স্বাধীনতার আগে সাহস নিয়ে প্রশ্ন
৬ ডিসেম্বর ২০২৪ ২০:৫১ | আপডেট: ৭ ডিসেম্বর ২০২৪ ১০:৩২
কয়েকদিন আগে সহকর্মীদের সঙ্গে এক গল্প আড্ডার আলাপে উঠে এলো— বাংলাদেশের সাংবাদিকদের যদি শতভাগ পূর্ণ স্বাধীনতা নিয়ে সাংবাদিকতা করতে বলা হয়, অর্থাৎ যদি এমন করেও বলা হয় যে দায়িত্বশীলতার সঙ্গে বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা করার জন্য কোনো আঘাত বা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি একদমই হতে হবে না, তবু তারা স্বাধীন সাংবাদিকতা করবেন না। কারণ বাংলাদেশের সাংবাদিকদের মধ্যে একটি বড় অংশ এতই দলদাস ও ব্যক্তিদাস হয়ে আছেন যে তারা সেই দাসত্বের শেকল ভেঙে বাইরে আসতে পারবেন না। এই বড় ভাই কী মনে করবেন, ওই বড় ভাই কী ভাববেন, নিউজ লিখে সম্পর্ক নষ্ট করব কেন— এ ধরনের প্রশ্নের বেশে চারদিক থেকে ঘিরে ধরে সেলফ সেন্সরশিপ। এটা বাংলাদেশে অনেকটা রীতিতে পরিণত হয়ে গেছে।
আবার সাংবাদিকতায় স্বাধীনতার মানেও এই নয় যে আপনার মনখুশি বা খেয়ালখুশি অনুযায়ী যে কারও বিরুদ্ধে দুয়েক লাইন লিখে দেবেন বা রিপোর্ট করে দেবেন। স্বাধীন সাংবাদিকতা মানে এই নয় যে যা ইচ্ছা মিথ্যা বা অসত্য লিখে দেবেন, কিন্তু কিছু বলা যাবে না বা প্রতিবাদ জানানো যাবে না। কোনো পেশার কোনো মানুষই জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে নয়।
বাংলাদেশে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের একচেটিয়া শাসনামলে সাংবাদিকরা হুমকির মুখোমুখি হয়েছেন, নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়েছেন, এগুলো চরম বাস্তব। এরপর ৫ আগস্ট সেই সরকারের পতনের পর দায়িত্ব নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। জাতীয় নির্বাচন হলে ভবিষ্যতে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আসবে। এখন আওয়ামী লীগ বিদায় নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যে সাংবাদিকতা থেকে সব ধরনের বাধা বা প্রতিবন্ধকতা অপসারণ হয়ে গেছে, এমনটি কিন্তু নয়। তবে আমাদের অতীত থেকে শিক্ষা নিতে হবে। ওই সব বাধা বা প্রতিবন্ধকতা দূর করে স্বাধীন সাংবাদিকতা নিশ্চিত করার জন্য কাজ করতে হবে।
আগে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ বিভিন্ন দফতর থেকে চাপ প্রয়োগ করে অনলাইনে প্রকাশিত খবর ‘নামিয়ে ফেলা’র মতো অপসংস্কৃতি যেন দেশে ফিরে না আসে, সেই অঙ্গীকার হোক ভবিষ্যতের সব সরকারের। যে ব্যবস্থায় ক্ষমতাকে প্রশ্ন করা যায় না, ক্ষমতার জবাবদিহিতা থাকে না, সেখানে কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা তৈরি হবেই। সেই কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থা ভাঙতে হলেও স্বাধীন ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা জরুরি।
আগের সরকার আমলে মানুষের লেখালেখিতে আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ), সাইবার নিরাপত্তা আইনসহ (সিএসএ) সাংবাদিকতায় প্রতিবন্ধকতা তৈরির করার মতো কালো আইনগুলো করা হয়েছিল জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা ভেঙে ফেলতে। এসব আইনের বিরুদ্ধে ব্যক্তি থেকে শুরু করে দল, সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠান, সংগঠনসহ বিশিষ্টজনরাও ক্ষোভ জানিয়েছিলেন, আপত্তি তুলেছিলেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার সেসব আপত্তি কানে তোলেনি। নানা মহলের সমালোচনার মুখে একাধিকবার আইন সংস্কারের কথা বললেও নতুন মোড়কে মূলত কার্যকর হয় পুরনো আইনগুলোই।
এসব কালাকানুনের জন্যই কার্টুন এঁকে বা সংবাদ লিখে জেল-জুলুম, নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে দেশের বহু সাংবাদিককে। তারপরও জাতীয় ও স্থানীয় গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলো নানাভাবে পেশাদারিত্ব বজায় রেখে সাংবাদিকতা করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। ‘কোট-আনকোট’ করে হলেও বিভিন্ন দাবি আদায়ে জনগণের পক্ষে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে লিখে যাচ্ছে। ঝুঁকি জেনে এবং মেনে নিয়েই এই পেশায় কাজ করে যাচ্ছেন সাংবাদিকরা।
আমার কাছে বরাবরই মনে হয়েছে, বাংলাদেশে সাংবাদিকতায় স্বাধীনতার আগে সাহস নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। আপনি কিংবা সাংবাদিকরা যদি সাহস নিয়ে লিখে যান, ক্ষমতাকে প্রশ্ন করেন, তাহলে আপনার বিরুদ্ধে বিভিন্ন ট্যাগিং, প্রশ্ন, প্রোপ্রাগান্ডা, কুৎসা রটানোর মতো ঘটনাও যে ঘটবে না, তা নয়। সাংবাদিকতা পেশাটাই চ্যালেঞ্জিং। ফলে প্রতিবন্ধকতা বা ভয়ের মুখে চ্যালেঞ্জ থেকে পিছিয়ে গিয়ে মুখ লুকিয়ে থাকলে সেটি কর্তৃত্ববাদীদের অপশাসনের পক্ষেই যায়, জুলুম-নির্যাতন বেড়ে যায়। সাহস নিয়ে লিখতে পারলে তারপরই তো আসবে স্বাধীনতার প্রশ্ন। কোনো কাজ না করে সেই স্বাধীনতা নিয়ে আদতে সাংবাদিকরা করবেন কী?
সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবেই অগ্রসর ভূমিকা রাখতে পারেন সাংবাদিকরা। সাংবাদিকতাকে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভও বলা হয়ে থাকে। এখন রাষ্ট্রের একটি স্তম্ভের দায়িত্ব নিয়ে যদি সেই স্তম্ভকে অকার্যকর করে রাখা হয়, তাহলে রাষ্ট্রের একটি স্তম্ভ প্রতীকী স্তম্ভ হয়েই থাকবে।
নিজের কথা যদি দুয়েক লাইন বলি— খুব বেশি দিন না— ২০১৬ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে সাংবাদিকতা ও লেখালেখির সঙ্গে সম্পৃক্ত। শুরুতে ফিচারভিত্তিক লেখায় মনোযোগী হলেও পরে রিপোর্টিং শুরু করি। জেলা তথা মফস্বলে থেকে কাজ করার কারণে নগর সাংবাদিকতার চেয়ে এখানকার পরিবেশ অনেকটা ভিন্ন বলেই মনে হয়। এখানে আপনাকে একই সঙ্গে রাজনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অপরাধ, আইন-আদালত, পরিবেশ-কৃষি, শিল্প, সাহিত্য-সংস্কৃতি শুরু করে এমন কোনো বিট নেই যেটি নিয়ে কাজ করতে হয় না। এ ক্ষেত্রে নগর সাংবাদিকদের চেয়ে অনেকাংশে মফস্বলের সাংবাদিকদের বিভিন্ন ক্ষেত্রেই যোগাযোগটা বেশিই রাখতে হয়।
এখন সব বিটে কাজ করার কারণে সব দিক থেকেই মানসিক চাপ, হুমকি, ঝুঁকি মোকাবিলার প্রস্তুতি নিয়েও চলতে হয়। রাজনৈতিক বিটের রিপোর্টিংয়ের ক্ষেত্রে রাজনীতির দলগুলোর স্থানীয় পর্যায়ে গ্রুপিং বা উপদলীয় তৎপরতার কারণে সংবাদ পরিবেশন নিয়ে ঝুঁকি রয়েছে। রাজনৈতিক নেতাদের অবৈধ দখলদারি, টেন্ডার বাণিজ্য, দলীয় পদ বাণিজ্যসহ পেশীশক্তির আস্ফালনের মধ্যেও বস্তুনিষ্ঠতা ধরে রেখে কাজ করে যাওয়াটা ভীষণ চ্যালেঞ্জিং। আমলাতন্ত্রের প্রভাব-বিস্তার তো আছেই।
বাংলাদেশে বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে বিভিন্ন গণমাধ্যম ও রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে কার্যত ইতিবাচক পদক্ষেপ নেই। মুখে নানা নীতিকথা বললেও বাস্তবতায় বেশ ফাঁরাকের কারণে বস্তুনিষ্ঠতার চর্চা কঠিন হয়ে উঠেছে। এসব কারণে সাংবাদিকতায় মেধাবী, কর্মঠ ও নীতি সম্পন্ন মানুষ আগের চেয়ে কমে আসছে। এর বিপরীতে আবার আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকার অনুমোদন, একই ধরনের অসত্য, অপতথ্য একাধিক পত্রিকায় কপি-পেস্টের মাধ্যেম ছাপার প্রবণতা তৈরি হয়েছে, যা দিন বাড়ছেও।
বিগত সরকার আমলে সরকারিভাবে রাজনৈতিকসহ বিভিন্ন কারণে আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে ব্যাপক হার। এতে সাংবাদিকতার মাঠকে জগাখিচুড়ি করে তোলা হয়েছে। ডিএফপি তালিকায় দেশের পত্রিকাগুলোর প্রচার সংখ্যা ও র্যাংকিং তো রীতিমতোর হাসি-তামাশার উপলক্ষে। এসব থামাতে হবে। অতীত অভিজ্ঞতার কারণে এসব বিষয়ে রাজনৈতিক সরকারের কাছ থেকে সত্যিকার অর্থে কিছু প্রত্যাশা করার খুব একটা কারণ নেই। তবে আশা করি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গঠন করা গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন এসব বিষয়ে কিছু হলেও কাজ করে দিয়ে যাবে।
চূড়ান্ত আলাপ হলো— পৃথিবীর কোনো দেশেই সাংবাদিকতা শতভাগ স্বাধীনতার পূর্ণ নয়। সবখানেই সেন্সরশিপ রয়েছে— কোথাও কম বা কোথাও বেশি, কোথাও রয়েছে সেলফ সেন্সরশিপ তো কোথাও সরকার বা সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে চাপিয়ে দেওয়া। এসব কিছুকে এড়িয়ে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা থেকে শুরু করে ডাটা জার্নালিজম তথা তথ্য-পরিসংখ্যাননির্ভর সাংবাদিকতা, এক্সপ্লেইনার তথা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণমূলক প্রতিবেদন পরিবেশনও থেমে নেই। সেই চর্চা অব্যাহত রাখতে হবে আমাদেরও।
সবচেয়ে বড় কথা, পেশাদার সাংবাদিকতার চর্চা দৃঢ় করতে হবে। পাশাপাশি সাংবাদিকতার নামে জনমানুষের চরিত্রহনন, ব্যক্তিগত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ কিংবা গণবিরোধী কার্যক্রমও বন্ধ করতে হবে। কেবল স্বাধীনতা ভোগ করতে চাইলে হবে না, প্রকৃত স্বাধীনতা রক্ষায় সৎ সাহস থাকাটাও জরুরি।
লেখক: সাংবাদিক
সারাবাংলা/টিআর