বন্ধু নাকি প্রতারক?
২২ ডিসেম্বর ২০১৭ ১৪:৪০
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পড়তে গেলে আবু সাঈদ চৌধুরীর নামটা বারবার আসবে। পাকিস্তান আমলে ঢাকা হাইকোর্টের বিচারক ছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন। বাংলাদেশের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি ছিলেন। ’৭৫ এর ৮ আগস্ট পর্যন্ত ছিলেন বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার বন্দর ও নৌপরিবহণ মন্ত্রী আবার ১৫ আগস্টের পর যোগ দেন খন্দকার মোশতাকের সভাসদ হিসেবে, দায়িত্ব পান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের।
আজকে যে গল্পটা বলবো, তাতে আবু সাঈদ চৌধুরীর একটা যোগসূত্র আছে। ১৯৬৯ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান । একাত্তরের মার্চ মাসে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের অধিবেশনে যোগদানের জন্য তিনি জেনেভা যান। সেখানে জেনেভার একটি পত্রিকায় দু’জন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রের মৃত্যু সংবাদ দেখে বিচলিত হয়ে ২৫ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক শিক্ষা সচিবকে পাকিস্তান দূতাবাসের মাধ্যমে প্রেরিত এক পত্রে লেখেন, “আমার নীরস্ত্র ছাত্রদের উপর গুলি চালানোর পর আমার ভাইস চ্যান্সেলর থাকার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। তাই আমি পদত্যাগ করলাম”।
তিনি বিবিসিকে অত্যন্ত আবেগপূর্ণ ভাষায় একটি সাক্ষাৎকার দেন। সেই সাক্ষাৎকার ভারতীয় পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হলে তাজউদ্দীন আহমদের নজরে পড়ে। তিনি ব্যারিস্টার আমীরুল ইসলামের মাধ্যমে আবু সাঈদ চৌধুরীর সাথে যোগাযোগ করেন। তখন মুজিবনগর সরকার গঠনের তোড়জোড় চলছিল। তাজউদ্দীন আহমদ সেই সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে প্রবাসে কাজ করতে আহ্বান জানান। আবু সাঈদ চৌধুরী তাতে সম্মত হন এবং মুজিবনগর সরকার গঠিত হবার পরে ২১ এপ্রিল বিচারপতি চৌধুরীর নিয়োগপত্রে অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম স্বাক্ষরদান করেন।
এরপর থেকে পুরো মুক্তিযুদ্ধকালে আবু সাঈদ চৌধুরী দেশ বিদেশে ঘুরে ঘুরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে সমর্থন আদায়ের চেষ্টা চালান। তার প্রচেষ্টায় এ কাজে সাফল্যও এসে। অনেক বিদেশি বন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতার দাবিতে সমর্থন জানান এবং বাংলাদেশের সহায়তায় এগিয়ে আসেন। এদেরই একজন ছিলেন জন স্টোনহাউজ।
এবার আসুন তার পরিচয় জেনে নেয়া যাক।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে রয়্যাল এয়ারফোর্স-এর বিমানযোদ্ধা ছিলেন। স্বভাবসুলভ স্মার্টনেসের কারণে ৩২ বছর বয়সে হন লেবার পার্টির এমপি। এভিয়েশন মিনিস্ট্রি হয়ে পোস্টমাস্টার জেনারেল, তারপর সবশেষ ছিলেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী। আবু সাঈদ চৌধুরীর সেই সমর্থনকে ভবিষ্যত সম্পর্কের পর্যায়ে নিয়ে যান একমাত্র এই স্টোনহাউজ।
গল্পের এ পর্যায়ে আমরা আরেকজনের সাথে পরিচিত হব। তিনি ভারতীয় বাঙ্গালি, পুরো নাম বিমানচাঁদ মল্লিক। বিমান মল্লিক নামেই অধিক পরিচিত। একজন প্রখ্যাত গ্রাফিক্স ডিজাইনার, মুক্তিযুদ্ধের সময় লণ্ডনের কেন্টের ফোক্ স্টোন স্কুল অব আর্ট এবং এসেক্সের হারলো টেকনিক্যাল কলেজের অধ্যাপনায় নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৬৯ সালে ব্রিটিশ ডাকবিভাগ মহাত্মা গান্ধীর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ডাকটিকিট প্রকাশের জন্য নকশা আহ্বান করে। বিমানচাঁদের নকশা সেখানে নির্বাচিত হয় এবং এজন্য উনি সেজন্য স্বর্ণপদকও পান । উল্লেখ্য ব্রিটিশ ডাকবিভাগ সেবারই দেশের বাইরের কোনো ব্যক্তিত্বের ওপর প্রথম ডাকটিকিট প্রকাশ করে। এ ডাকটিকিট নকশা করার সময় বিমানচাঁদের পরিচয় হয় স্টোনহাউজের সাথে।
এদিকে স্টোনহাউজ আবার ১৯৭১ সালের এপ্রিলের শেষের দিকে বাংলাদেশের শরণার্থীদের অবস্থা সচক্ষে দেখার জন্যে ভারতের কলকাতায় যান। সে সময় তিনি তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বলেন, মুক্তাঞ্চলে ব্যবহার করার জন্যে বাঙলাদেশের ডাকটিকেট প্রচলন করা হলে মুক্তাঞ্চল থেকে পাঠানো চিঠিপত্রের মাধ্যমে স্বাধীন বাঙলাদেশের অস্তিত্ব বাস্তব সত্য হিসেবে বিশ্বের কাছে প্রতিষ্ঠা করা সহজ হবে। প্রধানমন্ত্রীর সাথে আলোচনাকালে প্রবাসী সরকারের অর্থমন্ত্রী এম. মনসুর আলীও উপস্থিত ছিলেন। তাজউদ্দীন আহমদ তখন স্টোনহাউসকে স্বাধীন বাংলাদেশের ডাকটিকেট প্রকাশের (সিলমোহর সম্বলিত) অনুমতিপত্র দেন এবং তাকেই উদ্যোগ নিতে অনুরোধ করেন। দেশে ফিরে স্টোনহাইজ ২৯ এপ্রিল তারিখে বিমানচাঁদকে ফোনে বাংলাদেশের জন্য ডাকটিকিট নকশা করার অনুরোধ জানান। ৩ মে তাদের দেখা হয় এবং বিমানচাঁদ সম্পূর্ণ বিনা পারিশ্রমিকে ডিজাইনটি করে দেন।
ছবিতে ডাকটিকিট হাতে বাঁ হতে বিমান মল্লিক, আবু সাঈদ চৌধুরী এবং জন স্টোনহাউজ
ব্রিটেনের একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান ওয়ার অন ওয়ান্ট- এর চেয়ারম্যান ডোনাল্ড চেসওয়র্থ এই ডাকটিকেটের নকশা নিয়ে কলকাতা যান এবং বাংলাদেশের বিপ্লবী সরকারের অনুমোদন নিয়ে লণ্ডন ফিরে যান। জন স্টোনহাউস বাংলাদেশের ডাকটিকেটগুলো লণ্ডনের ফরম্যান্ট ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রেস লিমিটেডকে দায়িত্ব দিয়ে অত্যন্ত সুন্দরভাবে ছাপানোর ব্যবস্থা করেন।
১৯৭১ সালের ২৬ জুলাই লণ্ডনের হাউস অব কমন্সের কোর্ট রুমে আন্তর্জাতিক সংবাদ সম্মেলনে প্রধান বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী স্বাধীন বাংলাদেশের ঐতিহাসিক ডাকটিকেটগুলো এবং ‘ফাস্ট ডে কভার’ প্রদর্শন করেন।
পরদিন লণ্ডনের দ্য টাইমস, দ্য গার্ডিয়ান, দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় এসব সংবাদ প্রকাশিত হয়। দেরিতে হলেও নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত হয় একটি নিবন্ধ । এই ডাকটিকেট প্রকাশনা অনুষ্ঠানে লণ্ডনের পার্লামেন্টের সকল দলের সদস্য উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে পিটার শোর, জন স্টোনহাউস এবং আরও কয়েকজন পার্লামেন্ট সদস্য বাংলাদেশের স্বাধীনতার সমর্থন জানিয়ে বক্তৃতা করেন। অনুষ্ঠানে বিমানচাঁদ মল্লিক ডাকটিকেটগুলোর তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেন। এই প্রকাশনা অনুষ্ঠানে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে উপস্থিত সকলকে ধন্যবাদ জানান।
কলকাতা এবং লন্ডনের বাংলাদেশ মিশন দেশে ২২ রুপি এবং ১.০৯ পাউন্ড দামে এই ফার্স্ট ডে কভার বিক্রি করে। প্রথমদিনে শুধু লন্ডনেই ২৩ হাজার ডলারের ডাকটিকিট বিক্রি হয়। বিশ্বব্যাপী ব্যাপক মিডিয়া কভারেজ পায় সে ঘটনা। ৮ আগস্টের নিউইয়র্ক টাইমস এ নিয়ে বিস্তারিত সংবাদ প্রকাশ করে। এর মধ্যে ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হয়। ১৭ ডিসেম্বর এ সুসংবাদ বিমানবাবুকে জানান জন স্টোনহাউজ। কাকতালীয়ভাবে দিনটি ছিল বিমানচাঁদের ৩৮তম জন্মদিন। জন্মদিনের এমন মধুর উপহার পেয়ে তিনি খুবই আনন্দিত হন। স্টোনহাউজ তাকে বলেন এই ক্ষণটি তিনি ডাকটিকিটের মাধ্যমে উদযাপন করতে চান। সুতরাং ‘বাংলাদেশ লিবারেটেড’ ওভারপ্রিন্ট করে অবিলম্বে কিছু স্ট্যাম্প প্রকাশ করতে হবে। বিমানচাঁদ খুবই আনন্দিত হলেন এবং শুধু ‘বাংলদেশ লিবারেটেড’ না ‘বাংলাদেশের মুক্তি’ এ নামেও তিনি ওভারপ্রিন্ট স্টাম্প প্রকাশ করে স্টোনহাউজকে দেন।
১৯ তারিখ নতুন সংস্করণের দশটি করে শিট নিয়ে কলকাতা পৌঁছান স্টোনহাউজ। ২০ তারিখে ঢাকার জিপিওতে এর প্রকাশনা উৎসব হয় এবং বাংলাদেশের প্রথম ডাকটিকিট হিসেবে স্বীকৃতি পায়। কিন্তু ডাক যোগাযোগের ক্ষেত্রে এর আনুষ্ঠানিক ব্যবহারে রাজি হয় নি বাংলাদেশ সরকার। একজন বিপদের বন্ধু তদুপরি ব্রিটিশ এমপির এমন প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হওয়ার কারণ কি? এখান থেকেই কেঁচো খোঁড়া শুরু হল, সাপ পেয়ে গেলে কেউ অবাক হবেন না।
এই ডাকটিকেটের নকশার জন্য বিমানচাঁদ কোনো পারিশ্রমিক নেননি। এমনকি শিল্পীর প্রাপ্য রয়্যালিটি সম্পর্কে কোনো চুক্তিপত্রেও স্বাক্ষর করেননি। কিন্তু যুদ্ধের পর স্টোনহাউজ এই ডাকটিকিটের জন্য বিশাল অঙ্কের মূল্য দাবি করে বসেন। স্বাভাবিকভাবেই যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ সরকার তা রাখতে পারে নি। আরো জানা যায়, ডাকটিকিট বিক্রি বাবদ যে বিশাল অঙ্কের তহবিল সংগ্রহ করা হয়, তার সঠিক হিসাব বাংলাদেশ সরকারকে দেওয়া হয়নি। যে অংকের টাকা বাংলাদেশের তথা মুজিবনগর সরকারের পাওয়ার কথা তার একটা নগন্য অংশ বাংলাদেশকে বুঝিয়ে দেন স্টোনহাউজ।
আরো পরে ব্রিটিশ পত্রিকা ইন্ডিপেন্ডেন্ট মারফত জানা যায়, তিনি বাংলাদেশের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের নামে যে ফান্ড সংগ্রহ করেছিলেন তা থেকে প্রায় ৬ লাখ পাউন্ড খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মানে সোজা কথায় স্টোনহাউজ এই বিশাল অঙ্কের টাকা তসরুপ করেছিলেন।
গল্পটা এখানেই শেষ হতে পারতো। কিন্তু একে কেবল শুরু বলা চলে। ২১ নভেম্বর, ১৯৭৪ তারিখে ফ্লোরিডার সমুদ্রসৈকত থেকে উধাও হয়ে যান জন স্টোনহাউজ । এফবিআই ধারণা করে মাফিয়া আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন স্টোনহাউজ। আবার তার ব্যবসায়িক ব্যর্থতা এ ধারণাও জন্ম দেয় যে তিনি আত্মহত্যা করেছেন। এ ব্যাপারে তার স্ত্রী বারবারার কোন বক্তব্য পাওয়া যায় নি। তার ব্যক্তিগত সহকারী শীলা বাকলেও কিছু জানেন না বলে জানা যায়।
এবার আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেব লর্ড লুকান নামের এক ব্রিটিশ ভদ্রলোকের সাথে যিনি লর্ড বারমিংহাম নামে বেশি পরিচিত ছিলেন। তিনি বাড়ির পরিচারিকাকে খুন করে ১৯৭৪ সালে ফেরার হন। ইন্টারপোলের কাছে তথ্য ছিল তিনি অস্ট্রেলিয়াতে আছেন। ক্রিসমাসের ঠিক আগে, মেলবোর্ন পুলিশ এক সুদর্শন, বাকপটু আগন্তুকের খবর পায় এবং তাকে লর্ড লুকান ভেবে তার ফ্ল্যাটে অভিযান চালায়। না, লুকান কে পাওয়া যায় নি। কিন্তু তার বদলে পাওয়া যায় জন স্টোনহাউজকে, সাথে ছিলেন ব্যক্তিগত সহকারী তথা প্রেয়সী শীলা। হইচই পড়ে যায় সবখানে। অধিকতর তদন্তে নামেন গোয়েন্দারা। কূটনৈতিক দড়ি টানাটানির পর ’৭৫ এর জুনে ব্রিটেন ফেরত আসেন। তদন্তে ভয়াবহ সব অর্থনৈতিক অনিয়ম ধরা পড়ে। নিজের মৃত্যু দেখিয়ে ইন্স্যুরেন্স থেকে আদায় করেন ১ লাখ ৭০ হাজার পাউন্ড। বাংলাদেশ তাকে সম্মানসূচক নাগরিকত্ব দিয়েছিল। স্টোনহাউজ এদেশে শুরু করেন তার প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল আইমেক্স, যদিও তাতে ’৭৪ এই তালা পড়ে। এদশে একটা ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্ক দিতে চেয়েছিলেন। এজন্য ৮ লাখ পাউন্ড ঋণও করেন। তারপরেই উধাও।
বিচার শুরু হয় আগস্টে। তবে তার আগেই স্টোনহাউজ আবার খেলা দেখান। তখন ব্রিটিশ পার্লামেন্টে খুব অল্প ব্যবধানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় লেবার পার্টি। ৩১৬ আসনের মধ্যে স্টোনহাউজ পদত্যাগ করায় একটা আসন কমে যায়। দুর্বল লেবাররা লিবারেলদের সাথে জোট করতে বাধ্য হয়। কিন্তু পরের নির্বাচনে আর শেষ রক্ষা হয় নি। পতন ঘটে জেমস ক্যালাঘান নেতৃত্বাধীন লেবার পার্টি সরকারের। ক্ষমতায় আসেন মারগারেট থ্যাচার।
তবে এতকিছুর পরও বিচার হয়। ১৮টি মামলায় ৭ বছরের জেল ও হয়। তবে চতুর স্টোনহাউজ তিন বছর জেল খেটেই বেরিয়ে যান স্বাস্থ্যগত অজুহাত দেখিয়ে। বের হয়ে শীলাকে বিয়ে করেন। আরো অনেকদিন পর্দার আড়ালে থেকে বেঁচেবর্তে ছিলেন। ’৮৮ সালে হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। এবার বলুন বিজ্ঞ পাঠক, দুবার মৃত্যুবরণ করা এ ব্যক্তিকে আপনি কি উপকারী বন্ধু বলবেন নাকি ইতিহাসের খাতায় তার নাম থাকবে শুধুই প্রতারক হিসেবে?
সারাবাংলা/এমএম