ইসরায়েলের বর্বরোচিত যুদ্ধের অবসান হোক
৩০ এপ্রিল ২০২৫ ১৮:০৪
মানবাধিকার, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী যারা, তাদের হাতেই ফিলিস্তিনে জাতিগত নিধন, স্বাধীনতা হরণ ও গণতন্ত্রের সমাধি রচিত হচ্ছে। এই প্রহসন যেন সভ্যতার সঙ্গে উপহাস। আসলে এরা বর্ণচোরা মুনাফিক। ১৯১৭ সালে ইংরেজরা ফিলিস্তিনে অনুপ্রবেশ করে ও ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে এবং ইহুদিরা ফিলিস্তিনে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করে। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা অন্যায়ভাবে মুসলমানদের ফিলিস্তিন ভূমিকে মুসলমান ও ইহুদিদের মধ্যে ভাগ করে দেয়। ১৯৪৮ সালের ১৫ মে বেলফোর ঘোষণার মাধ্যমে জায়নবাদী অবৈধ ইসরায়েল রাষ্ট্র ঘোষিত হয়। তখন থেকে মুসলমানদের প্রতি ইহুদিদের জুলুম, নির্যাতন ও অত্যাচারের মাত্রা বাড়তে থাকে, যা আজও চলছে।
ফিলিস্তিনিদের সাথে নিকৃষ্টতম আচরণ করছে ইসরায়েল। বিরতি দিয়েও নির্বিচারে নৃশংস হামলা চালাচ্ছে। ইসলায়েলি বাহিনীর অব্যাহত গণহত্যা ও মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘনের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে বাংলাদেশ। পৃথিবীর অনেক কবি ও সাহিত্যিক রক্তের অক্ষরে বর্ণনা করেছে ফিলিস্তিনের অসহায়ত্ব। উপমহাদেশের প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও সমাজ সংস্কারক ইবরাহীম খা সারা দুনিয়ার মুসলমানদের দুরবস্থার জন্য দায়ী করেছেন অশিক্ষাকে। পঞ্চান্ন বছর আগে তিনি ফিলিস্তিনের যে সংকট বর্ণনা করেছেন ‘ফিলিস্তিনের ফরিয়াদ’ গল্পে তা আজও প্রাসঙ্গিক। ইবরাহিম খাঁ বলেছেন , ‘শুধু মসজিদে মসজিদে মোনাজাত করে আমাকে তথা তোমাদের কোনো বিপন্ন দেশকেই তোমরা রক্ষা করতে পারবে না। জ্ঞানের তপস্যা ছাড়া মুসলমানের সামনে পুনরুত্থানের আর কোনো পথই খোলা নাই।
দীর্ঘ সময় ধরে ইসরায়েল কর্তৃক ফিলিস্তিনিদের ও নির্মম, নৃশংস, অমানবিক ও অন্যায় আক্রমণ ও হত্যার জবাব দিতে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের সীমান্তে প্রবেশ করে হামলা চালায় ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস। এই ছলে ইসরায়েল নিরীহ গাজাবাসীর ওপর আক্রমণ চালায়। গাজা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে ৮ এপ্রিল ২০২৫ পর্যন্ত, গাজা যুদ্ধে ৫২,০০০ এরও বেশি মানুষ নিহত হয় তন্মধ্যে ৫০,৮১০ জন ফিলিস্তিনি এবং ১,৭০৬ জন ইসরায়েলি নিহত হয়েছেন। এছাড়াও নিহতের তালিকায় ১৬৬ জন সাংবাদিক ও মিডিয়া কর্মী, ১২০ জন শিক্ষাবিদ এবং ২২৪ জনেরও বেশি মানবিক সহায়তা কর্মী, যার মধ্যে ইউএনআরডব্লিউএ-এর ১৭৯ জন কর্মচারীও রয়েছেন। প্রতিদিন এ তালিকায় নতুন নতুন মৃতের সংখ্যা যোগ হচ্ছে। এটাই হচ্ছে গাজার বাস্তবতা।
জাতিসংঘের মতে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে এপ্রিল/২০২৫ এর মধ্যে গাজার মোট জনসংখ্যার ১০ লাখ ৭০ হাজার মানুষ যা ৮০% বাস্তুচ্যুত হয়েছে। বিবিসির প্রাপ্ত স্যাটেলাইট তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায় যে সমগ্র গাজা উপত্যকায় ১,৪৪,০০০ থেকে ১,৭৫,০০০ ভবন ক্ষতিগ্রস্থ বা ধ্বংস হয়েছে। এটি গাজার মোট ভবনের ৫০% থেকে ৬১%। দক্ষিণাঞ্চলীয় খান ইউনিস শহরটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যেখানে ৩৮,০০০ এরও বেশি (অথবা ৪৬% এরও বেশি) ভবন এখন ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। খান ইউনিসের সবচেয়ে উচু ১৬ তলা বিশিষ্ট আবাসিক ভবন আল-ফাররা টাওয়ার মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। গাজার অনেক ঐতিহাসিক স্থান ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে ৭ম শতাব্দীতে নির্মিত আল-ওমারি মসজিদ।
গাজার সকল স্কুল ৬ মাস ধরে ৬,২৫,০০০ শিক্ষার্থীর জন্য বন্ধ রাখতে হয়েছে। গাজার ৮৭.৭% স্কুল ভবন ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়ে গেছে। অক্টোবর থেকে গাজার ১১ লক্ষ শিশুর মধ্যে ১৪,৫০০ জনেরও বেশি শিশু নিহত হয়েছে,আরও হাজার হাজার ‘নিখোঁজ’ ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়েছে, তাদের মৃত্যুর চিহ্ন নেই। অন্যদিকে চলমান ইসরায়েলি বিমান হামলা এবং শত্রুতার কারণে প্রয়োজনীয় পরিষেবাগুলি ধ্বংস হয়ে গেছে।
অপুষ্টির চিকিৎসা গ্রহণকারী শিশুরা গুরুতর ঝুঁকিতে রয়েছে। বাস্তুচ্যুতির আদেশ বা বোমা বর্ষণের কারণে ১৮ মার্চ ২০২৫ সাল থেকে মোট বর্হিবিভাগীয় চিকিৎসা কেন্দ্রের ১৫ শতাংশ, একুশটি চিকিৎসা কেন্দ্র বন্ধ হয়ে গেছে। এই কেন্দ্রগুলিতে নির্ভরশীল ৩৫০ জন শিশু এখন ক্রমবর্ধমান অপুষ্টির সম্মুখীন, যা জীবন-হুমকির মুখে পড়েছে। অবরোধের কারণে ইউনিসেফ ১,০০০ প্রতিবন্ধী শিশুর জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক বিনোদনমূলক সরঞ্জাম সরবরাহ করতেও বাধাগ্রস্ত হয়েছে।
গাজার ২৬টি হাসপাতাল এবং ৫২টি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র পরিষেবার বাইরে ছিল, ৫৫টি অ্যাম্বুলেন্স ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। WHO একটি আপডেটেড রিপোর্ট প্রদান করেছে যেখানে বলা হয়েছে যে ৭ অক্টোবর ২০২৩ থেকে ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ সালের মধ্যে, গাজায় স্বাস্থ্যসেবার উপর ৪৯২টি আক্রমণ হয়েছে যার ফলে অসংখ্য মানুষ নিহত হয়েছে। জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে গাজার হাসপাতালে ১৩৬ টি হামলায় চিকিৎসা কর্মীদের মারাত্মক ক্ষতি এবং হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী যেসব এলাকায় স্থল অভিযান চালিয়েছে, সেখান থেকেই হাসপাতালগুলিতে হামলার খবর পাওয়া গেছে। ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় চলমান যুদ্ধাবস্থা গাজার স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিয়েছে, যার ফলে ফিলিস্তিনি জনগণের উপর ভয়াবহ পরিণতি সৃষ্টি করেছে। গাজার স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার ধ্বংস এবং এই হামলায় রোগী, কর্মী এবং অন্যান্য বেসামরিক নাগরিকদের হত্যার পরিমাণ আন্তর্জাতিক মানবিক ও মানবাধিকার আইনের প্রতি অবজ্ঞার প্রত্যক্ষ পরিণতি।
২০২৩ সালের নভেম্বরে আল শিফা মেডিকেল কমপ্লেক্স এবং গাজার অন্যান্য হাসপাতালে হামলার মাধ্যমে শুরু হয়েছিল। ফিলিস্তিন রাজ্যের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, ২০২৪ সালের জুনের শেষে, গাজার ৩৮টি হাসপাতালের মধ্যে ২২টি অকার্যকর হয়ে পড়েছিল। গাজার উত্তরে কামাল আদওয়ান হাসপাতাল এবং গাজার দক্ষিণে আল আমাল হাসপাতাল অবরোধের ঘটনাটি OHCHR দ্বারা পর্যবেক্ষণ এবং নথিভুক্ত ছয়টি প্রতীকী ঘটনার মধ্যে দুটি। নভেম্বরে আল শিফা হাসপাতাল এবং ইন্দোনেশিয়ান হাসপাতাল, ডিসেম্বরে আল আওদা হাসপাতাল এবং কামাল আদওয়ান হাসপাতাল এবং জানুয়ারিতে আল আমাল হাসপাতাল এবং পিআরসিএস সদর দপ্তর অবরোধের সময়, বেসামরিক নাগরিকদের উপর সরাসরি গুলি চালানো হয়েছিল, যার ফলে চিকিৎসা কর্মীসহ বেসামরিক নাগরিকদের হতাহত হয়েছিল এবং হাসপাতাল এবং তাদের আশেপাশের এলাকায় বেসামরিক নাগরিকদের চলাচলে কার্যকরভাবে বাধা দেওয়া হয়েছিল।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থা ওসিএইচএ বলছে, পুরো গাজায় আনুমানিক সাড়ে চার হাজার মানুষের কৃত্রিম পা লাগানো প্রয়োজন। আর যে দুই হাজার বাসিন্দা কৃত্রিম হাত-পা পেয়েছেন, তাদের রক্ষণাবেক্ষণ প্রয়োজন। গাজায় আন্তর্জাতিক রেড ক্রস কমিটির (আইসিআরসি) শারীরিক পুনর্বাসন কর্মসূচি পরিচালক আহমেদ মুসা বলেন, তাদের কর্মসূচিতে কমপক্ষে ৩ হাজার জনকে নিবন্ধিত করা হয়েছে, যাদের মধ্যে ১ হাজার ৮০০ জনের অঙ্গচ্ছেদ হয়েছে। ওসিএইচএ এবং আইসিআরসি অনুসারে আরও হাজার হাজার ফিলিস্তিনি মেরুদণ্ডের আঘাতে ভুগছেন, অথবা দৃষ্টিশক্তি বা শ্রবণশক্তি হারিয়েছেন।
যুদ্ধে বিপুলসংখ্যক মানুষ আহত হওয়ায় চিকিৎসা দেওয়ার প্রচেষ্টা ধীর ও জটিল হয়ে উঠেছে। আইসিআরসির কর্মকর্তারা জানান, গাজা উপত্যকায় কৃত্রিম অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পৌঁছানো চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মুসা বলেন, সঠিক কৃত্রিম অঙ্গ বা চলাচলের উপকরণ পাওয়া এখন ক্রমবর্ধমান চ্যালেঞ্জ। যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে পুনরায় হামলা শুরুর পর এক মাসের বেশি সময় ধরে গাজায় কোনো ত্রাণ সহায়তা ঢুকতে দিচ্ছে না ইসরায়েল। পা হারানো ফারাহ বলেন, তিনি জানেন না কখন কৃত্রিম পা পাবেন বা বিদেশে চিকিৎসা নিতে যাবেন।
আন্তর্জাতিক আদালত অবৈধ ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলের জালিম প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করলেও আমেরিকা তাদের বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করছে। জাতিসংঘে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার সিদ্ধান্ত এলেও আমেরিকা তাতে ভেটো দিয়ে তা বানচাল করে দিচ্ছে। অন্যদিকে ইসরায়েল ফিলিস্তিনে ত্রাণসহায়তা প্রবেশে বাঁধা দিয়ে গৃহহীন ফিলিস্তিনিদের দুর্ভিক্ষের দিকে ঠেলে দিয়েছে। স্কুল, হাসপাতাল ও আশ্রয়কেন্দ্রে বোমাবর্ষণ করছে। জাতিসংঘের স্থানীয় অফিস ও কর্মীদের গাড়িতে, ত্রাণবাহী গাড়িতে, ত্রাণকর্মীদের ওপর, এমনকি সংবাদকর্মীদেরও হামলা চালিয়ে নির্বিচারে হত্যা করে যাচ্ছে।
সারা পৃথিবী তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। আরব শাসকদের অধিকাংশেরই এ ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা বিশ্ববাসীর নজরে পড়েনি। ইউরোপ-আমেরিকায় ছাত্র-জনতা ও সচেতন নাগরিক সমাজ প্রতিবাদ জানাচ্ছে, স্বৈরাচার শাসকগোষ্ঠী তা কঠোর হস্তে নিপীড়নের মাধ্যমে দমন করছে। বাংলাদেশসহ বিভিন্ন মুসলিম দেশের জনগণ প্রতিবাদ সমাবেশ করে যাচ্ছে। কিন্তু ওআইসি, ওপেক, আরব লীগ ও জাতিসংঘের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ নয় বলে বিশ্ববাসীর সামনে প্রতীয়মান হয়েছে। বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে – এ ব্যাপারে তারা নির্বিকার।
লেখক: অধ্যক্ষ, কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ, কুড়িগ্রাম
সারাবাংলা/এএসজি
ইসরায়েলের বর্বরোচিত যুদ্ধ প্রফেসর মীর্জা মো. নাসির উদ্দিন মত-দ্বিমত