চর উন্নয়ন মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠাই সমাধানের পথ
২৭ মার্চ ২০২৫ ১৮:১৪
শরীরের রক্তশিরার মতোই বাংলাদেশের অসংখ্য নদ-নদী এদেশকে বাঁচিয়ে রেখেছে। মিসরের নীল নদ যেমন মিসরের প্রাণ তেমনি পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র সহ অসংখ্য নদ-নদী বাংলাদেশের অর্থনীতি ও পরিবেশতন্ত্রের প্রাণ স্পন্দন। ঢাকার মূল ভিত্তি ও জীবন প্রবাহ তৈরী করেছে তার চার পাশে থাকা বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষা, তুরাগ, বালু প্রভৃতি নদী। ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর যথাযথ এবং সঠিক ব্যবস্থাপনা করতে পারলে ঢাকা বহু আগেই হংকং কিংবা সিঙ্গাপুরের চেয়েও সুন্দর এবং নান্দনিক মহানগরীতে পরিণত হতো। বাংলাদেশের নদীগুলোর গতিপথ পরিবর্তন এবং শীতকালে পলি জমার কারণে প্রতি বছর নতুন নতুন চর জেগে ওঠে আবার বর্ষাকালে পানির প্রবল স্রোতে নদী ভাঙ্গনে চর বিলুপ্ত হয়। চরের আয়তন ও বসবাসকারি লোকের সংখ্যা প্রতিনিয়তই পরিবর্তনশীল। সূত্রমতে বাংলাদেশে ১০ লাখ হেক্টর আয়তনের চর রয়েছে। প্রতিবছর দেশে ৫২ বর্গকিলোমিটার নতুন চর সৃষ্টি হয় এবং ৩২ বর্গকিলোমিটার আয়তনের চর নদী গর্ভে বিলীনও হয়ে যায়। চরে বসবাসকারি লোকের সংখ্যা প্রায় ২০ মিলিয়ন। চরের এই বিপুল জনগোষ্ঠীর খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষাসহ হাজারও সমস্যা রযেছে। লেখার পরিধি যাতে বৃদ্ধি না পায় সেজন্য আজকের লেখায় শুধুমাত্র বন্যা ও নদী ভাঙ্গন নিয়ে আলোচনা করব। অন্য বিষয়গুলো পরবর্তীতে ধারাবাহিকভাবে লেখার আশাবাদ ব্যক্ত করছি।
বন্যা ও নদী ভাঙনের মধ্যে গভীর সম্পর্ক রয়েছে। দেশে বন্যা যত বেশি হবে নদী ভাঙ্গনের হারও তত বৃদ্ধি পাবে। বন্যার পানির তীব্র স্রোত মাটিকে দূর্বল করে দেয় ফলে নদীর পাড় এবং সংলগ্ন এলাকা ভাঙ্গনের কবলে পড়ে। বন্যার কারণে নদীতে পলি জমে নদীর গভীরতা কমিয়ে দেয় এবং নদী ভাঙনের ঝুঁকি বাড়ায়। দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে প্রায় ৩২টি জেলা নদী ভাঙনের ঝুঁকিতে, প্রতি বছর প্রায় ৮৭০০ হেক্টর জমি হারিয়ে যায়। ফলে প্রায় দুই লক্ষ মানুষ আবাদী জমি ও বসতি হারিয়ে গৃহহীন হয়ে পড়ে। (Alam et al 2017). নদী ভাঙ্গনের ফলে প্রতিবছরে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ২৫ কোটি ডলার।
প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলোর মধ্যে বন্যা, নদী ভাঙ্গন, খরা, সাইক্লোন, ব্জ্রপাত, তাপদাহ, কালবৈশাখি ইত্যাদি অন্যতম। নদী অববাহিকায় সৃষ্ট চরাঞ্চলের মানুষ উল্লেখিত প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয় বন্যা এবং নদী ভাঙ্গনে। NASA Earth Observatory-এর তথ্য মতে ১৯৬৭ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত শুধুমাত্র পদ্মা নদীর ভাঙ্গনেই ৬৬ হাজার হেক্টর জমি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। নদী ভাঙ্গনের ফলে নদীর স্রোতে বয়ে আসা বালি, পলি, কাদা এবং সুক্ষ পাথরে নতুন নতুন চর সৃষ্টি হয়েছে। চর সৃষ্টি এবং ভাঙ্গন দু’টিতেই রয়েছে চরের মানুষের দু:খ, অসুবিধা আর বিড়ম্বনা।
বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত জেলা কুড়িগ্রামে রয়েছে ছোট-বড় ১৬টি নদী । ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমর এ জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত থাকায় বন্যা ও নদী ভাঙ্গন অত্যন্ত বেশি। জেলার মোট আয়তন ২২৪৫ বর্গকিলোমিটার এবং চর এলাকার আয়তন জেলার মোট ভূমির ২২%। জেলার ৪২০টির অধিক চরে প্রায় ৫-৬ লাখ লোক বাস করে। জেলার ৬২২.৭৫ বর্গ কিলোমিটার বা ২৭.১২% এলাকা প্রাকৃতিক দূর্যোগের ক্ষেত্রে অতি উচ্চ ঝুকিপূর্ণ এবং ২৭৮.৭৫ বর্গ কিলোমিটার বা ১২.১৪% এলাকা উচ্চ ঝুকিপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে বিবেচিত। ১৬টি নদ-নদীর মধ্যে প্রায় সকল প্রধান নদীতেই বন্যা এবং নদীভাঙন হয়ে থাকে। ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, তিস্তা, দুধকুমার এবং গঙ্গাধর নদীর কমপক্ষে ৩০টি পয়েন্টে বর্তমানে নদীভাঙনের সমস্যা হয়ে থাকে। এবং বন্যার ঝুঁকি রয়েছে (BWDB,2022)। বিশেষ উদ্বেগের বিষয় হল যে এই অঞ্চলে প্রতি ৫-৬ বছরে একটি বিশাল বন্যার ঘটনা ঘটে (Nahar et al,2014)।
জেলার নদীগুলো ভাঙ্গন প্রবন হওয়ার কারণ নদীর গতিপথের পরিবর্তন, শিয়ার শক্তির তারতম্য, ভূ-রূপবিদ্যা, তলদেশ এবং তীরের উপকরণের বৈশিষ্ট্য, তীরের দিকে হঠাৎ করে চাপের ভারসাম্যহীনতা, গাছপালার আবরণ কম থাকা, খালের প্রবাহে বাধা, কাঠামোর উপস্থিতি, এবং বাতাস ও ঢেউয়ের সংস্পর্শে আসা উল্লেখ যোগ্য (Islam and Rashid, 2022; Rahman et al, 2015)।
রিভারস অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টার (RDRC) জানুয়ারী ২০২৩ থেকে ডিসেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত প্রকাশিত সরকারি তথ্য, বিভিন্ন একাডেমিক গবেষণাপত্র এবং সংবাদপত্রের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বলা হয়েছে দেশের ৭৯টি নদী হয় শুকিয়ে যাচ্ছে অথবা ইতিমধ্যেই শুকিয়ে গেছে। তন্মধ্যে খুলনা বিভাগে ২৫টি, রাজশাহীতে ১৯টি, রংপুরে ১৪টি, চট্টগ্রামে ০৬টি, ময়মনসিংহে ০৫টি, ঢাকায় ০৪টি এবং বরিশাল ও সিলেট বিভাগে ০৩টি করে নদী রয়েছে। উক্ত তালিকায় কুড়িগ্রাম জেলার ০৩টি উল্লেখযোগ্য নদী তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমরেরও নাম রয়েছে। নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে শুকিয়ে গেলে নদীর গভীরতা কমে যায়, ফলে নদীর জলধারণ ক্ষমতা হ্রাস পায়। বর্ষাকালে অতিরিক্ত জল প্রবাহের কারণে নদীর দুই তীরে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হয়। এই অতিরিক্ত চাপের কারণে নদীর পাড় ভেঙে যায়। এছাড়াও নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে স্রোতের গতিপথ পরিবর্তন হয়ে নদী ভাঙ্গনের সৃষ্টি করে। যদিও তালিকায় কুড়িগ্রামের তিন টি নদীর নাম রয়েছে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এ জেলার সকল নদীরই অবস্থা একই রকম। তাছাড়া ভারত থেকে কোন কোন সময় অপ্রয়োজনে অতিরিক্ত পানি ছেড়ে দেয়ার কারণেও এ জেলার নদী ভাঙ্গনের হার অনেক বেশি।
জেলার সব কটি উপজেলার চরাঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রার ওপর নদীভাঙনের ক্ষতিকর প্রভাব বর্ণনাতীত। গবেষণায় দেখা গেছে যে বর্ষাকালে প্রতি বছর ভাঙন ঘটে। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ যারা বাঁধের বাইরে বসবাস করে এবং কিছু মানুষ যারা দুর্বল এবং অপেক্ষাকৃত কম উচ্চতার বাঁধে বাস করে তারাই ভাঙ্গনের শিকার হয়। ক্ষতিগ্রস্থদের অধিকাংশই কৃষক, অল্প সংখ্যক শ্রমিক, মৎসজীবী, ভ্যান ও ঘোড়ার গাড়ি চালক এবং নৌকার মাঝি। নদী ভাঙ্গনের ফলে অবকাঠামো, জীবিকা এবং বাস্তুতন্ত্রের ব্যাপক ধ্বংস সাধিত হয়। চরাঞ্চলের কৃষিজমি, বসতি এবং সম্পত্তি হারিয়ে অধিবাসীরা ধীরে ধীরে ভূমিহীন হয়ে পড়ে। অবশিষ্ট জমির টপ সয়েল ধূয়ে যেয়ে একদিকে যেমন জমির উর্বরতা নষ্ট হয়ে যায় অন্যদিকে বন্যায় নদীর তীর ভাঙনের ফলে বালি ও কাদার আচ্ছাদনে জমি পুরোপুরি ফসল জন্মানোর অনুপযোগী হয়ে পড়ে। বন্যা, নদী তীরবর্তী ভাঙ্গন, খরা এবং ভূমিধ্বসের জন্য মানুষকে চরভূমি থেকে স্থানান্তরিত হতে হয় (Lein 2000)। সীমিত অর্থনৈতিক সম্পদ, দুর্বল সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী এবং প্রাকৃতিক সম্পদের উপর অত্যধিক নির্ভরশীলতা সম্পন্ন চরের এ মানুষগুলোর দু:খ কষ্টের সীমা-পরিসীমা থাকে না। নদী ভাঙনের কারণে, কুড়িগ্রামের হাজার হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত এবং নিঃস্ব হয়ে পড়ে, প্রতি বছর তাদের ঘরবাড়ি, জীবিকা এবং কৃষিজমি হারায়। নদী ভাঙ্গনে অপ্রতিরোধ্য ক্ষতি, সীমিত সম্পদ বিনাশ এবং দুর্বল সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর কারণে ভুক্তভোগীরা নিকটবর্তী চর, শহর, শিল্পাঞ্চল কিংবা রাজধানীতে গমন করে বস্তি কিংবা অনিরাপদ পরিবেশে বসবাস করে। চরের বাস্তুচ্যুত এ মানুষগুলো কর্মসংস্থানের অভাবে চরম পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়, দক্ষতার অভাবে ভালো কাজ পায় না কিংবা কাজের পারিশ্রমিক নিয়ে তাদের দর কষাকষির ক্ষমতা খুব একটা থাকে না। অনেকেই নির্মাণ, গৃহস্থালির কাজ বা ইট তৈরির মতো অনানুষ্ঠানিক কাজ নিযুক্ত হন, যেখানে শ্রম আইন এবং কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তার মান ব্যাপকভাবে উপেক্ষিত। তাদেরকে বাধ্য হয়েই বিপজ্জনক পরিবেশে কম বেতনে দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করতে হয় (Bharadwaj et al, 2022)। উদাহরণস্বরূপ, ইটভাটায় কাজ করা শ্রমিকরা প্রায়শই ধুলো এবং দূষিত বাতাসের দীর্ঘস্থায়ী সংস্পর্শের কারণে ফুসফুসের রোগে ভোগেন। অনেকে আবার মধ্যসত্বভোগী বা নিয়োগকারীদের দ্বারাও শোষিত ও প্রতারিত হন, যারা তাদের সুরক্ষা এবং অধিকারকে আরও ক্ষুন্ন করে (Bharadwaj & Huq,2022)।
জেলার নদীগুলো ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে সংকুচিত হচ্ছে নদীর প্রসারতা। পলি জমে উঁচু হচ্ছে চরের জমি। চরগুলো আগের মতো ঢালু বা জলমগ্ন থাকে না। ভরাট ও উঁচু হয়ে যাওয়ার ফলে চরে আগের মতো কাশ, নলখাগড়া, ছন, হরগোজা প্রভৃতি উদ্ভিদ তেমন জন্মাতে দেখা যায় না। ফলে তীরে জন্মানো উদ্ভিদের স্বাভাবিক বংশবৃদ্ধি প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। নদীর চর থেকে হারিয়ে গেছে এসব উদ্ভিদ। আগের মতো শরতে কাশের সৌন্দর্য আর আমাদের দুই নয়নকে মোহিত করে না।
বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় পরিবেশ ও ভৌগোলিক তথ্য পরিষেবা (CEGIS) এর গবেষণা অনুযায়ী কুড়িগ্রামের বিভিন্ন নদীর ভাঙ্গনে বছরে প্রায় ১০০ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়। এই ক্ষতির মধ্যে আবাদি জমি, ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট এবং স্থানীয় অবকাঠামো ধ্বংস অন্তর্ভুক্ত (https://www.cegisbd.com). কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসনের ২০২০ সালের একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে, ব্রহ্মপুত্র নদের ভাঙ্গনে কুড়িগ্রামে গড়ে ২০০ থেকে ৫০০ হেক্টর, ধরলা নদীর ভাঙ্গনে ২০০-৩০০ হেক্টর, তিস্তা নদীর ভাঙ্গনে ১০০-১৫০ হেক্টর জমি নদী গর্ভে বিলীন হয়। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (UNDP)-এর প্রতিবেদন অনুসারে কুড়িগ্রামে প্রতি বছর গড়ে ২০,০০০-৩০,০০০ মানুষ নদী ভাঙনের শিকার হয়ে বাস্তুহারা হয় (UNDP, 2019) । দ্য ডেইলি স্টার এর ২০২১ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয় গত ১০ বছরে নদীর ভাঙ্গনে উত্তরাঞ্চলের ১০,০০০+ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে যার সামগ্রিক আর্থিক ক্ষতি ২০০-৩০০ কোটি টাকা। ২০২২ সালের বন্যায় কুড়িগ্রামে ৮৫% ফসলী জমি প্লাবিত হয় যা স্থানীয় খাদ্য নিরাপত্তাকে ঝুঁকিতে ফেলে (কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, ২০২২)। ২০২০-২০২৩ সালের মধ্যে নদীভাঙনে কুড়িগ্রামের ৫০টি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ৩টি স্বাস্থ্যকেন্দ্র ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে (স্থানীয় প্রশাসন, ২০২৩)। ২০২১ সালে ব্রহ্মপুত্রের তীব্র স্রোতে কুড়িগ্রাম-চর রাজিবপুর সড়কের ১০ কিলোমিটার অংশ বিলীন হয়ে যায় (দৈনিক প্রথম আলো, ২০২১)। দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকার ২০২২ এর একটি প্রতিবেদনে বলা হয় নদীর ভাঙ্গনে কুড়িগ্রামে এক মাসে ২০০+ বাড়ি ও ৫০ একর জমি নদীগর্ভে বিলীন হয় যার ক্ষতি প্রায় ১০ কোটি টাকা। গবেষণা পত্র জার্নাল অফ হাইড্রোলজি-এর ২০২০ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে উল্লেখ করা হয় যে নদীর ভাঙ্গনের ফলে প্রতি বছর গড়ে ১% – ২% কৃষি জমি হ্রাস পায় যা উত্তরাঞ্চলের স্থানীয় অর্থনীতিতে প্রতি বছর ৫০-৬০ কোটি টাকা ক্ষতির কারণ হয়। ভারতের গজলডোবা বাঁধে পানির অনিয়ন্ত্রিতভাবে ছেড়ে দেয়ার কারণে তিস্তার পানি প্রবাহ অপ্রত্যাশিতভাবে ওঠানামা করে যা এ অঞ্চলে আকস্মিক বন্যার ঝুঁকি বাড়ায় (ইন্টারন্যাশনাল রিভার্স, ২০২০)। তবে এই পরিসংখ্যানগুলো ভৌগোলিক অবস্থান ও সময়ভেদে পরিবর্তনশীল হতে পারে।
Assessing the flood and river bank erosion impacts and coping strategies in Hatia union of Ulipur, Kurigram, Bangladesh শিরোনামের গবেষণা পত্রে নদী ভাঙ্গনের ফলে চর ও পার্শ্ববর্তী বন্যা কবলিত এলাকার মানুষের জীবন যাত্রার বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়েছে। কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুর উপজেলায় অবস্থিত হাতিয়া ইউনিয়ন কুড়িগ্রামের সবচেয়ে দুর্যোগপ্রবণ এলাকাগুলির মধ্যে একটি। বন্যা এবং তীর ভাঙনের ফলে ব্যক্তি এবং সম্প্রদায়ের উপর মারাত্মক বিরূপ প্রভাব পড়ে।
২০২০ সালে হাতিয়ার ওপর দিয়ে প্রবাহিত ব্রহ্মপুত্র নদের কারণে দীর্ঘস্থায়ী বন্যা দেখা দেয়। রাস্তাঘাট এবং হাঁটার পথ ডুবে যাওয়ার ফলে অধিবাসীদের চলাচল এবং যোগাযোগ ব্যবস্থায় মারাত্মক সমস্যা দেখা দেয়। ব্রহ্মপুত্র নদ প্রবল বন্যার সময় একটি বিশাল এলাকা প্লাবিত করে এবং নদের প্রস্থ বেড়ে ১২-১৫ কিলোমিটারে দাড়ায়। বাসিন্দারা জলবন্দী হয়ে পড়ে এবং যোগাযোগের জন্য ছোট মাছ ধরার নৌকা ব্যবহার করতে হয় অথবা কলা বা বাঁশ গাছ দিয়ে ভেলা তৈরি করতে হয়। পানি বন্দীকালীন আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হল নিরাপত্তা। বন্যার সময় ডাকাতের দল গরু, ছাগল এবং অন্যান্য গবাদি পশু লুট করার জন্য বড় নৌকা নিয়ে গ্রামে আক্রমণ করে যা প্রতিহত করার মতো শক্তি বা সাহস কোনটাই পানিবন্দী মানুষের থাকে না।
নদী ভাঙনের শিকার মানুষদের মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা অত্যন্ত জটিল এবং গভীর। এই প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে তারা শুধু তাদের ঘরবাড়ি, জমিজমা এবং জীবিকাই হারান না বরং তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও মারাত্মক প্রভাব পড়ে। নদী ভাঙন প্রায়শই আকস্মিক এবং ধ্বংসাত্মক ঘটনা যা গুরুতর মানসিক আঘাতের কারণ হতে পারে। ক্ষতিগ্রস্থদের তীব্র মানসিক চাপ এবং পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (পিটিএসডি) দেখা দেয়। দীর্ঘস্থায়ী মানসিক চাপ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত করে। কর্টিসলের মতো স্ট্রেস হরমোন ইমিউন প্রতিক্রিয়ার কার্যকারিতাকে দমন করে ভাইরাস এবং ব্যাকটেরিয়ার মতো জীবানুর বিরুদ্ধে লড়াই করার মতো শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতাকে দূর্বল করে। স্ট্রেস হরমোন নিঃসরণের কারণে হৃদস্পন্দন এবং রক্তচাপ বেড়ে হার্ট অ্যাটাকের পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। সামান্য মানসিক চাপেও মাথা ব্যথা, ক্লান্তি ও খাদ্য পরিপাকে সমস্যার সৃষ্টি হয়। ভাঙনের কারণে অনিশ্চয়তা , অস্থিরতা, প্রবল দুশ্চিন্তা এবং অসহায়ত্বের অনুভূতি সৃষ্টি হয় এবং বিচ্ছিন্নতা এবং একাকীত্বের অনুভূতি তৈরি করে। নদী ভাঙন মানুষকে স্থানান্তরিত হতে বাধ্য করে যা তাদের সামাজিক নেটওয়ার্ককে বিনষ্ট করে। নতুন পরিবেশে অভিযোজিত হতে সময় লাগে এবং অনেক ক্ষেত্রে নদী ভাঙ্গা মানুষকে অন্যরা উদবাস্তু ভেবে হেয় প্রতিপন্ন করে। মানুষ তাদের ঘরবাড়ি, সম্পত্তি এবং পরিচিত পরিবেশের ক্ষতির জন্য শোক অনুভব করে।
স্থানীয়দের মতে, কয়েক বছর আগে ব্রহ্মপুত্র নদ যেখানে ছিল সেখান থেকে প্রায় আধা কিলোমিটার দূরে প্রবাহিত হতো। তবে নদীর তীর ভাঙনের কারণে, নদীটি আরও কাছে এসে এলাকাটিকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। বিভিন্ন তথ্যের ওপর ভিত্তি করে দেখা যায় বন্যা ও নদী ভাঙ্গনের ফলে জমি বা সম্পত্তির ব্যাপক ক্ষতি হয়, বাসিন্দরা গৃহহীন হয়ে পড়ে, দারিদ্রতা বৃদ্ধি পায়, কর্মসংস্থান হ্রাস পায়। উদাহরণস্বরূপ, মাত্র তিন থেকে চার বছর আগে ‘নয়া ডারা’ নামে একটি গ্রাম ভাঙনের ফলে সম্পূর্ণরূপে নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এই সময়ে ‘পালের হাট বাজার’ এবং আশেপাশের এলাকা ভাঙনের কারণে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে এবং কিছু বাসিন্দা এলাকা ত্যাগ করে অভিবাসী হয়। দারিদ্রের ফলে শিক্ষা কার্যক্রম বাধা প্রাপ্ত হয় যার ফলে বাল্য বিবাহ বৃদ্ধি পায়। আর বাল্য বিয়ের কারণে প্রতিবন্ধী সন্তানের সংখ্যাও বেশি হয়।
এ গবেষণার উদ্দেশ্য ছিল হাতিয়া ইউনিয়নের স্থানীয় জনগণের উপর বন্যা এবং নদীর তীর ভাঙনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব মূল্যায়ন করা। বন্যা এবং নদীর তীর ভাঙনের মতো দুর্যোগের সময় এবং পরে বাসিন্দারা কীভাবে এই দুর্যোগের ঘটনাগুলি মোকাবেলা করে এবং তারা কী কৌশল গ্রহণ করে তা অন্বেষণ করা। গবেষণায় দেখা গেছে যে এই দুর্যোগের কারণে মানুষ ক্রমাগত কষ্ট ভোগ করে। ঘরবাড়ি, ফসল, গবাদি পশু, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং স্বাস্থ্যসেবা সুবিধার ব্যাপক ক্ষতি হয়। যোগাযোগের সকল মাধ্যম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। বন্যার সময় বাসিন্দাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিতে হয়। সকল প্রকার খাদ্য নিরাপত্তা বিঘিœত হয় বলে তারা ত্রাণের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। বেকার সমস্যা তৈরি করে, যার ফলে এই অঞ্চলে তীব্র অর্থনৈতিক দুর্দশা দেখা দেয়। বন্যার পাশাপাশি নদীর তীর ভাঙন দেখা দিলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়। নদীর তীর ভাঙনের ফলে বাসিন্দাদের ব্যাপক ভূমি নদী গর্ভে বিলীন হয়। অনেক ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের অন্য জায়গায় স্থানান্তরিত হওয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না, যেখানে তারা প্রায়শই দুর্বিষহ জীবনযাপন করে। সুবিধাবঞ্চিত মানুষের কাছে প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা পৌঁছাতে সমন্বয়েরও অভাব রয়েছে। এই দুর্যোগ মোকাবেলায় সক্রিয় নীতিমালা বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। নীতি ও পরিকল্পনাগুলিতে কেবল বন্যা ও নদীভাঙনের তাৎক্ষণিক প্রভাব কমানোর উপরই জোর দেওয়া উচিত নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদী স্থিতিস্থাপকতা তৈরিতেও অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। স্থানীয় জনগণের নিরাপত্তা, সমৃদ্ধি, কল্যাণ এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্থানীয় জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নত করার জন্য সমন্বয় অপরিহার্য। দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস পরিকল্পনা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় স্থানীয় সম্প্রদায়কে সম্পৃক্ত করার ফলে আরও টেকসই এবং সম্প্রদায়-কেন্দ্রিক উদ্যোগ তৈরি হতে পারে।
কুড়িগ্রামের হাতিয়ার এই করুন চিত্রের মাধ্যমে সারাদেশের বন্যা ও নদী ভাঙ্গন কবলিত এলাকার চিত্র ফুটে ওঠেছে। নদী ভাঙ্গনের সময় পানি উন্নয়ন বোর্ডের কিছু জিও ব্যাগ স্থাপন এবং বন্যার সময় পানি বন্দী মানুষের হাতে কিছু ত্রাণ সামগ্রী তুলে দেয়া দেশের ৩২টি জেলার চরবাসী কিংবা নদী অববাহিকার মানুষের জন্য পর্যাপ্ত নয় কিংবা এটি স্থায়ী কোন সমাধানও নয়। অনগ্রসর বিবেচনায় পার্বত্য চট্রগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠণ করা হয়েছে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলকে এগিয়ে নিতে। কিন্তু চরাঞ্চলের মানুষ সার্বিক বিবেচনায় একটি পিছিয়ে পড়া সুবিধা বঞ্চিত ঝুকিপূর্ণ বিপদগ্রস্থ জনগোষ্ঠী। পৃথিবীর যে কোন অঞ্চলের মানুষের শান্তিপূর্নভাবে ঘুমাতে পারার নিশ্চয়তা আছে কিন্তু চরবাসী যে ঘরে ঘুমায় সেটি নিয়েও আছে অনিশ্চয়তা, ঘুমের মধ্যেই নদী গর্ভে বিলীন হওয়ার অনেক ঘটনা আছে। তাদের আপনজনের কবরও যখন তখন ভেসে নিয়ে যায়। তাদের পরিশ্রমে গড়া ফসল ঘরে তোলা নিয়ে কখনও আত্মবিশ্বাসী হতে পারে না।এতকিছুর পরও নদীকে এড়িয়ে মানুষের জীবন গড়া ও সভ্যতার ঐশ্বর্য নির্মাণ অকল্পনীয়। বিশ্বের ছোট বড় মিলে ২৭টি সভ্যতার মধ্যে প্রায় সভ্যতাই গড়ে উঠেছে নদ-নদীকে ঘিরে। বস্তুত মানবসভ্যতা ও নদী পরস্পর সম্পর্কিত এবং অনেক ক্ষেত্রে পরিপূরক বললেও ভুল হবে না। নদীকে কেন্দ্র করেই মানবসভ্যতার উৎপত্তি, বিকাশ ও বিস্তার ঘটেছে। মানব সভ্যতার বাস্তবতার আলোকে ও চরবাসীর দু:খ দূর্দশার প্রেক্ষাপটের সার্বিক বিবেচনায় স্থায়ী সমাধানের জন্য সাম্প্রতিক সময়ে চর অঞ্চলের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য আলাদা মন্ত্রণালয় গঠণের দাবি ওঠেছে কুড়িগ্রাম জেলা থেকে। এটি শুধু কুড়িগ্রামের স্থানীয় সমস্যা নয়, এটি সারা দেশের নদী অববাহিকার মানুষের সমস্যা। তাই চর উন্নয়ন মন্ত্রণালয় গঠণের মাধ্যমে কুড়িগ্রাম সহ সারাদেশের বন্যা ও নদীভাঙন মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। চর বিষয়ক আলাদা মন্ত্রণালয় গঠিত হলে তার ব্যবস্থাপনায় যে উন্নয়ন ঘটবে তাতে নদী একটি উন্নয়নের শক্তি হিসেবে দাড়িয়ে যাবে। আর সেটি করা সম্ভব হলে বাংলাদেশ হবে চর উন্নয়নের রোল মডেল যা থেকে বিশ্ববাসীও অভিজ্ঞতা নিতে পারবে।
লেখক: অধ্যক্ষ, কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ, কুড়িগ্রাম
সারাবাংলা/এএসজি
চর উন্নয়ন মন্ত্রণালয় প্রফেসর মীর্জা মো. নাসির উদ্দিন মত-দ্বিমত