ধরিত্রী দিবস: নবায়নযোগ্য শক্তির আলোয় বাসযোগ্য পৃথিবীর অঙ্গীকার
২২ এপ্রিল ২০২৫ ১৯:৫১
প্রতি বছর ক্যালেন্ডারের পাতায় ২২ এপ্রিল তারিখটি ফিরে আসে একটি বিশেষ বার্তা নিয়ে। এই দিনটি বিশ্ব ধরিত্রী দিবস, আমাদের এই নীলাভ গ্রহের প্রতি ভালোবাসা, কৃতজ্ঞতা এবং দায়িত্ববোধ প্রকাশের দিন। ২০২৫ সালের এই দিনটি, একটি মঙ্গলবার, বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি মানুষ আবারও একত্রিত হয়েছে পরিবেশগত সংকট নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে এবং আমাদের একমাত্র আশ্রয়স্থল পৃথিবীকে রক্ষা করার জন্য সম্মিলিত পদক্ষেপ নিতে। এই দিবসটি নিছক উদযাপনের উপলক্ষ নয়, বরং এটি আমাদের পৃথিবীর অনিন্দ্য সৌন্দর্য এবং এর ভঙ্গুরতাকে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার একটি বার্ষিক আয়োজন, যা আমাদের কর্মে প্রবৃত্ত হতে অনুপ্রাণিত করে। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্রমবর্ধমান হুমকির মুখে দাঁড়িয়ে, ২০২৫ সালের ধরিত্রী দিবস অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে অধিক তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
এই বছরের ধরিত্রী দিবসের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে একটি শক্তিশালী এবং সময়োপযোগী আহ্বান, যা মূর্ত হয়েছে এর আনুষ্ঠানিক থিম বা মূল প্রতিপাদ্যে: ‘আমাদের শক্তি, আমাদের গ্রহ’ (OUR POWER, OUR PLANET)। এই বার্তাটি অত্যন্ত স্পষ্ট – পৃথিবীর ভবিষ্যৎ সুরক্ষার জন্য নবায়নযোগ্য শক্তির উৎসের দিকে দ্রুত স্থানান্তর অপরিহার্য। জীবাশ্ম জ্বালানির উপর আমাদের বিধ্বংসী নির্ভরতা হ্রাস করে সৌর, বায়ু, জল এবং ভূ-তাপীয় শক্তির মতো পরিচ্ছন্ন ও টেকসই উৎসের ব্যবহার বৃদ্ধি করাই এখন সময়ের দাবি। ২০২৫ সালের ধরিত্রী দিবস বিশ্বজুড়ে ব্যক্তি, সংস্থা এবং সরকারদের কাছে একটি জরুরি আহ্বান জানাচ্ছে – আসুন, আমরা সকলে মিলে ২০৩০ সালের মধ্যে পরিচ্ছন্ন শক্তি উৎপাদন তিনগুণ বৃদ্ধি করার লক্ষ্যমাত্রা পূরণে কাজ করি। এই উদ্যোগ কেবল পরিবেশ রক্ষার জন্যই জরুরি নয়, বরং এটি একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, ন্যায়সঙ্গত এবং টেকসই ভবিষ্যৎ শক্তি ব্যবস্থা গড়ে তোলার পথ প্রশস্ত করবে, যা আমাদের গ্রহ এবং এর সকল অধিবাসীর জন্য মঙ্গলময় হবে।
ধরিত্রী দিবসের শিকড় প্রোথিত রয়েছে অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় আগেকার এক গণজাগরণে। ১৯৭০ সালের আগে শিল্পায়ন এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দোহাই দিয়ে পরিবেশ দূষণকে অনেকাংশে উপেক্ষা করা হতো। কলকারখানাগুলো নির্বিচারে ধোঁয়া ও বর্জ্য নির্গত করত, আইনি বা জনরোষের তেমন কোনো ভয় ছিল না। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, ঘন ধোঁয়াশাচ্ছন্ন আকাশকে একসময় ‘সমৃদ্ধির গন্ধ’ বলে মনে করা হতো। কিন্তু এই আপাত সমৃদ্ধির আড়ালে প্রকৃতি যে নীরবে কাঁদছিল, তা কিছু সংবেদনশীল মানুষ উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। ক্যালিফোর্নিয়ার সান্তা বারবারা উপকূলে ১৯৬৯ সালের বিশাল তেল ছড়িয়ে পড়ার ঘটনা এবং এর বিধ্বংসী পরিবেশগত প্রভাব দেখে তৎকালীন মার্কিন সিনেটর গেলর্ড নেলসন গভীরভাবে ব্যথিত ও চিন্তিত হন। তিনি পরিবেশগত শিক্ষার প্রসারে এবং দূষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জন্য একটি জাতীয় দিন পালনের ধারণা সৃষ্টি করেন। তরুণ কর্মী ডেনিস হেইসের সাংগঠনিক দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে সিনেটর নেলসন দেশব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচি আয়োজনের পরিকল্পনা করেন। তাঁদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ১৯৭০ সালের ২২ এপ্রিল প্রায় দুই কোটি আমেরিকান রাস্তায় নেমে এসেছিলেন। তাঁদের দাবি ছিল সুস্থ পরিবেশ, দূষণমুক্ত বাতাস এবং পরিচ্ছন্ন জল। এই অভূতপূর্ব গণঅংশগ্রহণ মার্কিন প্রশাসনের উপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করে।
প্রথম ধরিত্রী দিবসের সেই স্বতঃস্ফূর্ত জাগরণের প্রত্যক্ষ ফলস্বরূপ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যুগান্তকারী পরিবেশগত আইন প্রণীত হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো পরিচ্ছন্ন বায়ু আইন (Clean Air Act), পরিচ্ছন্ন জল আইন (Clean Water Act) এবং পরিবেশ সুরক্ষা সংস্থা (Environmental Protection Agency – EPA) প্রতিষ্ঠা। যা একবার একটি দেশের অভ্যন্তরীণ আন্দোলন হিসেবে শুরু হয়েছিল, তা ধীরে ধীরে সীমানা ছাড়িয়ে এক বৈশ্বিক আন্দোলনে রূপ নেয়। আজ ধরিত্রী দিবস ১৯০টিরও বেশি দেশে পালিত হয় এবং এটি বিশ্বের বৃহত্তম ধর্মনিরপেক্ষ উদযাপনগুলোর মধ্যে অন্যতম হিসেবে স্বীকৃত। এই ইতিহাস আমাদের দেখায় যে, সাধারণ মানুষের সম্মিলিত কণ্ঠস্বর এবং সক্রিয় অংশগ্রহণ নীতিগত পরিবর্তন আনতে ও পরিবেশ সুরক্ষায় কতটা শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে পারে।
আজ, যখন আমরা ২০২৫ সালে দাঁড়িয়ে, ধরিত্রী দিবসের তাৎপর্য কেবল কমেনি, বরং বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন এখন আর কোনো দূরবর্তী হুমকি নয়, এটি আমাদের বর্তমান বাস্তবতা। চরম আবহাওয়ার ঘটনা, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, জীববৈচিত্র্যের ক্ষয় – এই সবই আমাদের গ্রহের স্বাস্থ্যের অবনতির সুস্পষ্ট লক্ষণ। এই পরিস্থিতিতে, ধরিত্রী দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয় পরিবেশ সংরক্ষণে আমাদের সকলের একটি অভিন্ন দায়িত্ব রয়েছে। এই বছরের থিম, ‘আমাদের শক্তি, আমাদের গ্রহ’, সেই দায়িত্ব পালনের একটি নির্দিষ্ট পথের দিকে নির্দেশ করে। জীবাশ্ম জ্বালানি, যা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আমাদের তথাকথিত অগ্রগতির চালিকাশক্তি ছিল, তা-ই আজ আমাদের অস্তিত্বের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই ভূ-তাপীয়, জলবিদ্যুৎ, বায়ু এবং সৌরশক্তির মতো পরিচ্ছন্ন এবং অফুরন্ত শক্তির উৎসগুলোর উপর নির্ভরতা বাড়ানোই হলো টেকসই ভবিষ্যতের চাবিকাঠি। ধরিত্রী দিবস এই রূপান্তরকে ত্বরান্বিত করার জন্য আলোচনাকে উৎসাহিত করে, পরিবেশবান্ধব নীতির জন্য চাপ সৃষ্টি করে এবং স্থানীয় পর্যায়ে উদ্যোগ গ্রহণে প্রেরণা জোগায়।
এই বৈশ্বিক আন্দোলন শুধুমাত্র নীতি নির্ধারক বা বড় কর্পোরেশনগুলোর উপর নির্ভরশীল নয়। ব্যক্তিগত উদ্যোগ এবং জীবনযাত্রায় ছোট ছোট পরিবর্তনও সম্মিলিতভাবে একটি বড় পার্থক্য তৈরি করতে পারে। ধরিত্রী দিবস আমাদের প্রত্যেককে এই পরিবর্তনে অংশ নিতে উৎসাহিত করে। প্লাস্টিকের ব্যবহার কমানো বা সম্ভব হলে পুরোপুরি বর্জন করা, জল ও বিদ্যুতের মতো সীমিত সম্পদের অপচয় রোধ করা, স্থানীয় ও পরিবেশবান্ধব পণ্য ক্রয় করে সবুজ ব্যবসাকে সমর্থন করা, বৃক্ষরোপণ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করা এবং আমাদের চারপাশের জীববৈচিত্র্য রক্ষা করা – এই সবই গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। যখন লক্ষ লক্ষ মানুষ সচেতনভাবে এই ছোট ছোট কাজগুলো করে, তখন তার একটি সামগ্রিক ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। ধরিত্রী দিবস এই সম্মিলিত প্রচেষ্টার প্রতীক, যা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে গ্রহকে বাঁচানোর লড়াইয়ে প্রতিটি ব্যক্তিই একজন গুরুত্বপূর্ণ সৈনিক।
প্রকৃতির সাথে মানুষের সম্পর্ক নিয়ে যুগে যুগে চিন্তাবিদরা গভীর ভাবনা ব্যক্ত করেছেন। থমাস ফুলারের কথায় যেমন গাছের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ পায়, তেমনি ওয়েন্ডেল বেরি স্মরণ করিয়ে দেন যে এই পৃথিবীই আমাদের সকলের সাধারণ ঠিকানা। মহাত্মা গান্ধী বনভূমির প্রতি আমাদের আচরণকে নিজেদের ও একে অপরের প্রতি আচরণের প্রতিফলন হিসেবে দেখেছিলেন। লেডি বার্ড জনসন পরিবেশকে সেই স্থান হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন যেখানে আমাদের সকলের অভিন্ন স্বার্থ জড়িত। আবার, আদি আমেরিকানদের প্রজ্ঞা আমাদের শেখায় যে, আমরা এই পৃথিবী উত্তরাধিকার সূত্রে পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে পাই না, বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছ থেকে ধার করি। চিফ সিয়াটলের সেই অমোঘ উক্তি ‘পৃথিবী আমাদের নয়, আমরাই পৃথিবীর’ অথবা অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের ‘প্রকৃতির গভীরে তাকালে সবকিছু আরও ভালোভাবে বোঝা যায়’ – এই সবই ধরিত্রী দিবসের মূল চেতনার সাথে গভীরভাবে সম্পর্কিত। এই ভাবনাগুলো আমাদের গ্রহের প্রতি আরও যত্নবান হতে এবং এর সম্পদকে দায়িত্বশীলভাবে ব্যবহার করতে অনুপ্রাণিত করে।
২০২৫ সালের এই ধরিত্রী দিবসে দাঁড়িয়ে, আসুন আমরা “আমাদের শক্তি, আমাদের গ্রহ” এই মূলমন্ত্রে উজ্জীবিত হই। নবায়নযোগ্য শক্তির সম্ভাবনাকে পুরোপুরি কাজে লাগিয়ে একটি পরিচ্ছন্ন, সবুজ এবং স্বাস্থ্যকর পৃথিবী গড়ে তোলার জন্য আমাদের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করি। আসুন আমরা কেবল একদিনের জন্য নয়, বরং প্রতিদিন আমাদের কাজ ও চিন্তায় পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিই। ছোট ছোট ব্যক্তিগত পদক্ষেপ থেকে শুরু করে বৃহত্তর নীতিগত পরিবর্তন – প্রতিটি স্তরেই আমাদের সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। কারণ এই পৃথিবীই আমাদের একমাত্র ঘর, এবং একে রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের সকলের। আসুন, আমরা একসাথে কাজ করি, আশার বীজ রোপণ করি এবং এমন একটি ভবিষ্যৎ নির্মাণ করি যেখানে মানুষ ও প্রকৃতি সামঞ্জস্যের সাথে সহাবস্থান করতে পারে। শুভ ধরিত্রী দিবস ২০২৫। আসুন, আমরা আমাদের গ্রহকে লালন করি, এর যত্ন নিই, যেমনটি এটি আমাদের জীবনকে ধারণ করে রেখেছে। পরিবর্তনের সূচনা হোক আমাদের নিজেদের থেকেই, এই মুহূর্ত থেকেই।
লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী
সারাবাংলা/এএসজি