কুড়িগ্রামে প্রতিষ্ঠা হোক চায়না-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ জেনারেল হাসপাতাল
১৫ এপ্রিল ২০২৫ ১৪:০২
বাংলাদেশে স্বাস্থ্যখাতে একটি বড় ধরনের বিনিয়োগ করতে যাচ্ছে চীন সরকার। এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে ‘চায়না-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ জেনারেল হাসপাতাল’ নামে একটি অত্যাধুনিক হাসপাতাল নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছে। হাসপাতাল স্থাপনের জন্য ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং উত্তরবঙ্গে উপযুক্ত জমি খোঁজা হচ্ছে। ১৯ ফেব্রুয়ারি অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে স্বাস্থ্যখাতে চীনা সহায়তা নিয়ে অনুষ্ঠিত একটি বৈঠকের কার্যবিবরণী এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে এই তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে চীনের সহযোগিতা দীর্ঘদিনের। এদেশের ওষুধ শিল্প প্রায়শই তাদের প্রয়োজনীয় কাঁচামাল চীন থেকে আমদানি করে। এছাড়াও, মেডিকেল সরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতির একটি বড় অংশও চীন থেকে আসে। প্রতি বছর ২০০-৩০০ জন বাংলাদেশী শিক্ষার্থী চীনে চিকিৎসা শিক্ষা গ্রহণ করতে যায়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একটি উচ্চ পর্যায়ের সূত্র জানিয়েছে, বিশ্বসেরা বিশেষজ্ঞদের তত্ত্বাবধানে এই হাসপাতালটি নির্মিত হবে। এই হাসপাতালকে কেন্দ্র করে উত্তরবঙ্গে একটি অত্যাধুনিক চিকিৎসা হাব গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে। আশা করা যাচ্ছে, চলতি মাসের মধ্যেই হাসপাতালটির জন্য স্থান নির্বাচন চূড়ান্ত করা সম্ভব হবে। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রস্তাবিত জেনারেল হাসপাতালটি ঢাকা মহানগরীর মিরপুর, উত্তরা অথবা ধামরাই এলাকায় স্থাপিত হতে পারে। অন্যদিকে, টারশিয়ারি বিশেষায়িত হাসপাতালটি দিনাজপুর, রংপুর, নীলফামারী অথবা উত্তরবঙ্গের অন্য কোনো জেলায় নির্মাণের জন্য উপযুক্ত স্থান বিবেচনা করা হচ্ছে। এই হাসপাতালগুলোর জন্য প্রয়োজন হবে কমপক্ষে ১২ একর নিষ্কণ্টক জমি। একটি সূত্রে জানা গেছে ৫০০ থেকে ৭০০ শয্যার হাসপাতালের জন্য স্থান নির্বাচনের জন্য একটি প্রতিনিধিদল সম্প্রতি নীলফামারি জেলা পরিদর্শনে গিয়েছিলেন কিন্তু তাদের মতে এত বড় হাসপাতালের জন্য একসঙ্গে ১২ একর একর নিস্কন্টক জমি পাওয়া কষ্টকর।
এ ধরণের হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার জন্য কুড়িগ্রাম জেলাকে উপযুক্ত স্থান হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। রংপুর বিভাগের রংপুরে একটি মেডিকেল কলেজ রয়েছে এবং এটিকে রংপুর মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থানান্তরের পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে। এছাড়াও দিনাজপুরে একটি এবং নীলফামারিতে একটি মেডিকেল কলেজ রয়েছে। রংপুর বিভাগের কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট এবং গাইবান্ধা জেলায় কোন মেডিকেল কলেজ নেই। অঞ্চল ভিত্তিতে কুড়িগ্রাম জেলার অবস্থান এই দুই জেলার জেলার মধ্যবর্তী অঞ্চলে। সে হিসেবে কুড়িগ্রাম জেলাকে সবচেয়ে ভালো স্থান হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।
যেহেতু এ ধরণের হাসপাতাল চীনের সহায়তায় নির্মিত হবে তাই নি:সন্দেহে বলা যায় এটি হবে একটি বড় ধরণের আন্তর্জাতিক মানের টারসিয়ারি হাসপাতাল এবং এটি প্রতিষ্ঠার জন্য শুধুমাত্র নিস্কন্টক ১২ একর জমি নয় বরং আরো অনেক জমির প্রয়োজন হবে। সেবিবেচনায় কুড়িগ্রাম জেলায় এ ধরণের জায়গা অবশ্যই খুজে পাওয়া যাবে। সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার বেলগাছা ইউনিয়নের কল্যাণ মৌজা এবং মোগলবাসা ইউনিয়নের নিধিরাম মৌজার মাঝে এবং উলিপুর উপজেলার দূর্গাপুর ইউনিয়নের গোড়াই পাঁচপীর মৌজার কিয়দংশ নিয়ে গঠিত নালিয়ার দোলায় প্রায় ২০০০ (দুই হাজার) একর নিস্কন্টক জমি রয়েছে। উল্লেখিত পরিমাণ জমির মাত্র ২৫০ (দুই শত পঞ্চাশ) একর জমি কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান নির্ধারণে জেলা সদর দপ্তরের গুরুত্ব, রাজধানী ঢাকাসহ অন্যান্য জেলার সাথে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ যোগাযোগ ব্যবস্থা, পরিবেশগত অবস্থা এবং ব্যয় সাশ্রয়সহ সকল দিক অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়েছে। এমনকি সম্ভাব্যতা যাচাইকালে বেশ কয়েকটি টিম কয়েকবার সরেজমিনে পরিদর্শন করে স্থানটির উপযুক্ততা নির্ধারণ করা হয়েছে। কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় যেহেতু একটি বিশেষায়িত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সেহেতু তার সাথে এ ধরণের একটি আন্তর্জাতিক মানের বিশেষায়িত টারশিয়ারি হাসপাতালের সহাবস্থান সবদিক দিয়ে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। তবে অগ্রাধিকার হিসেবে কুড়িগ্রাম জেলাকে নির্বাচন করার জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের নিকট এ জেলাবাসীর পক্ষ থেকে অনুরোধ জানানো হচ্ছে। আমাদের বিশ্বাস সুনির্দিষ্ট স্থান নির্বাচনের ক্ষেত্রে চীন সরকার এবং বাংলাদেশ সরকারের দায়িত্ব প্রাপ্ত বিশেষজ্ঞদের বিবেচনা ও মূল্যায়নই কুড়িগ্রাম জেলাবাসীর আশা-আকাঙ্খাকে প্রতিফলিত করবে এবং উভয় দেশের জন্যই তা মঙ্গলজনক।
বাংলাদেশ ও ভুটান সরকারের যৌথ উদ্যোগে কুড়িগ্রামে জিটুজি ভিত্তিক প্রস্তাবিত ‘ভুটানিজ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল’ স্থাপনে অবকাঠামো ও দুই দেশের আন্তঃযোগাযোগ ব্যবস্থা দেখার জন্য ভুটানের রাজা জিগমে খেসার নামগিয়েল ওয়াংচুক গত ২৮ মার্চ, ২০২৪ কুড়িগ্রামে আসেন। তিনি কুড়িগ্রাম জেলা শহরের পূর্ব পাশে ধরলা ব্রিজের পূর্বে কুড়িগ্রাম-সোনাহাট স্থলবন্দর মহাসড়কের পাশে অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য নির্ধারিত ১৩৩ দশমিক ৯২ একর জায়গা পরিদর্শন করে সন্তোষ প্রকাশ করেন। ২০১৩ সালের হিসাব অনুযায়ী সারা ভুটানে ৩২টি হাসপাতাল আছে। এ হাসপাতাল গুলোতে জটিল রোগের চিকিৎসা দেয়া হয় না। জটিল রোগের ক্ষেত্রে তাদেরকে বাইরের দেশে চিকিৎসা নিতে হয়। ভূটানে কোনো মেডিকেল কলেজে না থাকায় সেখানকার অনেক শিক্ষার্থী বাংলাদেশে বিশেষ করে রংপুর মেডিকেল কলেজ, কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ এবং প্রাইম মেডিকেল কলেজ, রংপুরে পড়াশোনা করছে। কুড়িগ্রামে এ ধরণের একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হলে ভূটান থেকে শুধু শিক্ষার্থীই নয় অনেক রোগীও চিকিৎসা নিতে আসবে। সেক্ষেত্রে কুড়িগ্রাম হলে তাদের জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থাও অনেক সহজ হবে এবং খরচও অনেক কম পড়বে। নেপাল এবং প্রতিবেশী দেশের কয়েকটি রাজ্য থেকেও সড়ক ও নৌ পথে সহজে রোগী সহ লোকজন আসতে পারবে। ফলে এ অঞ্চলে চিকিৎসা হাব প্রতিষ্ঠাসহ মেডিকেল ট্যুরিজমের বিকাশ ঘটবে।
বাংলাদেশের মেডিকেল শিক্ষায় বেসরকারিতে অবকাঠামোগত কিছু দুর্বলতা থাকলেও পড়াশোনার মান ভালো। শিক্ষার্থীরা এখান থেকে পাশ করে নিজের দেশের এন্ট্রি পরীক্ষায় রাশিয়া, চীন ও অন্যান্য দেশ থেকে পাশ করা শিক্ষার্থীদের তুলনায় অনেক ভালো ফল করছে।বর্তমানে ভারতের ১২ হাজার শিক্ষার্থী বাংলাদেশের মেডিকেলে অধ্যয়ন করছে। বিশেষ করে ভারতের দিল্লি, কাশ্মীর, কলকাতা, আসাম, হায়দরাবাদ এবং পাকিস্তান, শ্রীলংকা, ভুটান, মালদ্বীপ ও নেপাল ছাড়াও ফিলিস্তিন, থাইল্যান্ড মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশে পড়তে আসছে। চীনের প্রস্তাবিত টারশিয়ারি হাসপাতলটিকে ভবিষ্যতে মেডিকেল কলেজে রুপান্তর করলে সেক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর অভাব হবে না।
ভারতের কলকাতা,দিল্লী বা অন্য শহরগুলোতে চিকিৎসা ব্যয় অনেক বেশি। বিশেষ করে হাসপাতাল তৈরীর সময় জমি কেনা থেকে শুরু করে বিল্ডিং তৈরি করতে অনেক টাকা ব্যয় হয়। তাছাড়া এ শহরগুলোতে জীবন যাত্রার ব্যয় অনেক বেশি। বাসস্থান, খাদ্য, শিক্ষার ব্যয় অনেক বেশি হওয়ায় ডাক্তার, নার্স ও অন্যান্য কর্মীদের বেতনও অনেক বেশি দিতে হয়। আর এই বাড়তি খরচের বোঝা পড়ে রোগীদের উপর। পক্ষান্তরে ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের ভেলোরের উন্নত চিকিৎসার মান বিবেচনায় খরচ অনেক কম। ডাক্তার, নার্স, কর্মীদের ব্যবহার রোগী বান্ধব। তাই চিকিৎসা ক্ষেত্রে ভারতের ভেলোর এর অনেক সুনাম রয়েছে। প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে অনেক রোগী সেখানে যায়। তেমনি দেশের অন্যান্য জেলার তুলনায় কুড়িগ্রাম জেলায় জমির দাম অনেক কম। জমি অধিগ্রহণ ব্যয়সহ হাসপাতাল নির্মাণের খরচও অনেক কম পড়বে। এখানকার জীবন যাত্রার ব্যয়ও অনেক জেলার তুলনায় সাশ্রয়ী। নদ-নদী বেষ্টিত জেলা হওয়ায় পরিবেশ দূষণ নেই বললেই চলে। দেশের অন্যান্য জেলার সাথে এবং প্রতিবেশি তিনটি রাষ্ট্রের সাথে সড়ক ও নৌ পথে যোগাযোগ ব্যবস্থা অনেক ভালো এবং অদূর ভবিষ্যতে লালমনিরহাট বিমান বন্দর চালু হলে আকাশ পথেও এ জেলার যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্প্রসারিত হবে। বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ওই দেশের সরকার এ দেশের মানুষকে যে হাসপাতাল উপহার হিসেবে দিচ্ছে তা কুড়িগ্রামে প্রতিষ্ঠিত হলে আশা করি উভয় দেশের সরকার ও জনগণ বেশি উপকৃত হবে। ‘চায়না-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ জেনারেল হাসপাতাল’এর মাধ্যমে দেশের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া জেলা উন্নত চিকিৎসা সেবা প্রদানে অনন্য রোল মডেল হিসেবে সারা বিশ্বে দাড়িয়ে যাবে।
লেখক: অধ্যক্ষ, কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ, কুড়িগ্রাম
সারাবাংলা/এএসজি
কুড়িগ্রাম চায়না বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশীপ প্রফেসর মীর্জা মো. নাসির উদ্দিন মত-দ্বিমত