চর উন্নয়নে প্রয়োজন আলাদা মন্ত্রণালয়
২২ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৮:৪১ | আপডেট: ২২ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৮:৪২
পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ বাংলাদেশ। হাজারও নদী জালের মতো ছড়িয়ে রয়েছে দেশজুড়ে। বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ৫৭টি আন্তঃসীমান্ত নদীসহ সর্বমোট ৪০৫টি নদী প্রবাহিত হচ্ছে। মিশরের নীল নদ যেমন মিসরের প্রাণ, তেমনি পদ্মা, মেঘনা, যমুনা বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণ। ঢাকার মূল ভিত্তি তৈরী করেছে তার নদীগুলো বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু প্রভৃতি নদী। শরীরের রক্তশিরার মতোই বাংলাদেশের নদী এদেশকে বাঁচিয়ে রেখেছে। অন্যদিকে বন্যা ও নদী ভাঙ্গনের বাংলাদেশের ৩২টি জেলার শতাধিক উপজেলার অসংখ্য চর ও নদী অববাহিকায় বসবাসরত মানুষ প্রতি বছর সীমাহীন ক্ষতির সম্মুখীন হয়। প্রতিবছর প্রায় ৫,০০০ থেকে ৬,০০০ হেক্টর জমি নদীভাঙ্গনে হারিয়ে যায়। এই ভাঙ্গনের ফলে প্রতি বছর প্রায় এক লক্ষ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নদীভাঙ্গনের ফলে প্রতিবছরে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ২৫ কোটি ডলার।
দেশের সবচেয়ে দরিদ্রতম জেলা কুড়িগ্রামের ওপর দিয়ে প্রবাহিত ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, তিস্তা, দুধকুমরসহ ১৬টি নদ-নদীর অববাহিকায় রয়েছে সাড়ে চার শতাধিক চর। জেলার জনসংখ্যা ২৩ লাখের কিছু বেশি এবং এই জনসংখ্যার ৫ থেকে ৬ লাখ লোক চর এলাকায় বসবাসা করে এবং চর এলাকার আয়তন মোট ভূমির ২২%। বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি পানি বহনকারি নদী ব্রহ্মপুত্র নদ কুড়িগ্রাম জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত। নদী বেষ্টিত হওয়ায় প্রতিবছর সবগুলো উপজেলা বন্যায় ৩-৪ বার আক্রান্ত হয়। জেলার সবকটি উপজেলার নদী তীরবর্তী ৪১টি ইউনিয়নের দুইশতাধিক গ্রামের লক্ষাধিক মানুষ ও গবাদি পশু পানি বন্দি হয়ে পড়ে এবং গড়ে প্রতি বছর জেলায় ২ হাজার ৩৬১ হেক্টর জমির বিভিন্ন ফসল বিনষ্ট হয়। জেলার চরাঞ্চলের বাসিন্দাদের দু:খ-কষ্টের সীমা পরিসীমা নেই। প্রায় ২৩ লাখ জনসংখ্যার মধ্যে দারিদ্রের হার ৭০.৮ শতাংশ এবং অতি দরিদ্রের হার ৫৩.২ শতাংশ। এর মধ্যে জেলার রাজীবপুর উপজেলার ৭৯ দশমিক ৮০ শতাংশ মানুষই দরিদ্র যা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী চাকমাদের দারিদ্রের হারের চেয়েও অনেক বেশি। অথচ সারা দেশে এখন দারিদ্রের হার ১৮.৭%। কুড়িগ্রাম ভৌগোলিকভাবে নদী ও চরবেষ্টিত হওয়ায় অন্যান্য জেলার চেয়ে এ জেলার সমস্যাগুলো অন্য জেলা বা অঞ্চল থেকে অনেকটা ভিন্ন ধরণের। তাছাড়াও এ জেলার অধিকাংশ চর স্বাধীনতার পর হতে অদ্যাবধি সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডের আওতায় আসেনি, যে কারণে চরাঞ্চলের মানুষের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হয়নি। এ অঞ্চলে একটি কথা প্রচলিত আছে যে, ‘চরের জীবন পরের জীবন’। অর্থাৎ কুড়িগ্রামের চরের মানুষের জীবন ও জীবিকা অন্যের উপর নির্ভর করে অথবা দয়ায় পরিচালিত হয়। কুড়িগ্রামসহ সারাদেশের চরাঞ্চলে প্রায় ১০ মিলিয়ন সহায় সম্বলহীন মানুষের বাস যা দেশের মোট জনসংখ্যার ২০ ভাগের এক ভাগ। উন্নয়নের জন্য চরকেন্দ্রিক একটি আলাদা মন্ত্রণালয় গঠন বর্তমান প্রেক্ষাপটে অতি প্রাসঙ্গিক এবং এ সংক্রান্ত নিদর্শন ও দৃষ্টান্ত রয়েছে।
চর উন্নয়নের জন্য আলাদা মন্ত্রণালয় গঠনে দৃষ্ঠান্ত হিসেবে পার্বত্য চট্রগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠনের কথা উল্লেখ করা যায়। পার্বত্য চট্রগ্রাম জেলা সৃষ্টি হয় ১৮৬০ সালে বৃটিশ শাসন আমলে; তার আগে নয়। বৃটিশ শাসন আমলে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকেছে তখনকার বাংলা প্রদেশেরই অংশ। এর আগে ১৮২২ সালে পাশ হয় ১০ নং রেগুলেশন। যাতে বলা হয়, বাংলা প্রদেশের সব জেলার মানুষ যথেষ্ট সভ্য নয় (যোগাযোগ, শিক্ষা, আয় ই্ত্যাদি ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়া)। যে সব জেলার মানুষ যথেষ্ট সভ্য নয়, তাদের শাসন ও সংরক্ষণ প্রণালী হতে হবে বাংলা প্রদেশের সভ্য অগ্রসর জেলা থেকে ভিন্ন। (সূত্র: বাংলাদেশের আদিবাসী এবং জাতি ও উপজাতি; পৃ: ১৫/১৬, লেখক: ড. এবনে গোলাম সামাদ, অধ্যাপক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়)। পার্বত্য জেলা সমূহকে দেশের উন্নয়নের মূল স্রোতের সাথে সম্পৃক্ত করতে গঠন করা হয়েছে পার্বত্য চট্রগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়। অনুরূপভাবে কুড়িগ্রামসহ সারা দেশের চর এলাকাগুলোর সার্বিক উন্নয়নে একটি পৃথক মন্ত্রণালয় গঠিত হলে দেশের চর এলাকায় বসবাসরত ১০ মিলিয়ন পিছিয়ে পড়া লোক সবক্ষেত্রে এগিয়ে যাবে। (সূত্র: National Char Alliance). জার্মানীর DW টেলিভিশন চ্যানেলের ডকুমেন্টারি- (১) The Chauras of Bangladesh (২) Climate Refugee in Bangladesh. বিবিসি ওয়ার্ল্ড নিউজ চ্যানেলের প্রতিবেদন- The Floating Farms of Bangladesh. আলজাজিরার ডকুমেন্টারি- (১) Bangladesh Floods: Three Million People Cut off by Waters. (২) Bangladesh, a country on the brink of collapse -এর প্রতিবেদনগুলো দেখলে মনে হয় সমগ্র বাংলাদেশের চরাঞ্চলের বাসিন্দাদের সমস্যা কত নির্মম কঠিন ও কষ্টদায়ক। বন্যার সময় চরের নারীরা লোকলজ্জার কারণে দিনের বেলা শৌচকাজ সারতে পারেন না। অপেক্ষা করতে হয় কখন রাত হবে, কারণ সেখানে কোনো পাকা পায়খানা বা স্যানিটেশন ব্যবস্থা নেই। চর এলাকার স্যানিটেশন কভারেজের হার মাত্র ৩১.৩% যেখানে জেলার স্যানিটেশন কভারেজের হার ৯৬%। আলোচনায় কুড়িগ্রামের প্রেক্ষাপট তুলে ধরা হলেও এটি সারাদেশের বাস্তব চিত্র ও পৃথক মন্ত্রণালয় গঠনের আবেদনকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে।
জেলার দরিদ্র মানুষগুলোকে ক্ষুধা ও দারিদ্র মুক্ত করতে প্রয়োজন এলাকাভিত্তিক পোভার্টি ম্যাপিং এবং নিউট্রিশন ম্যাপিং যার জন্য প্রয়োজন একটি সুনির্দিষ্ট মন্ত্রণালয় যার কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্সে বাংলাদেশের অবস্থান ১২৭টি দেশের মধ্যে ৮৪তম এবং জিএইচআই স্কোর ১৯.৪ কিন্তু দু:খের বিষয় কুড়িগ্রামের এই স্কোর দেশের গড় মানের চেয়েও বেশি। যেখানে দেশের ১১.৯% মানুষ অপুষ্টিতে ভুগছে সেক্ষেত্রে জাতি সংঘের অর্থায়নে পরিচালিত IFADÕs PROVATi project -এর মতে কুড়িগ্রামের ২০% লোক অপুষ্টিতে ভোগে এবং যার সিংহভাগ লোক চর এলাকায় বসবার করে। কম ওজনের শিশু জন্ম নেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বে শীর্ষ স্থানে আছে। ২৮ শতাংশ শিশু কম ওজনে জন্ম নেয়। সারাদেশের গড় খর্বাকৃতি শিশুর চেয়ে কুড়িগ্রামের চর এলাকায় খর্বাকৃতি শিশুর সংখ্যা অনেক বেশি।
সম্ভাবনাময় কুড়িগ্রামে উন্নয়ন না হওয়ার মূল কারণ দেশের অন্যান্য জেলাগুলো যে পরিমাণ উন্নয়ন বরাদ্দ পায় কুড়িগ্রাম তেমনটি পেলেও নদীবহুল ও চরের আধিক্য থাকায় বাজেট কিংবা সরকারের কোনো পরিকল্পনা চরের মূল সমস্যা কিংবা অধিবাসীদের স্বাবলম্বী করার উপায় বা সমাধানকে এড্রেস করে না। আমেরিকার ইনস্টিটিউট অব আর্কিওলজির গবেষক টিম স্টিল প্রমাণ দেন নদ-নদীসৃষ্ট ভৌগোলিক বিভাজনের জেলা কুড়িগ্রামের ব্রহ্মপুত্র-তিস্তা অববাহিকা পৃথিবীর সবচেয়ে পুরোনো আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের নৌপথ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। ব্রহ্মপুত্র নদের বুকে চিলমারী-রৌমারী রুটে নৌপথের দৈর্ঘ্য ২১ কিলোমিটার। তবে নদের ড্রেজিং করা হলে এ পথের দৈর্ঘ্য কমে হবে ১৩ থেকে ১৪ কিলোমিটার। কুড়িগ্রাম জেলার ৯টি উপজেলার মধ্যে দুটি উপজেলা রৌমারী ও চর রাজীবপুর ব্রহ্মপুত্র নদ দিয়ে বিচ্ছিন্ন। বেসরকারি উন্নয়ন ফোরাম কর্তৃক পরিচালিত গবেষণায় দেখা যায় ১৯৭৩ থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে নদীর প্রস্থ ৮.৫ কিলোমিটার থেকে বেড়ে ১২.২ কিলোমিটারে পৌছেছে। পলি জমে গভীরতা কমে যাওয়ার ফলে বর্ষাকালে নদীর প্রস্থ বেড়ে যায় নতুন এলাকা প্লাবিত করে এবং শুস্ক মৌসুমে নদীতে চরের সংখ্যা ও আয়তন বেড়ে যায়।
দারিদ্রপীড়িত চরাঞ্চলে খাদ্য সুরক্ষা, দারিদ্র ও ঝুঁকি হ্রাস, জীবন ও জীবিকার মানোন্নয়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, নারীর ক্ষমতায়ন এবং যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নে আরও বেশি কাজ করতে হবে। চর এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা বলতে শুকনো মৌসুমে ধূ ধূ বালি পথ পাড়ি দিয়ে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতে হয়। যেতে যেতে পথিক ক্লান্ত হয়ে তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়লে নেই সহজে পানি পাবার ব্যবস্থা। আর বর্ষা মৌসুমে চারদিকে পানিতে করে থৈ থৈ। তখন নৌকায় হয়ে উঠে একমাত্র বাহন। আবার পারিবারিকভাবে নৌকা বানানোর বা তৈরী করার সামর্থ্য সবার নেই। জরুরী প্রয়োজনে কোনো রোগী শুকনো মৌসুমে উপজেলা/ জেলা সদরের হাসপাতালে নিতে হলে প্রাচীন আমলের ন্যায় জলচৌকি, কিংবা কাপড়ের দুই পাশে দড়ি লাগিয়ে কাঁধে করে রোগীকে নিয়ে যেতে হয়। অনেক সময় পথিমধ্যেই রোগী মারা যায় কিংবা গর্ভবতী মায়ের ক্ষেত্রে নানারুপ সমস্যার সৃষ্টি হয়। মূল ভূখন্ডের ন্যায় নেই কোনো চলাচল উপযোগী রাস্তা কিংবা রিক্সা বা অটো। ইদানিং চর এলাকায় একমাত্র বাহন হিসেবে ঘোড়ার গাড়ি ব্যবহৃত হচ্ছে। বর্ষাকালে নদী পথের দৈর্ঘ্য ১৪৭ কিলোমিটার কিন্তু শুকনো মৌসুমে নদী গুলোতে পলি পড়ে যাওয়ায় এবং উজানের পানি কমে যাওয়ায় নৌ পথের দৈর্ঘ্য অর্ধেকের নিচে নেমে আসে। নদীগুলোর রক্ষণাবেক্ষন করা গেলে নৌ পথের যেমন গুরুত্ব বাড়ত তেমনি বিভিন্ন ধরণের দেশী মাছ সারা বছর ব্যাপী পাওয়া যেত। নৌ পথে কুড়িগ্রাম থেকে ভারতের সেভেন সিস্টার সহ নেপাল ভুটানের সাথে আন্তর্জাতিক যোগাযোগের সম্ভাবনা রয়েছে। অথচ কর্মসংস্থানের অভাবে এখানকার বিশেষ করে চর এলাকার লাখ লাখ মানুষ এলাকা ছেড়ে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অন্যত্র কাজ করছে। তাদের বেঁচে থাকার নিরন্তর সংগ্রামী জীবনে শীতে একটি কম্বল এবং বন্যায় পাঁচ কেজি চাউল দিয়ে অনেকেই সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট দিয়ে নিজেকে জনদরদী হিসেবে মঙ্গা জয়ের একতরফা আবহ সংগীত গেয়ে বেড়ায়।
কুড়িগ্রাম জেলায় ১২৪০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে চরাঞ্চলে রয়েছে ১৬৯টি। অথচ চরাঞ্চলের শিক্ষার্থীদের শিক্ষা নিশ্চিত করতে প্রত্যেকটি চরে কমপক্ষে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় থাকা অপরিহার্য। মূল ভূখন্ডে শিক্ষার্থীরা ০.৯২ থেকে ১.৭ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করলে বিদ্যালয়ে যেতে পারে। এক্ষেত্রে তাদের সহজ যোগাযোগের জন্য রয়েছে বাইসাইকেলসহ বিভিন্ন ধরণের যানবাহন। পক্ষান্তরে চরাঞ্চলের শিক্ষার্থীদেরকে ধূ ধূ বালি পথে একটি বিদ্যালয়ে যেতে ২.৫ কিলোমিটার থেকে ৫.৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হয়। বর্ষাকালে ২/৩ মাস স্কুল গৃহ থাকে জলমগ্ন। সারাদেশে যেখানে প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষার্থী ভর্তির হার শতভাগ সেখানে চর এলাকায় এই হার ৩০.৬% (সূত্র: দ্য ডেইলি স্টার)। ভর্তিকৃত ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডি পার হতে পারে না। এ বিদ্যালয়গুলোতে কর্মরত শিক্ষকদের শুষ্ক মৌসুমে মাইলের পর মাইল হাঁটা আর বর্ষা মৌসুমে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উত্তাল নদী পাড়ি দিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পৌঁছতে হয়। অনেক শিক্ষককেই প্রতিদিন যাতায়াতের জন্য ২০০-৫০০ টাকা ব্যয় করতে হয়। বেশি ভোগান্তি পোহাতে হয় নারী শিক্ষকদের। এতে করে অনেকটাই বাধ্য হয়ে চরাঞ্চল গুলোর অনেক প্রতিষ্ঠানে ভাড়াটিয়া শিক্ষক দিয়েই চলছে পড়ালেখা। চর এলাকায় দায়িত্ব পালনের জন্য পাহাড়ি অঞ্চলের ন্যায় নেই শিক্ষকদের কোনো বিশেষ ভাতা।
চর এলাকার শিক্ষার হার ও বাল্য বিবাহ এ দু’টির সম্পর্ক নেতিবাচক। শিক্ষার সুযোগ কম থাকলে বা শিক্ষালাভে ব্যর্থ হলে বাল্য বিবাহের মাত্রা বা হার এমনিতেই বেড়ে যায়। ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী দেশে ১৮ বছরের কমবয়সী মেয়েদের বাল্য বিয়ের হার ৬৬%। কুড়িগ্রামের চর অঞ্চলে এই চিত্র আরও ভয়াবহ, প্রায় ৭৮%। চর এলাকায় বাল্য বিয়ের প্রচলন মনে হয় পূর্ব পুরুষ থেকে চলে আসা নিয়মে পরিণত হয়েছে। অভিভাবকদের ধারণা বয়স বেশি হইলে মেয়েকে কেউ বিয়ে করতে চায় না। চরে হাইস্কুল থাকলে মেয়েরা পড়াশোনা করতে পারতো। সেক্ষেত্রে অভিভাবকরা মেয়েদের বাল্য বিয়ের পরিবর্তে পড়াশোনায় মেয়ে ব্যস্ত আছে বলে ভাববার বা সমাজে বলার একটা পথ পেত। কিন্ত অপরিণত বয়সেই মেয়েদের বিয়ে দেয়া ছাড়া তাদের আর কোনো উপায় থাকে না। জেলা শিক্ষা অফিস, কুড়িগ্রামের তথ্য অনুযায়ী জেলায় গত দেড় বছরে ৪ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। জেলার ৯ উপজেলায় মাধ্যমিক পর্যায়ের বিভিন্ন বিদ্যালয়ের ২ হাজার ৯২৭ জন এবং মাদ্রাসার প্রায় ১ হাজার ২৯০ জন বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে, যা মোট শিক্ষার্থীর ২ দশমিক ৩৪ ভাগ।
চর এলাকার স্বাস্থ্য ব্যবস্থার চিত্র অত্যন্ত করুন ও শোচনীয়। চরাঞ্চলের মানুষ প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা পান বটে, তবে সেটাও পর্যাপ্ত নয়। সরকারি কমিউনিটি ক্লিনিক ও কিছু এনজিও প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তারা সেবা পান, কিন্তু সেটাও নিয়মিত নয়। ফলে হঠাৎ করে কেউ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে শহরের হাসপাতালে নিয়ে যেতে হলে প্রায় একটা যুদ্ধ করতে হয় পরিবারের সদস্যদের। বিশেষ করে শুকনো মৌসুমে। চর এলাকায় নেই কোনো এমবিবিএস ডাক্তার বা প্রশিক্ষিত কোনো চিকিৎসক। চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্পুর্ণরুপে পল্লী চিকিৎসক বা হাতুড়ে চিকিৎসকের উপর নির্ভশীল। পল্লিচিকিৎসকদের অসচেতনতা ও অপচিকিৎসায় প্রসূতি মা ও নবজাতকের জীবন গুরুতর ঝুঁকিতে পড়ে কিংবা গুরুতর ক্ষেত্রে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটে। প্রসবের জন্য জরায়ুর প্রসারণ ঘটাতে, প্রসবের গতি বাড়াতে ও প্রসবের পর রক্তপাত বন্ধ করতে ‘অক্সিটোসিন’ ইনজেকশন ব্যবহৃত হয়। পল্লী চিকিৎসকগণ পরীক্ষা ছাড়া অক্সিটোসিন ইনজেকশন দিয়ে ফেলেন। ফলে জরায়ু ছিঁড়ে যাওয়ার বা প্রস্রাবের থলি ফেটে যাবার সম্ভাবনা থাকে। এমনকি প্রতিবন্ধী নবজাতকের জন্ম বা প্রসূতি চিরতরে গর্ভধারণের ক্ষমতা হারাতে পারেন। একটি গবেষণায় ১২টি দ্বীপচরের ৬০০ নারীর ওপর চালানো জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, ৬০০ জনের মধ্যে ৯৯ প্রসূতিকে ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই অক্সিটোসিন ইনজেকশন দেয়ার ফলে প্রসবের সময় ৫৯টি নবজাতক ও ৬ জন প্রসূতির মৃত্যু হয়েছে। কুড়িগ্রাম জেলায় মোট প্রতিবন্ধীর সংখ্যা ৯১,৬৭২ জন, প্রতিবন্ধীতার হার ৩.৯৩%, যা দেশের গড় প্রতিবন্ধীতার হার ২.১৪% থেকে বেশি। অন্যান্য সকল রোগের চিকিৎসা ক্ষেত্রে বলা যায় মৃত্যু দূত ও চরের মানুষ এক সাথে পাশা পাশি বাস করে। এ ছাড়া তাদের করার আর কিছু থাকে না। চর অঞ্চলের স্বাস্থ্য-চিকিৎসা ব্যবস্থার একটি বাস্তব চিত্র তুলে ধরছি। উপজেলা হাসপাতাল অক্ষমতা প্রকাশ করায় রৌমারী উপজেলার দাঁতভাঙ্গা ইউনিয়নের এক প্রসূতির বাবা রোগীকে বাঁচাতে নৌকায় মেয়েকে নিয়ে রওয়ানা দিলেন। ফোন করে উৎকণ্ঠার স্বরে বলছিলেন, ‘যে কোনো কিছুর বিনিময়ে আমার মেয়েকে জেলা সদর হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে বাঁচাতে চাই। ইউনিয়ন পরিষদ নিয়ন্ত্রিত ওয়াটার অ্যাম্বুলেন্সকে ফোন করলে তারা জানায় রৌমারী থেকে জেলা সদরে যেতে ভাড়া লাগবে ছয় হাজার টাকা।’ নদী তীরবর্তী স্কুলের এক শিক্ষক আবু বকর ছিদ্দিক এ কথা গুলো বলছিলেন। তিনি বললেন, ‘অবশেষে যাত্রীবাহী নৌকাযোগে কুড়িগ্রাম সদর হাসপাতালের উদ্দেশ্যে নৌকা চলার কিছুক্ষণ পর প্রসূতির সঙ্গে যাওয়া লোকজন যাত্রীদের এক পাশে সরে বসতে বলেন। শাড়ি দিয়ে প্রসূতিকে আড়াল করা হলো। কিছুক্ষণ পর একটি সন্তান জন্মগ্রহণ করল।’ চরাঞ্চলের মাত্র শতকরা পাঁচ শতাংশ নারীকে সন্তান প্রসবের জন্য হাসপাতালে নেওয়া হয়, বাকি ৯৫ শতাংশের ক্ষেত্রে বাড়িতে বাচ্চা প্রসব হয়। এছাড়াও বন্যার সময়ে ডায়রিয়া, কলেরা, টাইফয়েড, চর্মরোগ, চোখের অসুখ প্রভৃতি সমস্যা মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে অন্তঃসত্ত্বা, শিশু ও বয়স্ক মানুষ বেশি ঝুঁকিতে থাকে। বিরামহীন বর্ষণ, ঘরের মধ্যে পানি, মধ্যরাতে প্রসূতির প্রসব বেদনার কাতরতা, শিশুর ডায়রিয়া, বৃদ্ধার শ্বাসকষ্টে ত্রাহি অবস্থা সৃষ্টি হয় চরবাসীর।
নদী অববাহিকায় একটি কথা প্রচলিত আছে যে ‘চরের আবাদ আর চোরের আবাদ’ একই কথা। কারণ চোর যেমন যে কোন মহুর্তে ধরা পরলে তার সব সম্পদ শেষ তেমনি যে কোনো সময় বন্যা আর ভাঙ্গনে চরের ফসল নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এরুপ সমস্যা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের চরাঞ্চল হচ্ছে অপার সম্ভাবনার একটা জায়গা। চরাঞ্চলগুলোতে প্রায় ৩০ ধরনের ফসলের চাষ হয়। এখানে যে কৃষক ৩০ শতাংশ জমিতে বছরে দুইবার ফসল ফলানোর সুযোগ পান, তার দারিদ্র বলে কিছু থাকে না। চরে উৎপাদিত পণ্যের বাজার মূল্য প্রায় ৩৫ থেকে ৪০ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া বছরে চাহিদার ২৫ লাখ গবাদিপশুর জোগান দিচ্ছে চরে বসবাসকারীরা। চরকে এখন বলা হয় সব্জি ভান্ডার। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, রংপুর, গাইবান্ধা ও নীলফামারী জেলায় ৩০টি চরে এক হাজার ৯০০ হেক্টর জমিতে বাণিজ্যিকভাবে গাজর চাষ করা হয়। তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, ১৮১৮ সালের আগে পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম চাষই একমাত্র কৃষি চাষ পদ্ধতি ছিল। এখন পার্বত্য চট্রগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে কুমড়া, অড়হড়, শিম, শসা, করলা, ঢেঁড়স, তিল, ভুট্টা, আদা, যব, তুলা, হলুদ, পাহাড়ি আলু, কচু ইত্যাদি সবই চাষাবাদ হচ্ছে। দেশি–বিদেশি জাতের আম, ড্রাগন, আনারস, লটকন, মাল্টা, কফি, কমলাসহ অন্তত ৪৫ প্রজাতির ফলের আবাদ হচ্ছে তিন পার্বত্য জেলায়। চর নিয়ে অনুরুপভাবে গবেষণা হলে চরও হয়ে উঠবে সম্ভাবনাময় কৃষির এক অফুরন্ত উৎস। চরাঞ্চলের মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য সরকারি ও বেসরকারি অংশীদারত্বের মাধ্যমে একটি টেকসই বাজারব্যবস্থা তৈরির জন্য মেকিং মার্কেটস ওয়ার্ক ফর দ্য চরস (এমফোরসি) সুইজ্যারল্যান্ড সরকারের অধীনে কাজ করছে। চরের জন্য নির্দিষ্ট মন্ত্রণালয় থাকলে বিদেশী উদ্যোক্তারা আরো বেশি বিনিয়োগ বা কাজের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারত।
চরাঞ্চলের সঠিক উন্নয়নের লক্ষ্যে চর ব্যবস্থাপনার ওপর গুরুত্ব প্রদান করে একটি আলাদা মন্ত্রণালয় গঠন করার প্রস্তাব প্রেরণের বিষয়ে নুসরাত সুলতানা, জেলা প্রশাসক, কুড়িগ্রামের সভাপতিত্বে গত ২২ ডিসেম্বর ২০২৪-এ জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে একটি মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় উপস্থিত সদস্যগণ মতামত প্রদান করেন যে বাস্তবতার নিরিখে এ ধরণের প্রস্তাব প্রেরণ একটি যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত। চর এলাকার উন্নয়নকে ঘিরে যদি মেগা প্রকল্প প্রণয়ন করা যায়, নদী শাসনের মাধ্যমে যদি চরগুলোতে চাষযোগ্য জমির পরিমাণ বাড়ানো যায়, সেই সাথে যোগযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করা যায় তাহলে চরগুলো উন্নয়নের পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হবে। কৃষি, ব্যবসা-বাণিজ্য-প্রযুক্তির সম্প্রসারণ ঘটবে। দুর্গম চরগুলো হয়ে উঠবে উন্নয়নের মডেল যা থেকে দক্ষিণ এশিয়া তথা পৃথিবীর অন্য দেশগুলো অবহেলিত চর উন্নয়নের ধারণা লাভ করবে।
লেখক: অধ্যক্ষ, কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ
সারাবাংলা/এএসজি
কুড়িগ্রাম চর অঞ্চল প্রফেসর মীর্জা মো. নাসির উদ্দিন মত-দ্বিমত