article, Preposition, Right form of Verb,Narration, Punctuation and Capitalization, Graph/Chart, Completing Sentence, Transformation of Sentence’। বলতে গেলে ৬০ ৭০% সিলেবাস জেএসসি, এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষায় একই। মাধ্যমিক পর্যায়ে এতগুলো আইটেমস এর সাথে পরিচিত হওয়ার পরও এইচএসসি পরীক্ষায় ইংরেজি বিষয়ে এত অকৃতকার্য কেন?
মূলত ভার্সিটি এবং মেডিকেল এডমিশন টেস্টের সময় শিক্ষার্থীদের ইংরেজি বিষয়ের দুর্বলতার চিত্রটি ভালোভাবে ফুটে ওঠে। এডমিশন টেস্টের প্রশ্ন মুলত বেইসিক লেবেলের। এই সময় এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষায় এ এবং এ+ পাওয়া শিক্ষার্থীদের ভর্তি পরীক্ষায় পাস মার্ক নিয়ে হিমশিম খেতে হয়। গত বছর পাসের হার ৭০% এর উপরে থাকা অনেক কলেজ এ বছর পাশের হার ৫০% এর নিচে। তাছাড়া অনেকগুলো কলেজের পাশের হার ৪০% নিচে। বছর বছর ফলাফলে এত নাটকীয় পরিবর্তনের কারণ কি? শিক্ষাবোর্ড ইংরেজি বিষয়ের ফলাফল বিপর্যয়কে একটি অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করছেন। অথচ ইংরেজি বিষয়ের প্রশ্ন বিগত সাত-আট বছরের মধ্যে সবচেয়ে সহজ প্রশ্ন ছিল।
সম্ভাব্য করণীয়
১. ফলাফল উত্তরণ তথা মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতকরণে মাউশি (মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর) এবং শিক্ষাবোর্ডসমূহ ছাত্র-ছাত্রীদের শ্রেণিকক্ষে উপস্থিতি, শ্রেণী কার্যক্রম মনিটরিং, এবং অভিভাবক সমাবেশ ফলপ্রসু করার ব্যাপারে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জোরারোপ করতে পারেন।
২. ফরম পূরণের সময় শিক্ষাবোর্ডের বিধি নিষেধ পুরোপুরি মেনে চলা। নির্বাচনী পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ পরীক্ষার্থীরা যাতে ফরম পূরণের আওতায় না আসে সেদিকে বোর্ড কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি রাখা।
৩. ইংরেজি বিষয়কে আরও সহজসাধ্য করার জন্য বিশেষ করে কম্পোজিশন পার্ট এ অপশনের (২/৩) ব্যবস্থা করা।
৪. সম্মানিত পরীক্ষকগণের মধ্যে নাম্বারের তারতম্য কমানোর জন্য শিক্ষাবোর্ডের আলোচনার (কর্মশালা) পাশাপাশি প্রতিটি বিষয়ের প্রতিটি পত্রের জন্য একটি করে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ (অন্য কোন অ্যাপস) এর মাধ্যম থাকলে নবীন, প্রবীণ সম্মানিত পরীক্ষকগন দুই মাস ব্যাপী কর্মযজ্ঞে প্রতিনিয়ত তাদের মতামত শেয়ার করতে পারবেন।
৫. যে সমস্ত কলেজের ফলাফল ৫০% এর নিচে সে সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহকে নিয়ে শিক্ষাবোর্ডসমূহ শিক্ষার মানোন্নয়ন এবং ফলাফল উত্তরণ শীর্ষক একটি কর্মশালার আয়োজন করতে পারেন। ২০২০ সালের আগে চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডসহ কয়েকটি বোর্ডে ফলাফল পরবর্তী (ইংরেজি এবং আইসিটি শিক্ষকদের নিয়ে) এই ধরনের আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হতো।
৬. শিক্ষাবোর্ডসমূহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে ছাত্র-ছাত্রীদের সুষম বিতরণ ব্যবস্থা (লটারির মাধ্যমে) নিশ্চিত করতে পারেন। অনেক এমপিও ভুক্ত কলেজে প্রতি শিক্ষাবর্ষে ১২০০ থেকে ২৪০০ জন ছাত্র-ছাত্রী থাকে। অপরদিকে অনেক প্রতিষ্ঠান ছাত্র-ছাত্রীর অভাবে (ভর্তির ক্ষেত্রে রিকোয়ারমেন্ট জিপিএ ১/২ দেওয়ার পরও) অস্তিত্ব সংকটে পড়ছে যদিও একই মানের শিক্ষকেরা পাঠদান করে আসছেন। ছাত্র-ছাত্রী ভর্তির ক্ষেত্রে যদি সুষম বণ্টন হয় তাহলে শিক্ষার্থীরা যেভাবে উপকৃত হবে, ছাত্রসংকটে পড়া প্রতিষ্ঠানসমূহ ও নতুন গতি পাবে। সর্বোপরি, শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণের মাধ্যমে এই সমস্যা অনেকাংশেই সমাধান হবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক (ইংরেজি), চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষক, নিরীক্ষক, পুনঃনিরীক্ষক
সারাবাংলা/এসবিডিই