৫৪ বছরের পারিবারিক শাসন ফেলে কেন পালালেন বাশার?
৮ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৪:৫৫ | আপডেট: ৯ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৪:২২
এক দশক ধরেই দেশের গৃহযুদ্ধ ও পদত্যাগের জন্য বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চাপ সামলে চলছিলেন তিনি। আরব বসন্তের শুরু থেকেই নড়বড়ে ছিল সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের অবস্থান। কিন্তু রাশিয়াসহ বিদেশী বন্ধু, হিজবুল্লাহর মতো আঞ্চলিক শক্তিগুলোর সহযোগিতায় পরিস্থিতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে এনেছিলেন তিনি। কিন্তু শেষরক্ষা আর হলো না। সম্প্রতি বিদ্রোহীদের কাছে একের পর এক শহরের পতনের পর সবাই আশংকা করছিলেন এবার বোধহয় আর গদি বাঁচাতে পারবেন না আসাদ। অবেশেষে সেই আশংকাই সত্যি হলো। স্থানীয় সময় ৮ ডিসেম্বর, মঙ্গলবার মাঝরাতের পর ব্যক্তিগত বিমানে করে রাজধানী দামেস্ক নগরী থেকে পালালেন চব্বিশ বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্যের দেশটির রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকা বাশার।
বাশার আল-আসাদের নেতৃত্বাধীন আরব সোশ্যালিস্ট বাথ পার্টি আজকের আগ পর্যন্ত সাংবিধানিকভাবে সিরিয়ার সরকারি দল ছিল। প্রায় ৫৪ বছর ধরে দেশটির রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিলো বাশার আল আসাদের পরিবার। শুরুটা বাশারের বাবা সাবেক সিরীয় রাষ্ট্রপতি হাফেজ আল-আসাদের হাত ধরে। হাফেজ আল-আসাদ ছিলেন ইরাকি নেতা সাদ্দাম হোসেইনের সমকালীন শাসক। ১৯৭১ থেকে ২০০০ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রায় তিন দশক ধরে সিরিয়ার রাষ্ট্রপতি ছিলেন। হাফেজ এমন এক সময় সিরিয়ার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিয়েছিলেন যখন অভ্যুত্থান, পাল্টা-অভ্যুত্থান ও একের পর এক অস্থিতিশীল সামরিক-বেসামরিক শাসনে জর্জরিত ছিল দেশটি। হাফেজ ক্ষমতা গ্রহণের আগেই সিরিয়া বাথ পার্টির একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যা রাষ্ট্রভার গ্রহণের পর হাফেজ পরিবর্তন করেননি।
একদলীয় শাসনব্যবস্থা পরিবর্তন করেননি বাশার আল আসাদও। অথচ ২০০০ সালে এক বছরের ব্যবধানে বড়ভাইয়ের দুর্ঘটনায় মৃত্যু ও রাষ্ট্রপতি বাবার হঠাৎ মৃত্যুর পর রাষ্ট্রক্ষমতা পেয়ে যাওয়া বাশার বলেছিলেন তিনি এই একদলীয় শাসনের অবসান ঘটাবেন। বাশারের বাবার মৃত্যুর সময়ে দেশকে একনায়কতন্ত্রের দিকে ঠেলে দেওয়ার সমালোচনার তীর সরাতে পশ্চিমা শিক্ষায় সুশিক্ষিত বাশার ক্ষমতা নিয়েই বেশকিছু সংস্কারের প্রস্তাব দেন। এতে রাতারাতি তার জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বি হয়। কিন্তু তার দুই যুগের শাসনামলে সেই প্রতিশ্রুত সংস্কারের দেখা মেলেনি। বরং অভিযোগ আছে বাবার দেখানো পথেই সিরিয়া শাসন করেছেন বাশার।
যদিও সিরিয়ার শাসনভার গ্রহণের শুরুর দিকে অবশ্য যথেষ্ঠ জনপ্রিয় ছিলেন বাশার। লন্ডনে চিকিৎসাবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করা বাশারের ওই অর্থে রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্খা ছিল না বা তাকেও পিতার উত্তরসূরী হিসেবে ভাবা হতো না। বাশারের বড়ভাই বাসেল আল আসাদই ছিলেন হাফেজ আল আসাদের উত্তরসূরী। কিন্তু ১৯৯৪ সালে বাসেলের সড়ক দুর্ঘটনায় মর্মান্তিক মৃত্যু বাশারকে দৃশ্যপটে এনে দেয়। এরপর ২০০০ সালে বাবার মৃত্যুর পর বাশার বাথ পার্টির আঞ্চলিক সচিব ও সর্বসম্মতভাবে দেশটির প্রেসিডেন্ট হন। এরপর সেইসময়ে শিক্ষার আধুনিকায়নসহ তার বেশকিছু পদক্ষেপ তাকে দেশে দ্রুত জনপ্রিয় নেতায় পরিণত করে তোলে। অবশ্য এর পেছনে তার বাবা হাফেজ আল আসাদের ৩০ বছরের শাসনে দেশকে ক্রমাগত উন্নত করার প্রয়াসের একটি ভূমিকা ছিল। আসাদও সেই ধারা বজায় রাখতে পেরেছিলেন।
কিন্তু ২০১০ সালের শেষের দিকে মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়া ধারাবাহিক গণআন্দোলন ‘আরব বসন্ত’ এসে সিরিয়া ও বাশার আল আসাদের অনেককিছুই উল্টাপাল্টা করে দেয়। সে সময় আরব বসন্তের ঢেউ লেগেছিল সিরিয়াতেও। আরব বিশ্বে মিশর, লিবিয়া, তিউনিশিয়া, ইয়েমেনের তাবড় বাঘা নেতারা ক্ষমতা হারালেও টিকে যান আসাদ। ২০১১ সালে সিরিয়ায় বাশারের বিরুদ্ধে সেই তীব্র গণবিক্ষোভে তার ক্ষমতা শেষ হয়েছিল বলেও ধরে নিয়েছিলেন অনেকেই। কিন্তু সেই দফায় নিজের গদি বাঁচাতে পারলেও গৃহযুদ্ধের কবলে পড়ে সিরিয়ার বড় অংশের মানচিত্রের ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ হারান। এছাড়া সিরিয়ায় জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট বা আইএসের উত্থানে রাজনৈতিকভাবে ভীষণ অস্থির ছিল দেশটি। এই সবকিছুর জেরে দেশটি গৃহযুদ্ধের মুখে পড়ে যায়।
সিরিয়ায় এই গৃহযুদ্ধ ও আরব বসন্তের পর থেকেই সিরিয়ায় বিশ্বের পরাশক্তিগুলো একের পর এক হস্তক্ষেপ করতে শুরু করে। সেই সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনীতিতে সিরিয়ার প্রভাব বেড়েছিল হঠাৎই। একইসাথে বিভিণ্ন সময়ে বিভিন্ন বিদ্রোহী গোষ্ঠীকে সমর্থন দিয়ে সিরিয়াকে অস্থিতিশীল করতে ভূমিকা রাখছিল যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, তুরস্কসহ আঞ্চলিক কিছু দেশ। একপর্যায়ে দেশটিতে শান্তিরক্ষায় মার্কিন ও তুরস্ক বেশকিছু সেনাঘাঁটি স্থাপন করে। এরমধ্যেও বিদ্রোহীদের কাছ থেকে ভূখণ্ড উদ্ধারে চেষ্টা চালান বাশার। রাশিয়ার সহযোগিতায় ইদলিব শহর ছাড়া দেশের অধিকাংশ বড় অঞ্চল ফেরতও পান তিনি। যদিও এই গৃহযুদ্ধে বাশারের বিরুদ্ধে মানবাধিকার ও বিভিন্ন প্রেসার গ্রুপগুলো ছিল ভীষণ সোচ্চার। তারা দাবি করতে থাকে, ২০১১ সালে দেশটিতে গণতন্ত্রীপন্থীদের বিক্ষোভে সশস্ত্র বাহিনীর অভিযানের পর দেশটিতে সংগঠিত গৃহযুদ্ধে অন্তত পাঁচ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। প্রায় দেড় কোটি মানুষ ঘরবাড়ি হারিয়েছেন। এছাড়া বিদ্রোহী ও জঙ্গিদের আস্তানায় বোমা হামলা এবং রাসায়নিক হামলার বিষয়ে মানবাধিকার সংগঠনগুলো বাশারের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। ফলশ্রুতিতে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাশার প্রায় ব্রাত্য হয়ে ওঠেন।
এতোকিছুর মধ্যে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ব্রাত্য বাশারের প্রতি ইরান আর রাশিয়ার সমর্থন বরাবরই ছিল। আরও ছিল লেবাননভিত্তিক ইসলামপন্থী রাজনৈতিক ও সশস্ত্র দল হিজবুল্লাহর সমর্থন। এই তো মাত্র পাঁচদিন আগেই যখন সিরিয়ার বিদ্রোহীদের অগ্রযাত্রা যখন তুঙ্গে তখনও আসাদের প্রতি সমর্থন জানিয়েছিল রাশিয়া। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দুদিন আগেই সিরিয়াকে বিশৃংখল রাষ্ট্র আখ্যায়িত করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যা লিখেছিলেন সেটি অনেকটা এমন- সিরিয়ায় যে যেভাবে পারে খেলুক। এর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কোনও সম্পর্ক নেই বা যুক্তরাষ্ট্রের এর মধ্যে জড়ানোরও কোনও প্রয়োজন নেই। যদিও সিরিয়ায় এখনো অন্তত ৯০০ মার্কিন সেনা রয়েছে। তারা সিরিয়ার উত্তর পূর্বাঞ্চলে আইএস যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে সিরিয়ার কুর্দি নেতৃত্বাধীন জোটের পক্ষে যুদ্ধ করছে। তবে ট্রাম্পের এই ঘোষণার পরপরই বাশার আল আসাদের এই পতন বিস্ময়জাগানিয়া।
শেষদিকে অবশ্য বাশার আল আসাদ তথা দামেস্কের পতন হয়েছে খুব দ্রুত। নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে হঠাৎই ইসলামি সংগঠন হায়াত তাহরির আল শামের (এইচটিএস) নেতৃত্বে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো একজোট হয়ে সরকারি বাহিনীর ওপর হামলা শুরু করে। আল-কায়েদার ট্রেনিং পাওয়া সশস্ত্র বিদ্রোহীদল এইচটিএসের নেতৃত্বে আকস্মিক এই আক্রমণে কার্যত হতভম্ব সরকারি বাহিনী দ্রুত পিছু হঠলে বিদ্রোহীরা সিরিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর আলেপ্পো দখল করে নেয়। দেশটির বড় নগরী আলেপ্পোর পর একদিন আগে বিদ্রোহীরা সিরিয়ার অন্যতম বড় শহর দারা ও মধ্যাঞ্চলের নগর হোমস দখলের পর দামেস্কের পতন বেশ আন্দাজ করা যাচ্ছিল। শেষদিকে খুবই দ্রুত বাশার তথা বার্থ পার্টির দূর্গ দামেস্ক দখল করল বিদ্রোহীরা।
তবে শেষদিকে অল্পকদিনের মধ্যে বাশারের এই পতন অবাক করেছে অনেককেই। অনেকেরই ভাবনা, ২০১৪ সাল থেকে রাশিয়া, ইরান ও হিজবুল্লাহর সাহায্য দিয়ে দামেস্ককে প্রায় দূর্গ হিসেবে গড়ে তোলা বাশারকে কীভাবে মাত্র ১১ দিনের মধ্যে বিদায় করে দিল এইচটিএসের নেতৃত্বে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো। এই বিষয়ে খ্যাতনামা নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বিভিন্ন ব্যখ্যা দিয়েছেন-দিচ্ছেন। তাদেরই একজন ইস্ট সাউথ এশিয়া সেন্টার ফর সিকিউরিটি স্টাডিজের সহযোগী অধ্যাপক ডেভিড ডেস রোচেস কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরাকে বলেছেন, ‘সিরিয়ায় বিদ্রোহীদের দ্রুত সফল হওয়ার মূল কারণ আসাদের সেনাবাহিনীর নেতৃত্বের অভাব। আর দ্বিতীয় কারণটি মনোবলের। দীর্ঘ কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থায় থাকতে থাকতে সেনাবাহিনী মনোবল হারিয়ে ফেলেছিল বলে অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে।’
তবে এটাও ঠিক যে সিরিয়া থেকে বিশ্ব রাজনীতির রথী-মহারথী দেশগুলোর আগ্রহ কমে গিয়েছিল গত দুই বছর ধরেই। আঞ্চলিক রাজনীতিতেও সিরিয়াকেন্দ্রিক কূটনৈতিক দ্বন্দ প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র বেশ কিছুদিন সিরিয়া সম্পর্কে আগ্রহ দেখায়নি। সরিয়ে নিয়েছিল দেশটিতে মোতায়েন করা সেনাদের একাংশ। তুরস্কও তাদের সেনা সরিয়ে নিয়েছিল। সেনা সরিয়ে নিয়েছিল ইরান তথা হিজবুল্লাহও। এসবের ফলশ্রুতিতে গত দুই বছরে দেশটি থেকে রাশিয়া তাদের প্রক্সিযুদ্ধের আবহ কমিয়ে বিমান সরিয়ে নেয়। এছাড়া ইউক্রেনে তাদের নিজেদের যুদ্ধ নিয়েও তারা ব্যস্ত। এছাড়া অঞ্চলভিত্তিক কূটনৈতিক পরিমণ্ডলে একটা আলোচনা ছিল, সিরিয়ার দায়িত্ব আরব বিশ্বের আঞ্চলিক নেতারাই নিক। আর এই সবকিছুর পরিণতিতে আসাদের ভাগ্যের কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুঁকে গত সপ্তাহে ট্রাম্প বলেছিলেন, ‘যুদ্ধটা আমাদের নয়।’
নিজের ব্যক্তিগত বিমানে করে দেশছাড়া আসাদ কোথায় গিয়েছেন এখনও জানা যায়নি। তবে এটা ঠিক ২০০০ সালে হাফেজ আল আসাদের মৃত্যুর পর যে আশা নিয়ে সিরিয়ার জনগণ ও আরব সোশ্যালিস্ট বাথ পার্টি বাশার আল আসাদকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন সেটি পূরণ করতে পারেননি তিনি। ক্ষমতাগ্রহণের প্রথমদিকে বাশার অর্থনৈতিকভাবে বেশ ভালো করলেও তার শাসনামলের শেষ একযুগে আর্থিক, সামাজিক সবদিক থেকে প্রায় ভেঙে পড়েছিল সিরিয়া। জনগণের জীবনমান হয়ে পড়েছিল করুণ। বিপুল বৈদেশিক ঋণ, সীমাহীন মূল্যস্ফীতি, বিপর্যস্ত অর্থনীতি, ব্যাপক দারিদ্র মিলিয়ে সিরিয়াতে যেন এক মানবিক বিপর্যয় তৈরি হচ্ছিল। তাই খাদের কিনারায় থাকা বাশারকে অল্পকদিনের মধ্যে ক্ষমতাচ্যুত করতে তেমন বেগ পেতে হয়নি বিদ্রোহীদের।
পালিয়েছেন সিরিয়ার দুই যুগের প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ, পেছনে ফেলে গেছেন দেশটি শাসনে তার পরিবারের ৫৪ বছরের ইতিহাস। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত সিরিয়ার দায়িত্ব নিয়েছেন বাশারের মন্ত্রীসভার প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ ঘাজি আল-জালালি। জালালি বলেছেন, দেশের এই সংকটকালে কোথাও পালাবেন না তিনি। বরং দেশের সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম চলমান থাকার বিষয়ে নিশ্চয়তা চান। বিদ্রোহীরাও তাকে সমর্থন দিয়েছে। এবার দেখার বিষয় এইচটিএসের নেতৃত্বে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো প্রায় বিধ্বস্ত সিরিয়াকে কোথায় নিয়ে যান।
লেখক: সংবাদকর্মী
সারাবাংলা/এসবিডিই