Sunday 23 Feb 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সুস্থতার জন্য হাসি

প্রফেসর মীর্জা মো. নাসির উদ্দিন
১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৫:২৪

পৃথিবীতে সকল রোগের মহৌষধ হচ্ছে হাসি। হাসির সাথে মানবদেহের রয়েছে গভীর ও নিবিড় সম্পর্ক। চিকিৎসাবিজ্ঞানের মতে, ব্যাড মুড বা মন খারাপের পরিস্থিতি মানব দেহের বিভিন্ন রোগের উপসর্গ তৈরি হয়ে থাকে। অসুখ থেকে দূরে থাকার জন্য হাসির সাথে কাছাকাছি বাস করার আসলে কোন বিকল্প নেই। আর মন ভালো থাকবে কিসে, সেটারও আছে সহজ সমাধান- হাসি। অবাক হলেও কিন্তু সত্য, সারাদিনে যদি আপনি হাসেন আর মন ভালো রাখেন, তবে অনেকটা সুস্থই থাকবেন। হাসি সবসময় সুখের কারণ বুঝায় না, মাঝে মাঝে এটাও বুঝায় যে, আপনি কতটা বেদনা লুকাতে পারেন। গবেষণায় দেখা গেছে, হাসির একটা সংক্রামক প্রবণতা আছে। হাসির একটা আলাদা রূপ আছে, সেটা দেখলে আমাদের মস্তিষ্কে সিগন্যাল যায়। তাই হাসিখুশি মানুষের সাথে থাকলে, অন্যদের হাসতে দেখলে সেই হাসি নিজেদের মধ্যেও ছড়িয়ে যায়। বিজ্ঞান বলছে আপনি যখন হাসেন, এটি কেবল আপনার মনই ভালো করে না বরং আপনার চারপাশের মানুষকেও প্রভাবিত করে। যারা হাসতে পারে তারা ভাগ্যবান। সংসারের দু:খ কষ্টের ভার তাদের কাছে লঘু হয়ে যায়। জীবনের সকল সমস্যা তাদের কাছে সহজ হয়ে আসে। কাতুকুতুজনিত হাসির সঙ্গে আমরা সকলেই পরিচিত। এই হাসি নিতান্তই স্থুল। শরীরের বিশেষ বিশেষ স্থানে কাতুকুতু দিলেই হাসি পায়। কিন্তু তার কোন গুরুত্ব নেই কারণ তা হাস্যরস উৎপাদন করতে পারে না। তেমনি যন্ত্র দ্বারা গাভীর দহনকৃত দুধে পুষ্টিগুন কম থাকে। পক্ষান্তরে বাছুর গাভীর বাটে মুখ লাগিয়ে কিছুটা দুধ খাওয়ার পর যখন দুধ দহন করা হয় তার পুষ্টিগুন অনেক বেশি থাকে কারণ এ দুধে মাতৃস্নেহের আবেগ মিশ্রিত থাকে। যে হাস্যরস মন ও মস্তিস্ককে নাড়া দিয়ে স্বত:স্ফুর্তভাবে উৎপাদিত হয় তা দ্বারা স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটে। স্বতঃস্ফূর্ত হাসি মস্তিষ্কে এন্ডোরফিন, সেরোটোনিন এবং ডোপামিনের মতো রাসায়নিকের নিঃসরণ বাড়ায়। এই রাসায়নিকগুলো প্রাকৃতিকভাবে আমাদের মন ভালো রাখতে সাহায্য করে এবং স্ট্রেস কমায়। পৃথিবীর সকল মানুষ একই ভাষায় হেসে থাকে। হাসির মধ্যে বিশ্বজনীন ও সর্বকালীন উপাদানও রয়েছে। সেকারণেই হাসি বিশ্ব মানবের সামগ্রী। হাসি চিরকালের উপভোগ্য অক্ষয় সম্পদ। চার্লি চ্যাপলিন অথবা লরেন হার্ডি বিশ্বের সকল দর্শকের মধ্যেই সমানভাবে হাস্যরস বিতরণ করেছেন। ডনকুইস্কোট ও পিকউইক চিরকাল বিশ্বের সকল পাঠককে পরিতুষ্ট করেছেন হাস্যরসে। আমার আজকের লেখায় হাস্যরসের বায়োলজিক্যাল গুরুত্ব ও হাস্যরসের উৎপত্তি ভূমি যে আমাদের সাহিত্য ও সংস্কৃতি তা তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

The Journal of Neuroscience-এর এক গবেষণায় দেখা গেছে যে যখন কয়েকজন মানুষ দলবদ্ধভাবে কোন আলোচনায় হাসির পরিবেশ সৃষ্টি করে তখন তাদের মস্তিষ্কের থ্যালামাস, কডেট নিউক্লিয়াস এবং পশ্চাৎ ইনসুলা অঞ্চলে এন্ডোরফিন নিঃসরণে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি ঘটায়। ফলে মস্তিস্কের সংশ্লিষ্ট অঞ্চলগুলো উদ্দীপ্ত হয়ে অ্যান্ডোরফিন নামক ‘ফিল গুড’ হরমোন নিঃসৃত হয়, যা স্ট্রেস কমাতে সাহায্য করে। এন্ডোরফিন হল পেপটাইড যা মস্তিষ্কে ওপিওড রিসেপ্টরগুলির সাথে যোগাযোগ করে ব্যথা উপশম করতে এবং আনন্দের অনুভূতি ট্রিগার করতে সহায়তা করে। এছাড়াও হাসি মস্তিষ্কের ডোপামিন নিঃসরণকে উৎসাহিত করে, যা আত্মবিশ্বাস ও ইতিবাচক মনোভাব গঠনে সাহায্য করে। পাশাপাশি এক গবেষণায় উঠে এসেছে, যাদের মধ্যে হাসির প্রবণতা বেশি, তাদের মধ্যে হতাশা ও দুশ্চিন্তার মাত্রা কম থাকে। হাসি কর্টিসলের মতো স্ট্রেস হরমোন ক্ষরণের মাত্রা কমিয়ে, নাইট্রিক অক্সাইড নিঃসরণের মাধ্যমে রক্তের প্রবাহকে উন্নত করে, ধমনীতে প্রদাহ কমায়, এবং সাধারণত ইতিবাচক মেজাজ বৃদ্ধি করে যা স্বাস্থ্যকর জীবনধারা পছন্দের দিকে নিয়ে যেতে পারে এর সবগুলিই ভাল কার্ডিওভাসকুলার স্বাস্থ্যে অবদান রাখে। এছাড়াও ‘ভাল’ কোলেস্টেরল (HDL) বৃদ্ধি করে একটি ইতিবাচক মেজাজের আবহ সৃষ্টি করে যার মাধ্যমে স্বাস্থ্যকর জীবনধারার সূচনা হয়। এ ধরণের পরিবেশ নিয়মিত শারীরিক অনুশীলন এবং ভাল খাদ্য নির্বাচনে সহায়তা করে থাকে।

বিজ্ঞাপন

হাসি হৃদস্পন্দনকে উন্নত করে ও রক্তচাপ কমায়, ফলে হৃদরোগের ঝুঁকি কমে। The European Pain Federation (EFIC) Congress-এর মতে হাসি প্রাকৃতিক পেইনকিলারের মতো কাজ করে, যার ফলে ব্যথা উপশম হয়। ৭৫টি দেশ থেকে আগত ৪০০০ জন ব্যথা বিশেষজ্ঞ ব্যথা ব্যবস্থাপনার সমস্ত দিক পর্যালোচনা করে বলেছেন হাস্যরস এন্ডোরফিন নিঃসরণকে সক্রিয় করে, পেশীর উত্তেজনা থেকে মুক্তি দেয় এবং এভাবে মানসিক এবং শারীরিক উভয় ধরণের ব্যথা কমাতে প্রভাব বিস্তার করে। নরওয়েজিয়ান গবেষকরা তাদের এক রিপোর্টে বলেছেন যে ধূমপায়ী এবং প্রাক্তন ধূমপায়ীদের তুলনায় অধূমপায়ীরা বেশি ব্যথা সহ্য করতে পার। দশ হাজার লোকের ওপর পরিচালিত এক গবেষণা করে উক্ত ফলাফল পাওয়া গেছে। সুইস দলের একটি গবেষণা বলছে হাস্যকর চলচ্চিত্র দেখা একদল গবেষক বরফের ঠান্ডা পানিতে তাদের হাত বেশিক্ষণ ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছেন। পরবর্তী পরিমাপ দেখায় যে এরূপ দর্শকদের সিনেমা দেখার ২০ মিনিট পরও তাদের ব্যথা সহনশীলতা বিদ্যমান ছিল।

হাসি রক্তে অ্যান্টি-ইনফেকশন অ্যান্টিবডি এবং টি-সেলের উৎপাদন বাড়িয়ে আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে যা আমাদের সংক্রমণ থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করে। উপরন্তু, আপনি যখন হাসেন, তখন আপনার মস্তিষ্ক এন্ডোরফিন নিঃসরণ করে, কর্টিসলের মতো স্ট্রেস হরমোন কমায়, রক্তচাপ কমায় এবং রক্ত সঞ্চালন বাড়ায়। গবেষণায় দেখা গেছে যে হাসির মাধ্যমে দুর্দশা, অনিশ্চয়তা বা বিষণ্ণ মেজাজ কাটিয়ে ওঠা সবচেয়ে বেশি সহজ। করোনার সময় কিছু কিছু চিকিৎসক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে তাদের রোগীদের একাকী হাসার পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিছু চিকিৎসক এমনকি তাদের রোগীদের প্রেসক্রিপশনে উপদেশ হিসেবে প্রতিদিন ৩০ মিনিট হাসার কথা লিখতেন।

হাসি কোন ব্যক্তির হৃদস্পন্দন এবং শ্বাসের হার বাড়িয়ে ক্যালোরি পোড়ায়, যাতে বেশি অক্সিজেন ব্যবহৃত হয়। এবং এভাবে শরীরের অতিরিক্ত ক্যালোরি ঝড়িয়ে ফেলে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ মিনিটের জন্য হাসলে প্রায় ৪০ ক্যালোরি বার্ন হতে পারে – যা এক বছরে তিন বা চার পাউন্ড হারানোর জন্য যথেষ্ট হতে পারে। সামাজিক গবেষণা অনুসারে, একটি মানবশিশু দিনে অন্তত ৩০০ বার হাসে, যেখানে প্রাপ্তবয়স্করা হাসে মাত্র ১৫-২০ বার। অর্থাৎ জীবনের চাপ ও দুশ্চিন্তা মানুষকে হাসতে ভুলিয়ে দেয়। তাই দৈনন্দিন জীবনে আরও বেশি হাসার চেষ্টা করা উচিত। এ কারণেই চার্লি চ্যাপলিন বলেছিলেন, ‘একটি দিনও নষ্ট নয়, যদি আপনি সেদিনই হাসেন।’ তাই প্রাণ খুলে হাসুন, জীবন ভরে বাঁচুন।

সাধারণত উপমহাদেশীয় চলচ্চিত্রে নায়ক, নায়িকা ও খলনায়কের পাশাপাশি কৌতুক চরিত্রকে বিনোদনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে তুলে ধরা হতো। দর্শকদেরকে বাড়তি বিনোদন দেয়ার জন্য চরিত্রটিকে হাস্যরসের মাধ্যমে তুলে ধরা হয় যাতে দর্শকরা বিনোদনের পাশাপাশি মানসিক প্রশান্তি লাভ করে। এ ধরণের প্রশান্তির মাধ্যমে দর্শকদের হার্টের স্বাস্থ্যও ভাল থাকে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন, টেলিসামাদ, আশীষ কুমার লৌহ, হাসমত, আনিস, রবিউল, সাইফউদ্দিন, ফরিদ আলী, মতি, আফগানি, ব্ল্যাক আনোয়ার, দিলদার, ববি, কাবিলা প্রমুখ। আমাদের দেশে একসময় কৌতুক অভিনেতারা বেশ জনপ্রিয় ছিলেন। তাদের অভিনয় এবং মুখের সংলাপ দর্শকের মুখে মুখে থাকত। ফলে একটি সিনেমা দেখার পর তা দর্শকের মানসিক স্বাস্থ্যে অনেকদিন গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখত।

বিভিন্ন সাহিত্যে যারা বিদূষক বা ভাড় হিসেবে পরিচিতি ছিলেন তারাও হাস্যরস সৃষ্টির মাধ্যমে মানুষকে নানাভাবে উৎফুল্লতা বা আনন্দ দান করতেন। তারা শুধু রাজা, সম্রাটদের মনোরঞ্জন করতেন না, কৌতুকপূর্ণ মন্তব্য ও পরামর্শের মধ্য দিয়ে নীতি বিষয়ক সমালোচনাও করতে পারতেন। তাদের মধ্যে মোল্লা নাসিরুদ্দিন, বীরবল, গোপাল ভাঁড় এবং তেনালি প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। মোল্লা নাসিরুদ্দিনের এমন অসংখ্য গল্প পুঁথিতে, লোকের মুখে মুখে নানা রূপে আজও ঘোরেফেরা করে। আর তার জেরে নাসিরুদ্দিনের একমাত্র পরিচয়টি হয়ে গেছে এক কিংবদন্তি ব্যঙ্গরসিকের। মোল্লা নাসিরুদ্দিন তুর্কিস্থানের মানুষ ছিলেন। তার জনপ্রিয়তা এতটাই যে, অন্তত সাত থেকে আটটি দেশ দাবি করে তিনি তাদের দেশের মানুষ। তুর্কিস্থানের মানুষ কিন্তু নাসিরুদ্দিনকে ‘মোল্লা’ ডাকেন না, বলেন হোজা-মানে শিক্ষক বা পণ্ডিত। সেই পণ্ডিত নাসিরুদ্দিনের সমাধিস্থল তুর্কিস্থানের অতি পবিত্র তীর্থস্থান। ১৯৯৬ সালটিকে ইউনেস্কো ‘নাসিরুদ্দিন হোজা’ বর্ষ হিসাবে ঘোষণা করেছিল। পৃথিবীতে আর কোনও বিদূষক এমন সম্মান পেয়েছেন কি না, জানা নেই। এবারে মহেশ দাসকে নিয়ে দু’চারটি কথা বলা প্রয়োজন। এই মহেশ দাস মুঘল সম্রাট আকবরের সভার একজন অন্যতম সভাসদ ছিলেন! সম্রাট আকবরের সভার এ মহেশ দাস ইতিহাসে ‘বীরবল’ নামেই খ্যাত। একবার হঠাৎ এক পাগলা হাতির সামনে পড়ে গেলেন মহেশ। পালানোর পথ নেই। সামনে সাক্ষাৎ মৃত্যু। এমন সময় মুঘল সম্রাট আকবর নিজের ঘোড়া ছুটিয়ে এসে দাঁড়িয়ে পড়লেন তার বন্ধু এবং পাগলা হাতির মাঝখানে। অপ্রত্যাশিত বাধায় হাতি সরে গেল। প্রাণ বাঁচল মহেশের।

পারস্য সম্রাট একদা শুনেছিলেন যে, মোগল সম্রাটের পরশমণি আছে, যা ছোঁয়ালে সব কিছু সোনা হয়। তিনি নাকি পরশমণি সম্পর্কে আকবরের কাছে খোঁজ নিয়েছিলেন। আকবর পারস্যদূতকে বলেছিলেন, ‘এই যে বীরবলকে দেখছেন, ইনি আমার পরশমণি।’ ঠিক এরই আগে একবার আকবর বীরবলকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘সূর্য উঠলে চারিদিকে আলো হয়ে যায়। সব কিছু দেখা যায়। কিন্তু কী দেখা যায় না বলো তো বীরবল।’ বিন্দুমাত্র চিন্তা না করে বীরবল বলেছিলেন, ‘সূর্য উঠলে অন্ধকার দেখা যায় না।’

তবে জীবনরসিক গোপাল ভাঁড় শুধু যে রাজাকে লোকশিক্ষা দিতেন এমন নয়, অনেক সময় সাধারণ মানুষদের কাছ থেকেও শিক্ষা নিতেন। জনশ্রুতিতে গোপাল সব থেকে বেশি বিখ্যাত। ষোড়শ শতকে ইংলন্ডের রানি এলিজাবেথের দরবারে গ্যাব্রিয়েল ভ্যান্ডারবিল্ট নামে একজন বিদূষক ছিলেন। খুব কাজের চাপের মধ্যে মাঝে মাঝে নিজের মন হাল্কা করার জন্য রানি এই বিদূষককে মাইনা দিয়ে নিয়োগ করেছিলেন।

বাংলা সাহিত্যেও হাস্যরসের অনেক মূল্যবান সম্ভার রয়েছে। হাস্যরসের যতরকম ভাগ আছে তার মধ্যে হিউমার শ্রেষ্ঠ। হিউমারকে বলা হয় করুন হাস্যরস। আরেক রকম হাস্যরস আছে যার আবেদন বুদ্ধিশীল মস্তিস্কে। ইংরেজিতে তাকে বলা হয় উইট যার বাংলা হলো বৈদগ্ধপূর্ণ হাস্যরস। জগৎ বিখ্যাত নাট্যকার সেক্সপিয়ারের নাটকে উইট এবং হিউমারের চমৎকার সংমিশ্রণ পরিলক্ষিত হয়। হাস্যরসের অন্য আরেক বিভাগের নাম ব্যঙ্গরস বা সাটেয়ার্স। ব্যঙ্গকারের উদ্দেশ্য লেখনির মাধ্যমে শোধন করা, শিক্ষা দেওয়া। ব্যঙ্গের সর্বাপেক্ষা সক্ষম লেখক হচ্ছেন জনাথন সুইফট। বাংলা সাহিত্যের খাটি ব্যঙ্গ রচনার প্রবর্তক হিসেবে ভবানীচরণ চট্রোপাধ্যায়ের নাম উল্লেখযোগ্য। আরেক প্রকারের হাস্যরস আছে যার নাম কৌতুক রস বা ফান। হাসির গান লিখে যশস্বী হয়েছেন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। বাংলা সাহিত্যের হাস্যরসের উল্লেখযোগ্য আরেক দিক হলো প্যারডি। পাশ্চাত্য সাহিত্যে প্যারডি অতি প্রাচীন। কবি ও সাহিত্যিকদের অনেক লেখায়ও সরাসরি হাস্যরস ফুটে ওঠেছে। তেমন কয়েকটি উদাহরণ তুলে ধরা হলো।

রবীন্দ্রনাথ একদিন বেড়াতে গেছেন তার কোনো এক ভক্তের বাড়িতে। কবিকে বসবার জন্য একটা চেয়ার দেয়া হলো। কবি ভক্তকে জিজ্ঞেস করলেন ‘চেয়ার টা বেশ সুন্দর’। তা চেয়ার টা সজীব তো? ভক্ত বুঝতে না পেরে কবির মুখের দিকে হা’ করে তাকিয়ে রইল। তখন কবি বললেন, ‘বুঝতে পারনি বুঝি?’ আমি জিজ্ঞেস করছি ‘চেয়ার টা সজীব কি না? মানে এতে ছাড়পোকা আছে কি না।’

জীবনের শেষ দিকে এসে রবীন্দ্রনাথ একটু সামনের দিকে ঝুঁকে উবু হয়ে লিখতেন। একদিন তাকে ওভাবে উবু হয়ে লিখতে দেখে তার এক শুভাকাঙ্খী তাকে বললো- ‘আপনার নিশ্চয় ওভাবে উপুড় হয়ে লিখতে কষ্ট হচ্ছে’। লোকটার দিকে খানিকক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে রবীন্দ্রনাথ জবাব দিলেন- ‘তা- তো হচ্ছেই। তবে কি জানো, এখন উপুড় হয়ে না লিখলে কি আর লেখা বেরোয়। পাত্রের জল কমে তলায় ঠেকলে একটু উপুড় তো করতেই হয়।’

রবি ঠাকুরের কণিকা অবলম্বনে শান্তশীলদাস লিখেছেন- চক্রবর্তী গিন্নী বলে ছাড়িয়া নিশ্বাস,/বোস গিন্নী বেশি সুখী আমার বিশ্বাস। বোস গিন্নী দু:খ করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, চক্রবর্তী গিন্নীর দু:খ হারিয়েছে আমার।

বঙ্কিম চন্দ্রের বাবু রচনার অনুকরণে কুমারেশ ঘোষ লিখেছেন ‘মস্তান’। যাহারা চাঁদা আদায়ে সঞ্চয় করিবেন, সঞ্চয় করিতে পরকে বঞ্চনা করিবেন, নিজেকে বঞ্চনা করিয়া বিদ্যার্জন করিবেন এবং সেজন্য প্রশ্ন চুরি করিবেন বা পরীক্ষায় টুকিবেন, তাহারাই মস্তান। যিনি ভোটের সময় ভিক্ষাপ্রার্থী, গদি পাইলে নবাবরুপী, এবং তখন বহুরুপী, তিনিই মস্তান।

হাস্যরসের আরেক প্রাণ ভোমরা হলেন- সৈয়দ মুজতবা আলী। তিনি যে কোনো বক্তব্যকে নিয়ে হাস্যরস করেছেন। অত্যন্ত গম্ভীর বিষয়কে তিনি রম্য কায়দায় উপস্থাপন করেছেন। তাতে বিষয়টি হালকা হয়নি বরং আরো উপভোগ্য, হৃদয়গ্রাহি হয়েছে। ‘রসগোল্লা’ রম্য রচনা পড়ে কে না হাস্যরসে হাবুডুবু খেয়েছে? গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র ঝান্ডুদা বন্ধুর মেয়ের জন্য এক টিন ভ্যাকুম প্যাকেটজাত মিষ্টি নিয়ে যাচ্ছে। ইতালির কাস্টমস ঘরে কাস্টমস অফিসারের সাথে তা নিয়ে বাকবিতন্ডা হয়। কাস্টমস কর্মকর্তাকে তিনি বোঝাতে ব্যর্থ হয় যে, প্যাকেট খুললে মিষ্টি নষ্ট হয়ে যাবে। কাস্টমস কর্মকর্তার একগুয়েমিতার কারণে ঝান্ডুদা প্যাকেট খোলে। কিছু বুজে উঠার আগেই ঝান্ডুদা ক্ষেপে রসগোল্লা নিয়ে চুঙ্গিওয়ালার নাকে-মুখে লেপে দেয়। আর সকলকে রসগোল্লা দেয়। রসগোল্লার রসে মজে ফরাসি উকিল আড়াই মিনিট চোখ বন্ধ করে রেখেছিলেন। সকলেই রসগোল্লার রসে মজে আবার রসগোল্লা খেতে চাই কিন্তু ততোক্ষণে তা শেষ। এই রম্য রচনার প্রতিটি চরিত্র হাস্যরসের উদ্রেগ করে।

আজকাল প্রায় শোনা যায় স্ত্রী নির্যাতন কেস (মামলা) আছে স্বামী নির্যাতন কেস নেই! আসলে পুরুষ শাসিত সমাজে স্বামী নারীদেরকে নির্যাতন করে পেশি শক্তির বলে। কিন্তু পেশি শক্তিতে না পারলেও মানসিক শক্তিতে নারীরাও নির্যাতন করতে পারে। এমন কাহিনীর সাথে একটু রঙ চড়িয়ে সৈয়দ মুজতবা আলী লিখেছেন ‘দাম্পত্য জীবন’। যেখানে স্বামীরা স্ত্রীর নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে মিছিল-মিটিং করে। এমন একটি সভা চলা কালে শোনা গেল স্ত্রীরা ঝাটা নিয়ে সভা পণ্ড করতে আসছে। এই খবর রটার সাথে সাথে সভাস্থল খালি হয়ে গেল। একমাত্র সভাপতি সেখান থেকে নড়ল না। পাঠকের মনে হতে পারে তাহলে কি একমাত্র সভাপতি বীরপুরুষ? না, কেউই বীরপুরুষ নয়। দারোয়ান গিয়ে দেখল সভাপতি মারা গেছে। সভাপতির চিরতরে পালানোটা ট্রাজেডি কিন্তু এখানেও না হেসে পারা যায় না। পাঠকের মনের কোণে অদ্ভুত হাসির সুড়সুড়ি দেয়। এই রকম ট্রাজেডি আমাদের আবেগ আপ্লুত করে না। বরং হাস্যরসের কারণ হয়।‘রামগড়ুরের ছানা হাসতে তাদের মানা,/ হাসির কথা শুনলে বলে,/হাসব না-না, না-না।’ আপনি যদি রামগড়ুরের ছানার মতো এমন কোনো পণ করে থাকেন যে, হাসবেন না, তাহলে মারাত্মক ভুল করবেন। কারণ হাসি আপনার জীবনের জন্য খুবই উপকারি। কখনো আনন্দ আপনার হাসি এনে দেয় আবার কখনো হাসিও আপনার আনন্দ এনে দেয়।

লেখক: অধ্যক্ষ, কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ, কুড়িগ্রাম

সারাবাংলা/এএসজি

প্রফেসর মীর্জা মো. নাসির উদ্দিন মত-দ্বিমত সুস্থতা হাসি

বিজ্ঞাপন

শেরপুরে মাইক্রোবাসচাপায় নিহত ২
২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১১:১৯

খুলনা মহানগর বিএনপির সম্মেলন সোমবার
২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১০:৫৪

আরো

সম্পর্কিত খবর