বিজ্ঞাপন

‘চিকিৎসা বন্ধ থাকবে, এটা হতে পারে না’

July 8, 2018 | 11:29 pm

।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।

বিজ্ঞাপন

ঢাকা: বৃহত্তর চট্টগ্রামের সব বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকের চিকিৎসাসেবা এবং চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বার অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধের ঘোষণাকে ‘অমানবিক’ বলেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, মানবিক দিক বিবেচনায় কখনোই চিকিৎসকরা এ ধরনের কর্মসূচি দিতে পারেন না। চিকিৎসকদের এ আন্দোলনকে ‘রিয়্যাকটিভ আন্দোলন’ অভিহিত করে তারা বলছেন, চিকিৎসা বন্ধ থাকবে, এটা হতে পারে না। চিকিৎসকের সহানুভূতির মতো বিষয়গুলো এখন ব্যবসায়িক পণ্য হিসেবে চলে এসছে বলেও অভিতম তাদের।

রোববার (৮ জুলাই) বিভিন্ন অনিয়মের কারণে চট্টগ্রামের ম্যাক্স হাসপাতালকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা করে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। এদিকে, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম এ হাসপাতালের অভিযুক্ত চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলকে (বিএমডিসি) নির্দেশ দিয়েছেন।

ম্যাক্স হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায় প্রাণ হারায় শিশু রাইফা

গত ২৯ জুন ম্যাক্স হাসপাতালে শিশু রাইফা’র মৃত্যুর পর ভুল চিকিৎসার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নির্দেশে স্বাস্থ্য অধিদফতর ও চট্টগ্রামের সিভিল সার্জনের পৃথক দু’টি তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের সুপারিশের ভিত্তিতে মন্ত্রী এই নির্দেশ দেন। প্রতিবেদনের সুপারিশ অনুযায়ী অভিযুক্ত চিকিৎসকরা হলেন ডা. বিধান রায় চৌধুরী, ডা. দেবাশীষ সেন গুপ্ত এবং ডা. শুভ্রদেব।

বিজ্ঞাপন

পরে বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকে চিকিৎসাসেবা বন্ধের ঘোষণা দিয়ে বেসরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান সমিতির সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দেয় বেসরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান মালিক সমিতি। সমিতির দুই বার পাঠানো বিজ্ঞপ্তির প্রথমটিতে হাসপাতাল ও চিকিৎসকদের ওপর সাংবাদিকদের নগ্ন হামলার প্রতিবাদে চিকিৎসা সেবা বন্ধের ঘোষণা দেওয়া হলেও দ্বিতীয়বার পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘বেসরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে অভিযানের নামে অস্ত্র তাক করে ভীতিকর পরিবেশ তৈরি করে সাংবাদিকসহ সদলবলে ন্যাক্কারজনক অনুপ্রবেশের প্রতিবাদে বেসরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে অনির্দিষ্টকালের জন্য চিকিৎসা কার্যক্রম ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।’

বিভিন্ন অনিয়মের কারণে ম্যাক্স হাসপাতালকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা করে র‌্যাব

বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক বন্ধের এই ঘোষণাকে সম্পূর্ণ অনাকাঙ্ক্ষিত উল্লেখ করে স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের আহ্ববায়ক অধ্যাপক ডা. রশীদ-ই মাহবুব সারাবাংলা’কে বলেন, ‘যখন কোনো রাষ্ট্রে সুবন্দোবস্ত, সুনিয়ন্ত্রিত স্বাস্থ্য ব্যবস্থা না থাকে, তখন এ ধরনের ঘটনা ঘটতেই থাকবে। এসব ঘটনা কেন ঘটে, কীভাবে ঘটে এবং এসবের জন্য দায়ী কে, এগুলো অন্যতম প্রশ্ন হওয়া উচিত। রাষ্ট্র যখন সুস্থ চিকিৎসা ব্যবস্থা দিতে পারে না, তার সুযোগ নিয়ে সংশ্লিষ্টরা এসব ঘটনা ঘটিয়ে থাকেন। এটা কোনোভাবেই ঠিক না।’

তিনি বলেন, ‘চিকিৎসা যখন হয়, তখন অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর ঘটনা কম ঘটে না। কিন্তু যে ভুক্তভোগী, তার প্রতিকার পাওয়ার অধিকার রয়েছে। রাষ্ট্র কিন্তু সেই প্রতিকারটুকু পাওয়ার বন্দোবস্ত করে দেয়নি। রাষ্ট্র যদি সেই বন্দোবস্ত করে দিত, তাহলে কোনো ঘটনার জন্য কে কতটুকু দায়ী, সে তার দায় অনুযায়ী শাস্তি পেত।’

বিজ্ঞাপন

অনিয়মের অভিযোগ সিএসসিআর’কেও ৪ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়

স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের এই নেতা বলেন, ‘আন্দোলন দুই ধরনের হয়ে থাকে- একটি জাস্টিসকে প্রতিষ্ঠা করা; অন্যটি রিয়্যাকটিভ আন্দোলন, সেখানে জাস্টিস প্রতিষ্ঠিত হয় না। রাষ্ট্রে সুচিকিৎসা ও দায়বদ্ধতার বন্দোবস্ত থাকলে এ ধরনের অবাঞ্ছিত ঘটনা কম হবে।’

চাইলেই চিকিৎসকরা আন্দোলন করে সেবা বন্ধ করতে পারেন কিনা- জানতে চাইলে অধ্যাপক রশীদ-ই মাহবুব বলেন, ‘চাইলেই তাৎক্ষণিকভাবে আন্দোলন করে সেবা বন্ধ করা যায় না। চিকিৎসকরা জরুরি চিকিৎসা দিতে বাধ্য।’

জানতে চাইলে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক মহাসচিব ও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সভাপতি অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান সারাবাংলা’কে বলেন, ‘বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক মালিক সমিতি যা করেছে, সেটা কোনো বিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত নয়। প্রশাসন অথবা যেকোনো গোষ্ঠীর কারণে যদি তারা এ সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে, সেখানে সাধারণ মানুষ জিম্মি হচ্ছে, যাদের সাথে এর সম্পর্ক নেই। তাই তাদের জিম্মি করা আমি মনে করি না সঠিক কোনো কাজ।’

চট্টগ্রামের বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকে সেবা বন্ধ থাকায় দুর্ভোগে পড়েন রোগীরা

তিনি বলেন, ‘আমি অনুরোধ করছি, বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক সমিতি তাদের এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসবে।’ সামাজিকভাবে অসহিষ্ণুতা বেড়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, নিজেরাই আইন হাতে তুলে নিচ্ছে এবং বিচার করছে।

বিজ্ঞাপন

চিকিৎসকদের সাথে যে সাধারণ মানুষের দূরত্ব তৈরি হচ্ছে, তার পেছনেও বিভিন্ন কারণ রয়েছে এবং এগুলোর সমাধান করা জরুরি বলে মন্তব্য করেন ডা. ইকবাল। তিনি বলেন, ‘চিকিৎসকরা এভাবে হঠাৎ করে সব কর্মকাণ্ড বন্ধ করে দেওয়ার কোনো ইতিহাস বাংলাদেশে নেই। অতীতে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন এভাবে কিছু করেনি।’

বিএমএ চট্টগ্রাম জেলা শাখা বেসরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান মালিক সমিতির সেবা বন্ধের সিদ্ধান্তে একাত্মতা জানিয়েছে। বিএমএ এটা করতে পারে কিনা জানতে চাইলে বিএমএ’র সাবেক এই মহাসচিব বলেন, ‘আমি আশা করছি, কেন্দ্রীয় বিএমএ তাদের সাথে আলোচনা করবে এবং এখান থেকে বেরিয়ে আসবে বলেই আমার বিশ্বাস।’

ডা. আর্সলান বলেন, ‘চিকিৎসকের এ ধরনের হরতাল, স্ট্রাইক বা কর্মবিরতিতে যেতে পারেন কিনা বা তাদের এ ধরনের পদক্ষেপ কতটকু নৈতিক বা যৌক্তিক, তা নিয়ে সারাবিশ্বেই বিতর্ক রয়েছে। কিন্তু মানবিক দিক বিবেচনায় চিকিৎসকদের এ ধরনের কর্মসূচিতে যাওয়া কোনোভাবেই বাঞ্ছনীয় নয়। মানবিকভাবে এটা ঠিক নয়, মানুষকে জিম্মি করা উচিত না।’

মুমূর্ষু অনেক রোগীকেও সেবা না নিয়ে ফিরে যেতে হয়েছে

এদিকে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও গবেষক ড. রাহমান নাসির উদ্দিন সারাবাংলা’কে বলেন, ‘স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং চট্টগ্রাম সিভিল সার্জনের নেতৃত্বে গঠিত কমিটি ম্যাক্স হাসপাতালের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে। র‌্যাবের অভিযানে হাসপাতালের অনিয়ম, দুর্নীতি ও প্যাথলজি রিপোর্টের অবৈধ ব্যবসার বিষয়টি সামনে এসেছে, যেটা ভয়াবহ। এটা প্রকারান্তরে আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থায় বিরাজমান বড় একটি অপ্রিয় সত্যকে তুলে ধরেছে। সরকারের দায়িত্ব এর সূত্র ধরে বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থারই একটি সত্যিকার চিকিৎসা করা।’

তিনি বলেন, ‘ম্যাক্স হাসপাতালসহ আরও তিনটি হাসপাতালে র‌্যাবের অভিযান চালানো এবং তাদের জরিমানা করার প্রতিবাদে চিকিৎসা বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা এসেছে। তার অর্থ কি এই যে ভুল চিকিৎসার অধিকার দিতে হবে, চিকিৎসায় অবহেলায় মানুষকে মেরে ফেলার অধিকার দিতে হবে, প্যাথলিজ টেস্টের নামে যাচ্ছে তাই করার অধিকার দিতে হবে? আর তা না হলে মানুষের চিকিৎসাও বন্ধ করে দিতে পারবে তারা?’

বাংলাদেশের চিকিৎসা খাত একটি ভয়াবহ মাফিয়ার রূপ ধারণ করেছে, যার সত্যিকার ট্রিটমেন্ট জরুরি, মন্তব্য ড. রাহমান নাসিরের।

সারাবাংলা/জেএ/টিআর

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন